শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড আর যারা শিক্ষা দেন তারা শিক্ষা গুরু। জাতির অহংকার আমাদের সেই শিক্ষকদের মেরুদন্ড হলো একটি উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা। যা আমাদের ইতোমধ্যেই উপলব্ধি হয়েছে। কিন্তু সু-নির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকা সত্ত্বেও আমাদের জাতির মেরুদন্ড নিখুঁতভাবে গড়ে তুলতে পারছি না।
বিগত কয়েক বছর যাবত শিক্ষার মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকার চালু করেছে সৃজনশীল শিক্ষা ব্যবস্থা। বুঝে হোক আর না বুঝেই হোক এ ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা সমালোচনা রয়েছে অনেক।
সত্যিকারার্থে যদি এটির শতভাগ প্রয়োগ সম্ভব হয় তবে আমরা আগামী দিনে একটি উন্নত জাতি হিসেবে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হবো বলে ইতোমধ্যে অনেক অভিজ্ঞজন মন্তব্য করেছেন।
এজন্য প্রয়োজন শিক্ষকদের ব্যাপক প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষার্থীদের মাঝে অধিক সচেতনতা বৃদ্ধি। এর কোনটিই আশানুরূপ হয়ে উঠেনি যার ফলে এ ব্যবস্থা আজ আমাদের গলার ফাঁস হয়ে দাঁড়িয়েছে এমনটিই মনে করছেন সমাজের বিশিষ্টজনরা ।
শিক্ষক-শিক্ষার্থী এমনকি অভিভাবকদের অনেকেই এ বিষয়ে আজও তেমন সচেতন নন। ফলে সনাতন পদ্ধতির অনুস্মরণই করেই চলছে আমাদের জাতির মেরুদ- গড়ার কাজ। এ কাজে কোন প্রকার বাধা না আসাতেই এক শ্রেণীর শিক্ষক এবং কিছু প্রকাশনী কমিশন প্রতিযোগিতায় চালিয়ে যাচ্ছে রমরমা গাইডের ব্যবসা। চাঁদপুর নতুনবাজারের সাধারণ একজন ক্ষুদ্র বই ব্যবসায়ী জানান, লেকচার, পাঞ্জেরী, জুপিটার, গ্যলাক্সি, অনুপমসহ কয়েকটি পাবলিকেসন্স এর কাছে আমরা জিম্মি হয়ে পড়েছি।
সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ এসব প্রকাশণীর গাইডের কারণে শিক্ষার্থীদের মেধার বিকাশ সঠিকভাবে হচ্ছে না বলে অভিযোগ সচেতন অভিভাবকদের।
তারা বলছেন, এ বিষয়ে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া না হলে শিক্ষার্থীরা আলোহীন একটি অন্ধকার জাতিতে পরিণত হবে। এসব নিষিদ্ধ গাইড বই তথ্য সংগ্রহে চাঁদপুরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঘুরে দেখা যায় স্কুল মাদরাসার শিক্ষার্থীরা এসব গাইডের প্রতিই তাদের আগ্রহ একটু বেশি। এর কারণ জানতে হাসান আলি সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন করা হলে তারা যানায় আমাদের ‘স্যারেরাতো এসব গাইড থেকেই প্রশ্ন করে এমনকি আমাদেরকে সাজেশনও দেয় এ জন্যই আমরা গাইড কিনি। স্যারেরা যদি ক্লাসে আমাদেরকে আরো ভালভাবে নার্সিং করে তাহলে এসব গাইড বই কিনতে হবে না। এসব গাইড কিনতে বাজারের কয়েকটি লাইব্রেরীতে দেখা যায় শিক্ষার্থীদের ভিড়।’
