স্টাফ করেসপন্ডেন্ট || আপডেট: ০৯:৪১ অপরাহ্ন, ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৫, সোমবার
চাঁদপুরে ফের শিক্ষকের হাতে এক ছাত্রীকে যৌন নিপীড়নসহ সামাজিকভাবে হয়রানি করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিযুক্ত শিক্ষক প্রভাবশালী হওয়ায় স্কুল কর্তৃপক্ষ তাকে নির্দেশ প্রমাণের জন্য খোদ প্রধান শিক্ষকসহ স্থানীয় একটি কুচক্রীমহল উঠে পড়ে লেগেছে বলে অভিযোগ করে ভুক্তভোগী ছাত্রীর পরিবারটি।
চাঁদপুর সদর উপজেলার বাগাদী গণি উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী (কৃষি) শিক্ষক শামীম জমাদার একই বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর ‘ক’ শাখার ছাত্রী সুমিকে (ছদ্মনাম) দীর্ঘদিন ধরে যৌন নিপীড়নসহ অনৈতিক সম্পর্কের প্রলোভন দিয়ে আসছে। ফলে ছাত্রীটি নিরূপায় হয়ে গত ৯ সেপ্টেম্বর প্রধান শিক্ষকের নিকট লিখিত অভিযোগ দেয়। অভিযোগ পাওয়ার পর স্থানীয় একটি প্রভাবশালী মহল প্রধান শিক্ষকসহ পুরো বিষয়টি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা চালায় বলে ভুক্তভোগী পরিবারটি জানায়।
অপরদিকে বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর আরেক শিক্ষার্থী নূপুর জানায়, লম্পট শামীম স্যার প্রায়ই শ্রেণী কক্ষে মেয়েদের গালে প্রকাশ্যে চড়-থাপ্পর মারে। তার স্বভাব চরিত্র ভালো নয়। এছাড়া বেশ ক’জন শিক্ষার্থী জানায়, এ ধরনের লম্পট শিক্ষককে অবিলম্বে বিদ্যালয় হতে স্থায়ীয়ভাবে বহিস্কারসহ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নিতে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নিকট দাবি করেছে তারা। পাশাপাশি এলাকাবাসীও এ লম্পট শিক্ষকের অপসারণের দাবিতে শিক্ষার্থীদের সাথে একাত্মতা পোষণ করে প্রধান শিক্ষকের নিকট দাবি জানিয়েছেন।
সুমির অভিযোগে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলে গত ১২ সেপ্টেম্বর প্রধান শিক্ষক অভিযুক্ত শিক্ষকে সাময়িকভাবে ২৫ কার্য দিবসের জন্য বরখাস্ত করেন। প্রধান শিক্ষক কামরুল হোসেন বরখাস্তপত্রে উল্লেখ করেন, ‘ব্যবস্থাপনা কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক আপনাকে আগামি ১২ সেপ্টেম্বর হতে ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত ২৫ কার্য দিবস আপনার নিরাপত্তা ও বিদ্যালয়ের শৃংঙ্খলার স্বার্থে বিদ্যালয়ের রুটিন ওয়ার্ক হইতে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হইল।’
লম্পট শিক্ষক শামীম জমাদারকে রক্ষায় ও পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কালক্ষেপণসহ নানা চেষ্টা করার অভিযোগ রয়েছে। ফলে গত ১৮ সেপ্টম্বর ফের ওই ছাত্রীর পরিবারকে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককের কার্যালয়ে লাঞ্ছিত করা হয় বলে শিক্ষার্থীর দরিদ্র পিতা কাঠমিস্ত্রি জাহাঙ্গীর খান জানান। ফলে তিনি লাঞ্ছনার শিকার হয়ে মেয়ের পড়ালেখা বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্তে কথা জানান এ প্রতিবেদককে।
তবে এসব ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করতে প্রধান শিক্ষক কামরুল হোসেন জানান, শিক্ষার্থীর অভিযোগের ভিত্তিতে লম্পট শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এছাড়া বিদ্যালয়ের এডহক কমিটির সভাপতি শীঘ্রই একটি তদন্ত কমিটি করবেন। তারপর ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর অভিভাবককে লাঞ্ছিত করার বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি।
