ইলিশ কেবলমাত্র চাঁদপুরবাসীর সম্পদ নয়। ইহা আমাদের জাতীয় প্রাকৃতিক সম্পদও বটে। পৃথিবীর যে সব দেশে ইলিশ উৎপন্ন হয় তম্মধ্যে বাংলাদেশে ৭০%,ভারতে ১০%,বার্মায় ১০% এবং অন্যান্য দেশে ১০% উৎপন্ন হয়।
এর মধ্যে চাঁদপুর অঞ্চরে উৎপাদন হয় ৬০ ভাগ। চাঁদপুরের মৎস্য বিজ্ঞানীরা চাঁদপুরের নৌ-সীমানায় চর আলেকজান্ডার পর্যন্ত ১শ’কি.মি ও পদ্মার অংশে ২০ কি.মি.নদীতে ৬০% ইলিশের অস্তিত্ব পেয়েছেন।
এরইমধ্যে বাংলাদেশের পণ্য হিসেবে ভৌগোলিক নির্দশন তথা আন্তর্জাতিক জিআই (Geographical indication) স্বীকৃতি পেয়েছে ইলিশ।
চাঁদপুরে ইলিশ উৎপাদন জোরদারকরণে ৩৩ কোটি টাকার ৫ বছর মেয়াদী একটি প্রকল্প বরাদ্দ দিয়েছে মৎস্য বিভাগ। চাঁদপুর নদী গবেষণা কেন্দ্রে এ প্রকল্প নিয়ে পরিচালকের কার্যালয়ও খোলা হয়েছে।
ফলে মৎস্য বিভাগ চাঁদপুরকে ইলিশের অভয়াশ্রম ও মা ইলিশ রক্ষায় বিভিন্ন পদক্ষেপসহ অনেকগুলো কাজ হাতে নিয়েছেন।
২০০৩ সাল থেকে ইলিশের অভয়াশ্রম ও মা ইলিশ রক্ষার পদক্ষেপগুলো ক্রমেই জোরদার করা হচ্ছে। তাই ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে অনেক গুণ। পাশাপাশি জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থানে প্রকল্পও হাতে নেয়া হয়েছে। দেশের মৎস্য বিভাগ এরইমধ্যে ৫টি নদী ও উপকূলীয় অঞ্চলকে অভয়াশ্রম বা ইলিশের বিচরণক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
সেগুলো হলো চাঁদপুরের ষাটনল থেকে লক্ষ্মীপুরের চর আলেকজান্ডার পর্যন্ত মেঘনানদীর অববাহিকায় ১ শ’ কি.মি, ভোলার মদনপুর থেকে চরপিয়াল পর্যন্ত শাহবাজপুর শাখা নদীর ৯০ কি.মি.ভোলার ভেদুরিয়া থেকে পটুয়াখালীর চররুস্তম পর্যন্ত তেঁতুলীয়া নদীর প্রায় ১শ’ কি.মি. এবং শরীয়তপুরের নড়িয়া ভেদরগঞ্জ উপজেলার অংশে পদ্মায় ২০ কি.মি।
বরিশালের হিজলা থেকে ২২ কি.মি নতুন একটি এলাকাকে মৎস্য বিভাগ অভয়াশ্রম ঘোষণা করতে যাচ্ছে। এর পাশাপাশি চট্রগ্রাম এর মিরসরাইএলাকায় ভোলার তমুদ্দিন, পটুয়াখালীর কলাপাড়া, কক্সবাজার এলাকার কুতুবদিয়া এলাকাও ইলিশের প্রজনন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। প্রজনন মৌসুেেম এসব অভয়াশ্রম মা ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ রয়েছে।
ইলিশের উৎপাদন ও রফতানি বাড়াতে বেশ কিছু কর্মসূচি বাস্তবায়নে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে মৎস্য ও প্রাণি সম্পদ মন্ত্রণালয় । ‘ ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন ও বাস্তবায়ন’ শিরোনাম এ প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে । প্রকল্পটি নিয়ে এরইমধ্যে কয়েকদফা আন্ত:মন্ত্রণালয় সভাও হয়েছে। শিগগিরই প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদে নির্বাহী কমিটি সভায় উঠতে পারে।
জাতীয়ভাবে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে আপাতত ইলিশের জন্যে ২ শ’ ১৫ কোটি টাকা ব্যয় করা হবে। এ প্রকল্প দেশের ২৯ জেলার ১শ’ ৩৪ উপজেলায় বাস্তবায়নের কথা রয়েছে। এসব উপজেলাগুলো কোনো না কোনোভাবে ইলিশ উৎপাদন, বিপণন, প্রক্রিয়া ও বাজারজাতকরণে নিয়োজিত। এসব জেলার শতকার ২ ভাগ লোক এসব কাজে জড়িত।
জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থান ব্যবস্থা নিশ্চিতের পাশাপাশি অবৈধ জালের ব্যবহার বন্ধ করতে পারলে এবং ’মৎস্য সংরক্ষণ আইন’ কঠোর ভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব হলে ইলিশের উৎপাদন বাড়বে।
রাষ্ট্রের জাতীয় সম্পদ রক্ষায় এসব কাজেই এ অর্থ ব্যয়ের নির্দেশনা রয়েছে।
প্রসাশনের চোখকে ফাঁকি দিয়ে ওই সব অভয়াশ্রম থেকে একশ্রেণির জেলেরা জাটকা ইলিশ ধরছে। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা চাঁদপুর মৎস্য অধিদপ্তর ও নদী গবেষণা কেন্দ্রের কর্মকর্তারা বলেছেন, ‘বিদ্যমান ৫টি ইলিশের অভয়াশ্রম ব্যবস্থাপনা গতিশীল করতে বেশ কিছু কার্যক্রমে পরিবর্তন আনা হয়েছে।’
উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, জেলেদের মধ্যে ‘ আর্দশ মৎস্যজীবী গ্রাম ’ প্রতিষ্ঠা, জাটকা আহরণ কারী ৪০ হাজার জেলে পরিবারের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা, একই সঙ্গে মৎস্য সংরক্ষণ আইনের আওতায় ভ্রাম্যমাণ আদালত ও অভিযান জোরদার ইত্যাদি।
মৎস্য ও প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তারা বলেছেন, দেশে প্রতি বছর যে পরিমাণ মাছ উৎপাদন হয় তার ১১ শতাংশ আসে ইলিশ থেকে । দেশজ উৎপাদন বা জিডিপিতে ইলিশের উৎপাদন ১ শতাংশ । গত বছরে পৌনে ৫ লাখ মে. টন ইলিশ উৎপাদন হয়েছে।
চাঁদপুরে ‘ইলিশ উৎপাদন জোরদারকরণ’ প্রকল্পের পরিচালক এম এ বাশার চাঁদপুর টাইমসকে বলেন, ‘ ৩৩ কোটি টাকা প্রকল্পের অধীনে চাঁদপুরে জেলেদের প্রশিক্ষণ ও তাদেরকে সচেতন করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ, অভয়াশ্রমগুলো সার্বিক পরিস্থিতি নির্ণয়, ইলিশ গবেষণা জোরদার ও ছোট ছোট ইলিশের পেটে ডিম আসার কারণ নিরূপণ, ইলিশের বিচরণ ক্ষেত্র পরিবর্তনের কারণ নির্ণয়, জলবায়ূ পরিবর্তনের ওপর কাজ করা, ইলিশের সুষ্ঠু বাজারজাতকরণ ও মূল্য নির্ধারণ, ইলিশের ডিম ও রেণুর সঠিক পরিসংখ্যান নির্ণয় ও মজুত, ইলিশ গবেষণাগারের পরিমার্জন ও সংস্করণসহ ইত্যাদি বিষয়ে চাঁদপুরের ‘ ইলিশ উৎপাদন জোরদারকরণ প্রকল্প’ গ্রহণ করা হয়েছে।’
এ প্রকল্পটি ২০১৬-’১৭ একনেকে অনুমোদন লাভ করে এবং ২০১৭-’১৮ অর্থবছরে কাজ শুরু করে যা ২০২১-’২২ অর্থবছর পর্যন্ত কাজ চলবে।’
চাঁদপুর নদী গবেষণা কেন্দ্রের দেশের অন্যতম ইলিশ গবেষক ড. আনিসুর রহমান চাঁদপুর টাইমসকে বলেন,‘ মা ইলিশ সংরক্ষণ ও ডিম পাড়ার সুযোগ দেয়া, জাটকাকে বড় হতে সুযোগ দেয়া ও রক্ষা করা অভয়াশ্রমগুলোকে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সংরক্ষণে রাখা, জেলেদের প্রশিক্ষণ দিয়ে সচেতন করে তোলা, জেলেদের প্রশিক্ষণ দিয়ে সচেতন করা ও আইন প্রয়োগে কঠোর অবস্থানে থাকলে এবার ৫ লাখ মে.টন ইলিশ উৎপাদন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। নদীতে প্রচুর ইলিশ আছে ও ভালো অবস্থানে আছে।’
চাঁদপুর মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ও নদী কেন্দ্রের ইংরেজি গবেষণাপত্র থেকে অনূদিত আংশিত উৎস অবলম্বনে-
প্রতিবেদক- আবদুল গনি
এ সংক্রান্ত আরো প্রতিবেদন পড়ুন- বাংলাদেশি পণ্য হিসেবে জিআই স্বীকৃতি পেলো চাঁদপুরের ইলিশ
(অনুমতি ছাড়া সংবাদ কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ)