চাঁদপুরের ২৭ ভাষা সৈনিকের ৭৩ বছরেও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মেলেনি। ২৭ ভাষা সংগ্রামী কিংবা তাদের পরিবারের খোঁজ কেউ রাখেনি বিগত ৭৩ বছরেও। তাদের পরিবার ও চাঁদপুরের সর্বস্তরের মানুষ দাবী জানালেও তা বাস্তবে রুপ পায়নি।
মহান ভাষা আন্দোলনের ৭৩ বছর পেরিয়ে গেছে। ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই এসেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা রাষ্ট্রীয়ভাবে উদযাপন হয়েছে মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। অথচ কয়েকযুগ পাড় হলেও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়নি ভাষা সংগ্রামীরা। তাদের ভাগ্যে জোটেনি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কোন সংবর্ধনা বা সম্মাননা। তেমনি চাঁদপুরের ২৭ ভাষা সংগ্রামী আজও রয়ে গেছেন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির বাইরে। সর্বশেষ এ বছর মারা গেছেন ভাষা সংগ্রামী বিএম কলিম উল্যাহ।
বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তর্থ্য,ে চাঁদপুরের ২৭ জন ভাষা সংগ্রামীর নাম পাওয়া গেছে। এরা হলেন,সাবেক প্রধানমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরী, তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্রলীগের প্রথম নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক সমাজকল্যান মন্ত্রী ডা. দীপু মনির বাবা এম এ ওয়াদুদ, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক চাঁদপুর মহকুমা যুবলীগের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট এ এফ এম ফজলুল হক, ডা. মজিবুর রহমান চৌধুরী, মহকুমা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি আবুল কাশেম চৌধুরী টুনু, সাবেক কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা ও সাবেক এমপি আবদুর রব, সাবেক এমপি অ্যাডভোকেট আবদুল আউয়াল, প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক সাবেক সংসদ সদস্য আইনজীবী সিরাজুল ইসলাম, সাবেক গণপরিষদ সদস্য ও চাঁদপুর পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল করিম পাটওয়ারী, রফিক উদ্দিন আখন্দ ওরফে সোনা আখন্দ, বিএম কলিম উল্লাহ, মোল্লা ছিদ্দিকুর রহমান, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক অ্যাডভোকেট আবু জাফর মো. মাইনুদ্দিন, অ্যাডভোকেট আবুল ফজল, ড.শামছুল হক,কমর উদ্দিন চৌধুরী, সুজাত আলী মুন্সী, তৎকালীন তরুণ সংগঠক শাহ্ আমান উল্লাহ মানিক, সাবেক এমপি নওজোয়ান ওয়ালি উল্লাহ, প্রবীন রাজনীতিবিদ আইনজীবী শেখ মতিউর রহমান, ডা. এম এ গফুর, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক সাবেক এমপি ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট (অব.) এ বি সিদ্দিক, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-সভাপতি, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক শেখ মুজাফ্ফর আলী, সাবেক পৌর চেয়ারম্যান নুরুল হক বাচ্চু মিয়াজী, তৎকালীন চাঁদপুর মহকুমা ছাত্রলীগ নেতা আবুল কালাম আজাদ, ডা. আবদুস ছাত্তার, বিশিষ্ট নারী সংগঠক সাবেক এমপি আমেনা বেগম। এছাড়াও ভাষা আন্দোলনে নাম না জানা আরো অনেকে অংশ নেন বলে জানা যায়।
জানা যায়, ১৯৫২ সালে ঢাকাসহ পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিটি জেলা ও মহকুমায় মাতৃ ভাষা রক্ষায় আন্দোলন গড়ে ওঠে। যার থেকে বাদ যায়নি চাঁদপুরও। ১৯৫২ সালে চাঁদপুর শহরের আহম্মদিয়া মুসলিম হোস্টেলে (বর্তমানে চাঁদপুর সরকারি মহিলা কলেজ হোস্টেল) গোপনে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভা থেকেই গঠিত হয় ‘রাষ্ট্রভাষা বাস্তবায়ন সংগ্রাম পরিষদ চাঁদপুর মহকুমা ইউনিট’।
উপস্থিত সবার সম্মতিক্রমে ইউনিটের সভাপতি মনোনীত হন তৎকালীন ঢাকা জগন্নাথ কলেজের ছাত্রনেতা আবদুর রব। তৎকালিন কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্রনেতা সদর উপজেলাধীন রাড়িরচর গ্রামের মোল্লা ছিদ্দিকুর রহমান সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হন। এই ইউনিটের প্রিিতনিধি হিসেবে চাঁদপুরের বিভিন্ন থানায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন এরা। চাঁদপুরের তৎকালীন ৬টি থানা থেকে তাঁরা এসে এ আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগদান করে আন্দোলনকে আরও গতিশীল ও বেগবান করে তুঙ্গে নেন। তৎকালীন মুসলীম লীগ নেতাদের চরম বিরোধীতার মুখেও আন্দোলন গর্জে উঠেছিল এবং তৎকালীন পাক-পুলিশ নেতা-কর্মীদের হণ্যে হয়ে খুঁজছিলো গ্রেফতার করে জেলে ঢুকানোর জন্য। এছাড়াও তাদের মধ্যে অনেকেই সে সময় ঢাকায় কেন্দ্রীয় পর্যায়ের আন্দোলনেও সম্পৃক্ত ছিলেন।
ভাষা সংগ্রামী আ. করিম পাটওয়ারীর সন্তান জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু নঈম পাটওয়ারী দুলাল বলেন, ‘আমার বাবাসহ যারা ভাষার জন্য আন্দোলন করেছেন, তারা তো ভাষা আন্দোলন করেছেন বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য আন্দোলন করেননি। এখন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির বিষয়টি একান্ত রাষ্ট্রের ব্যাপার।’
ভাষা সংগ্রামী শেখ মুজাফ্ফর আলীর মেয়ে নুরজাহান বেগম কুমকুম বলেন, এত বছর পরেও চাঁদপুরের এই ভাষাসৈনিকদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না পাওয়া কষ্টের। আমার বাবা মৃত্যুর আগে শয্যাশায়ী থাকা অবস্থাও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির আশায় ছিলেন। কিন্তু তিনি তা পাননি। আমার বাবা ভাষার জন্য আন্দোলন করেছেন, কাজ করেছেন, তখন কিন্তু তারা এই স্বীকৃতির জন্য দ্বারে দ্বারে যাননি। মাতৃভাষার জন্য কাজ করেছেন সেটিই বড় কথা। তবে আমরা চাই, সরকার তাদের তালিকাভুক্ত করুক। আশা করি, কোন একদিন হয়তো এই মহান মানুষগুলো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিও পাবেন।’আমরা বর্তমান সরকারের কাছে সকলের রাস্ট্রীয় স্বীকৃতি চাই।
ভাষা সংগ্রামী এ এফ এম ফজলুল হকের সন্তন মো. খায়রুল আহসান সুফিয়ান বলেন, ‘সব স্বীকৃতি রাজধানীভিত্তিক। যারা মফস্বলে বেঁচে আছেন, কিংবা মরে গেছেন তাদের কোনও খবর নেই। সারাদেশে কত জন ভাষা সংগ্রামী আছেন তার তালিকা করতে হাইকোর্টের নির্দেশনা থাকলেও তার বাস্তবায়ন নেই। ভাষা আন্দোলনের মধ্যদিয়েই কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের আন্দোলন শুরু হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের মতো ভাষা সংগ্রামীদেরও মূল্যায়ন করা উচিত।’
চাঁদপুরের সর্বস্তরের জনগণের দাবী, বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভ তথা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয় ঘটে। ইতিহাসের এই অর্জনের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শনের তাগিদে দেশের অকুতোভয় ভাষা সৈনিকদেরও মুক্তিযোদ্ধাদের ন্যায় সরকারি সুযোগ-সুবিধা দেয়া একান্ত প্রয়োজন। তা না হলে আগামী প্রজন্ম দেশের সম্যক ইতিহাস সম্পর্কে সম্পূর্ণ অন্ধকারের মধ্রে থাকতে হবে।
স্টাফ করেসপন্ডেট, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