বিজয়ের ৪৯ বছরে এসে এবার স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার বাহিনীর তালিকা প্রকাশ করছে সরকার। আজ রোববার দুপুরে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রায় ১১ হাজার রাজাকারের নাম ও পরিচয় প্রকাশ করা হবে।
জানা গেছে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের তালিকা এখনও পূর্ণাঙ্গ নয়। তবে মন্ত্রণালয়ের কাছে যে তালিকা গেছে তার মধ্যে রয়েছে চাঁদপুরে ৯, মেহেরপুরে ১৬৯, শরীয়তপুরে ৪৪, বাগেরহাটে ১ ও নড়াইল থেকে ৫০ জন রাজাকারে তালিকা।
পর্যায়ক্রমে অন্য ঘাতক বাহিনীর সদস্যদের তালিকাও প্রকাশ করা হবে। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে সাড়ে আট হাজার রাজাকারের তালিকা আপলোড হয়েছে, এখনও আপলোড অব্যাহত আছে। আপলোড শেষে তালিকাটি সবার জন্য উন্মুক্ত করা হবে।
একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল এ দেশের রাজাকার, শান্তি কমিটি, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সদস্যরা। মুক্তিযুদ্ধের সময় তারা পাকিস্তানি বাহিনীকে পথঘাট চেনাতে ও মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছে। এসব বাহিনীর সদস্যরা সাধারণ বাঙালি ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিয়েছে। চালিয়েছে নৃশংস গণহত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতন।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক সাংবাদিকদের বলেন, স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী রাজাকারদের নাম, পরিচয় ও ভ‚মিকা সম্পর্কে নতুন প্রজন্মকে জানানোর জন্যই তালিকা প্রকাশ করা হবে। আশা করছি, ১১ থেকে ১২ হাজার রাজাকারের নাম ও তথ্যাদি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা যাবে।
পর্যায়ক্রমে অন্য রাজাকারদের নামও ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে। রাজাকারের তথ্য সংগ্রহের উৎস প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, একাত্তরের রাজাকার বাহিনীর সদস্য হিসেবে যারা ভাতা নিয়েছেন বা যাদের নামে অস্ত্র এসেছে, তাদের নাম-পরিচয়, ভ‚মিকাসহ তথ্যাদি স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশের গোয়েন্দা সংস্থার কাছে ছিল। সেগুলো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে সংগ্রহ করা হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কার্যপত্র (১ ডিসেম্বর) থেকে জানা গেছে, ২১ মে ১৯৭১ সালের বেতনভোগী রাজাকারদের তালিকা সংগ্রহের জন্য জেলা প্রশাসকদের কাছে চিঠি পাঠায় মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি ২৬ মে রাজাকার, আলবদর, আলশামস, শান্তি কমিটির সদস্যদের তালিকা সংগ্রহ করে তা রক্ষণাবেক্ষণে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও চিঠি পাঠানো হয়। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কাজ শুরু করে এবং জেলাভিত্তিক রাজাকারের তথ্য সংগ্রহ করে।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে ইতোমধ্যে কয়েক জেলা থেকে ৮ হাজার ৪০০ জনের নাম পাঠানো হয়। বাকি জেলা থেকেও নাম পাঠানোর কাজ চলছে। এদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া ১১ হাজার রাজাকারের তালিকা তৈরি করে পাঠানো হয়েছে। এ তালিকা থেকে নাম প্রকাশ করা হবে। ওয়েবসাইটে ৮ হাজার ৪০০ রাজাকারের তালিকা আপলোড হয়েছে। আপলোড অব্যাহত আছে। আপলোড শেষে তালিকাটি সবার জন্য উন্মুক্ত করা হবে।
অপরদিকে যেসব রাজাকার বেতনভাতা নেয়নি কিন্তু একাত্তরে খুন, ধর্ষণ, নির্যাতন ও লুণ্ঠনে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহায়তা করেছে তাদের নামসহ তালিকাও প্রকাশ করা হবে।
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এবং ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির তথ্যানুযায়ী, একাত্তরের মে মাসে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালি নিধনে পাকিস্তানি সেনাদের সহায়তা দিতে গঠিত হয় রাজাকার বাহিনী। খুলনায় খান জাহান আলী রোডের একটি আনসার ক্যাম্পে ৯৬ জন পাকিস্তানপন্থি কর্মী নিয়ে রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়। পরে দেশের অন্য অংশেও গড়ে তোলা হয় এই বাহিনী।
প্রথম পর্যায়ে রাজাকার বাহিনী ছিল এলাকার শান্তি কমিটির নেতৃত্বাধীন। একাত্তরের ১ জুন পাকিস্তানের জেনারেল টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তান রাজাকার অর্ডিন্যান্স জারি করে আনসার বাহিনীকে রাজাকার বাহিনীতে রূপান্তরিত করেন। তবে এর নেতৃত্ব ছিল পাকিস্তানপন্থি স্থানীয় নেতাদের হাতে। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ৭ সেপ্টেম্বর জারি করা এক অধ্যাদেশবলে রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের সেনাবাহিনীর সদস্যরূপে স্বীকৃতি দেয়। এর সংখ্যা ছিল অন্তত ৫০ হাজার।
এ ছাড়াও পাকিস্তান সরকার বাঙালি নিধনে একইভাবে আলবদর ও আলশামস বাহিনীও গঠন করে। তখন গ্রামগঞ্জে মেম্বারদের রাজাকার বাহিনীতে লোক সংগ্রহ করতে বলা হয়েছিল। জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম, মুসলিম লীগ, জামায়াতে ওলামাসহ পাকিস্তানের সমর্থক অনেক দলের নেতাকর্মীরা রাজাকারসহ অন্য বাহিনীতে যোগ দেয়।
তবে স্বাধীনতাবিরোধী এই বাহিনীগুলো সাধারণ অর্থে রাজাকার হিসেবেই পরিচিতি পায়। স্বাধীনতার পর থেকেই এসব বাহিনীর তালিকা প্রণয়ন ও প্রকাশের দাবি ওঠে। অবশেষে স্বাধীনতার ৪৯ বছরে এসে সেই দাবি বাস্তবায়নের পথে সরকারিভাবে কিছুটা হলেও অগ্রগতি হয়েছে। তালিকা প্রকাশের উদ্যোগ শুরু হয় ২০১৪ সালে। জানা গেছে, প্রকাশিতব্য তালিকায় পাকিস্তান সরকারের বেতনভোগী ৩৯৯ জনের নামও থাকছে।
ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘রাজাকারসহ ঘাতক বাহিনীর তালিকা প্রণয়ন ও প্রকাশের জন্য ১৯৮৫ সাল থেকে দাবি জানিয়ে আসছি। দেরিতে হলেও সেই দাবি বাস্তবায়ন হচ্ছে। এটি অত্যন্ত ইতিবাচক। তবে এখানে থেমে থাকলে হবে না। এই উদ্যোগ অব্যাহত রাখতে হবে।’