শিল্প-সাহিত্য

চাঁদের আলোয় রূপালী প্রেম

ক্লাস শেষ করে কলেজ থেকে ফিরে মনটা বিষণ্ন হয়ে গিয়েছিলো বলে শুয়ে পড়ছিলো তিতলি। ঘুম থেকে উঠে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হল, ‘উহ্ঃ রাত দশটা।’ উঠে বেলকনিতে এসে দাঁড়ালো। পরিপূর্ণ চাঁদ ভালোবাসার জোছনা পৃথিবীর প্রান্তরে বিছিয়ে দিয়েছে। দূরে তাকালে মনে হয় যেন জোছনার গভীর সমুদ্র।

চাঁদের পরিপূর্ণ অপূর্ব শোভা তিতলি আজই প্রথম উপলব্ধি করল। সুন্দর কোনোকিছু মনের গহীন কোণে প্রতিফলন ঘটাতে হলে, সুন্দর মনে অবগাহন করতে হয়। পরিপূর্ণ জোছনারূপী ভালোবাসায় সে মনের অজান্তে বলে উঠল, ‘আহ্ কী সুন্দর দৃশ্য!’

‘আপু কী হয়েছে রে!’ ছোট বোন তিরণা পাশে এসে দাঁড়ালো। ‘ত্ইু কার সাথে কথা বলছিস্ আপু?’

‘চাঁদের জোছনার সাথে।’ তিতলি যেন একটা ঘোরের মধ্যে থেকে জবাব দিলো।

‘ধুৎ! জোছনা তো কতোই দেখেছি, এটা কি দেখার কিছু আছে?’ বিরক্ত হলো তিরণা।

ওর কথায় ব্যথিত হলো না তিতি। বললো, ‘শোন তিরনা, আমার মাথায় সুন্দর একটা আইডিয়া এসেছে। আমরা আজ জোছনার রূপের সাগরে সাঁতার কাটব। যাবি আমার সাথে?’

তিতলির পানে তাকিয়ে আছে তিরণা। ভাবছে, তার বড় বোনটা কী পাগল হয়ে গেল নাকি!

‘জোছনার রূপের সাগরে সাঁতার কাটবি? মহিলা হিমু নাকি? ’

‘হিমু-টিমু নয়। শোন, প্লাবণের সাথে আজ আমার বন্ধুত্বের অবসান হয়ে গেছে। ও আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। তাই দুঃখ ভুলতে জোছনার প্ল¬াবণে আমরা ভাসবো। সূর্য থেকে ধার করে চাঁদ ভালোবাসার জোছনা পৃথিবীর প্রান্তরে মেলে দিয়ে অপূর্ব জ্যোতি ছড়ায়। সেই ভালোবাসাকে আঁকড়ে সাঁতার কাটবো জোছনার নদীতে। যেখানে কোনো স্বার্থপরতা নেই, আছে শুধু পরের তরে বিলিয়ে দেবার আনন্দ, চল যাবি সাথে?’

রাজি হলো তিরণা। দু’বোন মিলে নেমে এলো দো’তলা থেকে মায়ের চুপিসারে। রাস্তায় মানুষজন নেই। নিরিবিলি পরিবেশ চারদিকে। ওরা হাঁটছে রাস্তায়। পাশে বিরাট মাঠ, অদূরে একটা বটগাছ। সেখানে মানুষজন বসার বেঞ্চি আছে।

‘আপু এই রাত-বিরাতে যদি পাড়ার সেই বখাটে মাস্তানগুলো আমাদের কোনো অঘটন ঘটিয়ে দেয়?’’ তিরণা ভয় পাচ্ছে।

‘বখাটে ছেলেরা আমাদের মতো জোছনার রূপে পাগল হয় না। ওরা জোছনার এই রাতে ঘর থেকে বের-ই হবে না। চল্।’ বললো তিতলি।

দু’বোন প্রায় বটগাছটার কাছাকাছি চলে এসেছে। গুণগুনিয়ে গান গাইছে তিতলি। এমন সময় একি! বটগাছটার ওপাশ হতে অস্পষ্ট তিনটি ছায়ামূর্তির অবয়ব ভেসে উঠল। ওরা ক্রমশঃ এদিকেই আসছে।

ভয় পেল তিরণা। পিছু হটতে লাগলো। খপ্ করে ওর হাত ধরে ফেলল তিতলি। ‘ভয় পাবি না, যারা এমন একটি পবিত্র রাতে ঘুরে বেড়ায় ওরা কারো ক্ষতি করবে না।’ তিতলি অভয় দিলো।

তিন যুবকের চেহারা স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হলো। তিতলি ও তিরণা ওদের চিনতে পারলো। শাওন শাওকী, কবির শাহরিয়ার ও অনাবিল ইবনে সিদ্দিক। পাড়ার আদুভাই ওরা, সবাই ওদের যমের মতো ভয় পায়। যুবকেরা এক এক করে দু’বোনের সামনে হিন্দী ছায়াছবির নায়কের মতো পা-দু’টো ফাঁক করে বুকের জমিনে হাত রেখে দাঁড়াল।

তিরণা ভয়ে চলে যেতে চাইল, কিন্তু বাধা দিল শাওন শাওকী। ‘কোথায় যাচ্ছ তোমরা?’

‘জোছনার সাগরে সাঁতার কাটতে। যাবেন?’ তিতলি নির্ভয়ে জবাব দিলো।

হতবাক হয়ে গেল ওরা। বলে কী মেয়েটা! এত রাতে, নির্জন মাঠে একটি মেয়ে তিনজন যুবকের সাথে এভাবে নির্ভয়ে কথা বলতে পারে? ওর মনে কী কোনো ভয় নেই?’

‘তুমি কী জানো কী বলছ তুমি?’ ধমকে ওঠলো যুবকদের মধ্যে থেকে একজন।

‘জানি। চলুন না আমাদের সাথে ওই নদীটার পাড়ে। পাথরের ওপর বসে জোছনাভরা পানিতে পা’ছড়িয়ে বসে জোছনার অপূর্ব সুধা উপভোগ করবো।’ তিতলি যুবকের চোখের পাণে তাকিয়ে বললো।

‘তুমি কি আমাদের সম্পর্কে জানো না? আমরা এ পাড়ার অত্যন্ত অশান্ত ছেলে। কথায় কথায় মানুষের সাথে মারামারিতে জড়িয়ে পড়ি। কাউকে ভয় পাই না।’

‘আপনার গায়ে লেখা আছে?’ তিতলি জবাব দিলো।
তিতলির কথায় উচ্চস্বরে হেসে উঠে যুবকরা। শাওন শাওকী বলে, ‘ঠিক আছে, তোমরা কোথায় যাচ্ছো, কোন্ জোছনার রূপের নদীতে?’

মেঘনার পাড়ে এসে থামল ওরা। যেখানে পাথরের ব্লক ফেলা হয়েছে ভাঙ্গন রোধে। সবাই ব্ল¬কের ওপর বসে পড়ল। এর মধ্যে শাওন শাওকী একদম পানির কিনারে ব্ল¬কের ওপর বসল নদীর পানির ওপর মুখ রেখে। সে গান গাইছে-‘আমায় যদি গো ভালোবাস তুমি, প্রেম দিও জোছনা রাতে……’

শাওনের দু’চোখ দিয়ে অশ্র“ গড়িয়ে পড়ছে পানিতে। চাঁদের রূপালী আলোয় সে অশ্র“ফোঁটাগুলো মুক্তোর মত ঝিকমিক করে জ্বলতে জ্বলতে যেন গড়িয়ে পড়ছে নদীর বুকে। শাওনের কাছে এসে বসল তিতলি। বললো, ‘তোমার মনে কি খুব দুঃখ?’

‘হ্যাঁ, অনেক দুঃখ। সারাজীবন মানুষের ঘৃণাই পেয়েছি। কারো ভালোবাসা পাইনি। কেউ ভালোবেসে কাছে টেনে নেয়নি। কেউ শোনায়নি কাছে আসার কোনো গল্প। আজ তাই আমি এসেছি জোছনাকে ভালোবেসে তাকে কাছে পাবার জন্যে। তার ভালোবাসা পাবার জন্যে।’ শাওন তার পকেট হাতড়ে একটি চিরকুট বের করল। তাতে চাঁদের আলোয় রূপালী প্রেমের জন্যে কাগজের বুকে কালির কলম দিয়ে কিছু লিখলো সে। তারপর সেটা মেলে ধরলো তিতলির সামনে। তিতলি কাগজটা হাতে নিয়ে চাঁদের রূপালী আলোতে দেখলো, তাতে লেখা আছে-‘যদি ভালোবাসো…..’।

তিতলি মনের আকুতি মাখানো কণ্ঠে বললো, ‘অবশ্যই। এমন জোছনা রাতে শুধু ভালোবাসাই মানায়, দুঃখ নয়।’ সে শাওনের দু’চোখের অশ্র“ মুছে দিয়ে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো।

শাওন অস্ফুট স্বরে বললো, ‘ভালোবাসা ও আমার ভালোবাসা! কেনো তুমি এতো দেরিতে আসলে? তোমাকে পাবার জন্যে আমি বসেছিলাম হাজারো রাত, তোমার জন্যে কেঁদেছিলাম অনেক অনেক দিবস। তোমার আসতে দেরি দেখে আমি জীবনের আশাই ছেড়ে দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম তুমি আর কখনো কাছে আসবে না।’

তিতলি এবার শাওনের বুক থেকে সরে সামনে এসে দাঁড়লো। তারপর শাওনের চোখে চোখ রেখে বললো, ‘না, তোমার ভালোবাসা অবশ্যই তোমার কাছে আসবে। এই দেখো তোমার আর আমার কাছে আসার গল্পটা কতো সহজ। আজকের প্রকৃতির অনাবিল জোছনাই হয়তো আমাকে তোমার কাছে টেনে নিয়ে এসেছে। চলো আমরা হারিয়ে যাই আজকের জোছনার রূপের নদীতে। চাঁদের রূপালী আলোয় যে প্রেম এসেছিলো তাকে আমরা সারাজীবন বুকে ধরে রাখবো।’

শাওন তিতলির হাত ধরলো। তারপর সবাইকে ছাড়িয়ে ভালোবাসার আহ্বানে জোছনার রূপের নদীতে সাঁতার কাটতে চলে গেলো ক্রমে ক্রমে দূরের পথে। পেছনে জোছনার এক অপূর্ব আলো মায়াময়ী ভালোবাসাকে চক্রাকারে অবগাহন করতে লাগলো।

মিজানুর রহমান রানা || আপডেট: ০৮:১১ অপরাহ্ন, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫, বৃহস্পতিবার
চাঁদপুর টাইমস : এমআরআর/২০১৫

Share