চাঁদপুর-কুমিল্লা আঞ্চলিক মহাসড়কের কৈয়ারপুল বাস স্টপেজ থেকে তিন মাইল দক্ষিণে এলেই একটি সুন্দর দিঘির পাড়ে ৫০০ গজ দূরত্বে দুটি প্রাচীন মসজিদ। একটির নাম শাহ সুজা মসজিদ। অন্যটির নাম শাহি বা আলমগিরি মসজিদ। এখানে আমরা আলমগিরি মসজিদ নিয়ে আলোচনা করব।
আলমগিরি মসজিদটি চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ থানার অন্তর্গত অলিপুর গ্রামে অবস্থিত।
অলিপুর আলমগিরি মসজিদটি বাদশাহ আওরঙ্গজেবের শাসনামলে স্থানীয় প্রশাসক আব্দুল্লাহ কর্তৃক ১৬৯২ (১১০৪ হিজরিতে) নির্মাণ করা হয়। (বাংলাপিডিয়া ও প্রত্ননিদর্শন : কুমিল্লা, আয়শা বেগম)
১৯৬৫ সালে যখন পাক-ভারত যুদ্ধ চলে, তখন ভারতবর্ষে মুসলিম শাসকদের কীর্তিগাথা ও স্থাপিত বিভিন্ন স্থাপনা নিয়ে গ্রন্থ রচনার উদ্যোগ নেয় তৎকালীন পাকিস্তান সরকার। এর ধারাবাহিকতায়, বিস্মৃতির অতল অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসে অলিপুর নামক লোকালয়টি। সে সময় অখণ্ড পাকিস্তান সরকারের তথ্য ভাণ্ডারে অলিপুর গ্রাম বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে স্থান পায়। অলিপুর আলমগিরি মসজিদ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের নজরে আসে ১৯৬৫ সালের ৩১ বছর পর। ১৯৯৬ সালের ১৬ মার্চ আঞ্চলিক পরিচালক, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর অলিপুর এ মসজিদ সংস্কার কাজ হাতে নেয়। মসজিদের ৬০ ফুট পূর্বে রয়েছে একটি বড় পুকুর। এই পুকুরটি মসজিদ নির্মাণকারী কর্তৃপক্ষই খনন করেছিল।
সাধারণ মোগল স্থাপত্যরীতির তাৎপর্যপূর্ণ ব্যতিক্রম পরিলক্ষিত হয় এ মসজিদে। সাধারণত মোগলরা তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদই তৈরি করত। কিন্তু এ মসজিদের আছে পাঁচ গম্বুজ। মসজিদের প্রধান দরজার ওপরে স্থাপিত রয়েছে ১.১০ ফুট দীর্ঘ ও সাড়ে এগারো ইঞ্চি প্রস্থের ফারসি ভাষায় লিখিত শিলালিপি। এ শিলালিপির কয়টি লাইনের অনুবাদ হচ্ছে—(১) পরম দয়ালু ও দাতা আল্লাহর নামে (২) আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই এবং মুহাম্মদ (সা.) তাঁর নবী (৩) মহামতি সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামলে (যাঁর সুদৃঢ় প্রতিরক্ষায় অনেক রাজন্যবর্গ আশ্রয় নিত)।
মসজিদের নির্মাতা আবদুল্লাহ সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায়নি। তবে অনুমান করা হয়, তিনি একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা ছিলেন। এখানে আছে আবদুল্লাহর সমাধি।
১৯৬৫ সালের ৪ নভেম্বর পাকিস্তান সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কর্মকর্তা জনাব এ কে এম আমজাদ হোসেন ‘Concept of Pakistan’ সাময়িকীতে একটি গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ লিখেছেন। সেখানে তিনি অলিপুরের এ মসজিদকে ‘আলমগিরি মসজিদ’ হিসেবে অভিহিত করেন। আলমগিরি মসজিদের দৈর্ঘ্য ৫২.৮ ফুট ও প্রস্থ ২৯.৯ ফুট। মোগল স্থাপত্যের সাধারণ রীতি অনুযায়ী এ মসজিদের চারটি অষ্টকোণাকার মিনার রয়েছে। মসজিদের ছাদে দুই পাশে দুটি করে চারটি ছোট গম্বুজ এবং মাঝে একটি বড় গম্বুজসহ মোট পাঁচটি গম্বুজ আছে। পশ্চিম পাশের দেয়ালে তিনটি মিহরাব আছে। ইমাম মধ্যবর্তী মিহরাবে অবস্থান করে নামাজ পড়ান, সেটিই বড় এবং দুই পাশের দুটি ছোট। মসজিদের ভেতরে আছে অষ্টভুজাকৃতির দুটি বিশাল (স্থুল) স্তম্ভ (পিলার)। যেগুলোর পরিধি কমপক্ষে আট হাত। আর মসজিদের দেয়ালের পুরুত্ব প্রায় আড়াই হাত (প্রায় ৪ ফুট)। মসজিদটিতে মূলত কোনো জানালা ও ভেন্টিলেটর নেই। পূর্ব দেয়ালে তিনটি দরজা আছে। উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে দুটি করে যে চারটি দরজা ছিল সেগুলোকে বর্তমানে জানালায় রূপান্তর করা হয়েছে। মসজিদের চারদিকের দেয়ালের মধ্যে পূর্ব দেয়াল ছাড়া তিনদিকের দেয়ালই সমতল। পূর্বদিকের দেয়ালে একসময় ছিল নানা কারুকাজ।
হাজীগঞ্জ প্রতিনিধি, ১৪ ডিসেম্বর ২০২২