মাদরাসার ছাত্র আবুবকর সিদ্দিককে দেখা যায় নতুন বাজারের একটি বইয়ের দোকানে গাইড কিনছে। এসময় তাকে প্রশ্ন করা হলে সে বলে ‘আমাদেরকে স্যারেরা কিনতে বলেছে তাই কিনতেছি। এগুলো যে নিষিদ্ধ তাতো আমরা জানি না তার অভিযোগ, জানলেতো আর আমরা কিনতাম না।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন বই বিক্রেতা জানায় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের সাথে বই কোম্পানির মোটা অংকের চুক্তি হয়, চুক্তি অনুযায়ী শিক্ষাকরা শিক্ষার্থীদের ওইসব কোম্পানির বই কিনতে নির্দেশ দিয়ে থাকে। এতে শিক্ষার্থী, অভিভাবক বা বই বিক্রেতাদের কি করার আছে।
একজন বই ব্যাবসায়ী বলেন বিগত দিনে একবার অভিযান হয়েছিল তখন আমরা বলেছিলাম যে সব কোম্পানি এবং শিক্ষকরা এর সাথে জড়িত তাদের ব্যাপারে কঠোর ব্যাবস্থা গ্রহণ ও ছাপা বন্ধ করা হলে শিক্ষার্থীরা নিতে আসবে না আমাদেরকেও আর বিক্রি করতে হবে না।
বর্তমান সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে গাইডের প্রভাব কি? এমন প্রশ্নের জবাবে চাঁদপুর সদরের সাপদী মহিলা মাদ্রাসার শিক্ষক মাও. মাহমুদুল হাসান সালেহী জানান, সৃজনশীল আধুনিক পদ্ধতি। এর আগে শিক্ষার্থীরা সাধারণত একটি গল্প/কবিতার শেষে অনুশীলনী থেকে প্রশ্ন ও ব্যাখ্যা পড়ার জন্য শিক্ষকের পাশাপাশি গাইডের সহায়তা নিতো। কিন্তু এখন সৃজনশীল হওয়ায় গাইডের প্রয়োজনীয়তা নেই। কারণ গল্প বা কবিতার সারসংক্ষেপের উপর ভিত্তি করে উদ্দীপক তৈরি করা হয় আর উদ্দীপক থেকে প্রশ্নোত্তর লিখতে হয় শিক্ষার্থীদের।
এ শিক্ষক আরো জানায়, এসব উদ্দীপক শিক্ষার্থীরা গল্পটি ভালোভাবে না বুঝে উদ্দীপক সংশ্লিষ্ট অনুশীলন মুখস্তকরণের মাধ্যমে পরীক্ষায় অংশ নেয়। এজন্যই অনেক শিক্ষার্র্থী ফলাফল খারাপ করে। তাছাড়া পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে প্রশ্ন করার সময় সাধারণত কোনো গাইড অনুসরণ করা হয় না। তখন গাইড নির্ভর শিক্ষার্থীরা বিপাকে পড়ে। তাই সার্বিকভাবে গাইডের উপর নির্ভরশীলতা শিক্ষার্থীর জন্য বিদপজনক।
গাইড প্রচলনের জন্য দায়ী কারা জানতে চাইলে তিনি জানান, ‘গাইড কোম্পানীগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি করে। বাৎসরিক পরীক্ষাগুলোতে গাইড কোম্পানী তাদের নিজস্ব খরচে প্রশ্ন যোগান দেয়। এখানে উভয়রই স্বার্থ জড়িত।’
গাইড ব্যবস্থাপনায় সৃজনশীলতার উদ্দেশ্য ভয়াবহ আকারে ব্যহত হচ্ছে জানিয়ে, চাঁদপুর হাসান আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ মো. নূর খান জানান, সৃজনশীলতা যে উদ্দেশ্যে করা হয়েছে গাইড ব্যবস্থাপনার কারণে সেটি হচ্ছে না। সৃজনশীল করা হয়েছে শিক্ষার্থীরা যাতে মুখস্ত বিদ্যা থেকে বেরিয়ে এসে একটি গল্প/কবিতা ভালোভাবে বুঝে নিজের মতো করে কিছু লিখতে পারে। কিন্তু গাইডের কারণে শিক্ষাথৃীরা এখন গাইড থেকে দেখে দেখে আগের মতই মুখস্ত করে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করছে।’
তবে এসবের জন্য গাইড নিষিদ্ধের পাশাপাশি শিক্ষক ও অভিভাবকদের সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
প্রতিবেদক, দেলোয়ার
।। আপডেট : ০৮:০০ এএম, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৫, সোমবার
ডিএইচ