নিপীড়নের শিকার হওয়া শিক্ষার্থী সুমি জানান, চলিত বছর অষ্টম শ্রেণীতে উঠলে বিদ্যালয় বরাবর অবৈতনিক শিক্ষা গ্রহণের জন্য প্রধান শিক্ষকের কাছে আবেদন নিয়ে গেলে অভিযুক্ত লম্পট শিক্ষক শামীম জমাদার ছাত্রীটিকে তার নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বাগড়া বাজারের ‘প্যারাগন ইলেক্ট্রনিক্স’ শো-রুমে ডেকে পাঠান। সেখান গত ৬ মাস বিভিন্ন অজুহাতে ডেকে নিয়ে যৌন হয়রানির চেষ্টাসহ অশ্লীল কাজের জন্যে প্রস্তাব দেয়া হয় বলে সুমি লিখিত অভিযোগে উল্লেখসহ এ প্রতিবেদকে জানান।
এছাড়া লম্পট শামীম তাকে ফ্রি পড়ালেখার পাশাপাশি প্রতিদিন হাত খরচ ১শ’ থেকে ২শ’ টাকা প্রদান করা হবে বলে তকে প্রস্তাব দিয়ে শো-রুমে ও বিদ্যালয়ে প্রায়ই যৌন নিপীড়নের চেষ্টাসহ বিভিন্নভাবে লাঞ্ছিত করতে থাকে। ফলে লম্পট শামীমের অমানবিক আচরণ দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় সুমি অতিষ্ঠ হয়ে প্রধান শিক্ষক বরাবরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছে বলে জানায়।
শিক্ষার্থীর মা বেলী আক্তার জানান, লম্পট শিক্ষক শামীম জমাদার তাদের প্রতিবেশী ও বিবাহিত ব্যক্তি। এছাড়া সে এক সন্তানের জনক হওয়ার পরও আমার মেয়ের প্রতি অন্যায় আচরণ করেছে। তা কোনো শিক্ষকই করতে পারে না। সে প্রতিদিন আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে বাড়ি ও বাজারে যায় অথচ একদিনও বলেনি আমার মেয়ের বিনা বেতনে পড়ালেখার জন্যে কোনো স্বাক্ষর লাগবে। অথচ সে আমার মেয়েকে তার দোকানে নিয়ে উত্ত্যক্ত করত। তিনি এ ঘটনার বিচার চান।
শিক্ষার্থীর পিতা জাহাঙ্গীর খান জানান, লম্পট শিক্ষক শামীম জমাদার আমার মেয়ের সর্বনাশের চেষ্টা করেছে। মেয়ে বিদ্যালয়ে লিখিত অভিযোগ দিলে তার ভাই ঢাকা থেকে ফোনে জানায় যা হবার হয়েছে বিষয়টা স্থানীয়ভাবে মিমাংসা করার জন্য। তাই গত ১৮ সেপ্টেম্বর স্থানীয় প্রভাবশালীদের ম্যানেজ করে লম্পট শামীম গাজীর বাড়িতে সালিস দরবার বসায়। ওই সালিসে জাহাঙ্গীর খানের নিকটাত্মীয় নেছার গাজী, আমির ভূঁইয়া, আউয়াল পাটোয়ারী, হাসিম খানসহ বেশ ক’জনকে ম্যানেজ করে লোকদেখানো সালিস করিয়ে লম্পট শামীম ভুক্তভোগী ছাত্রীর কাছ থেকে বিদ্যালয়ে দেয়া অভিযোগটি মিথ্যা মর্মে লিখিত অঙ্গীকারনামা নিয়ে যায়।
‘সালিশ দরবার প্রসঙ্গে অবগত আছেন কি-না’Ñ জানতে চাইলে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কামরুল হোসেন জানান, শিক্ষার্থীর ভবিষৎ চিন্তা করে স্থানীয় সালিশকারীরা এই ‘ছাত্রীর বিয়ের সময় সমস্ত খরচ অভিযুক্ত শিক্ষক বহন করবে’ এমন শর্তে সমঝোতা হয়েছে বলে তিনি জানতে পেরেছেন বলে জানান।
তিনি আরো জানান, ২০১২ সালে এই শিক্ষক এ বিদ্যালয়ে যোগদান করে। তবে সম্প্রতি বেশ ক’জন শিক্ষার্থী যেহেতু তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছে তাই বিদ্যলয় পরিচালনা কমিটি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবে।
লম্পট শামীম অভিযোগ সম্পর্কে বলেন, যা হবার হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আমাদের সমঝোতা হয়েছে। এছাড়া পুরো বিষয়টি ‘হিরু মাওলানা’ জানে। প্রয়োজনে আপনি (প্রতিবেদক) হিরু মাওলানার সাথে কথা বলতে পারেন।
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর কাছ থেকে সমঝোতার লিখিত অঙ্গীকারনামা নিয়ে ১৮ সেপ্টেম্বর বিদ্যালয়ে ছাত্রীর অভিভাবকদের লাঞ্ছিত হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে শামীম জানান, এমন কোনো ঘটনা তার জানা নেই। ওইদিন বিদ্যালয়ে তারও একজন পরিবারের সদস্য উপস্থিত ছিল বলে প্রতিবেদকে মুঠোফোনে জানান।
এদিকে এলাকাবাসী জানায়, এই লম্পট শিক্ষক ২০১২ সালে অনৈতিক সুবিধার বিনিময়ে বিদ্যালয়ে চাকুরিতে যোগ দেয়। তারপর থেকেই বিভিন্ন অজুহাতে সে প্রায়’ই বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের তার বাগড়া বাজারের প্যারাগন ইলেক্ট্রনিক্স শো-রুমে ডেকে নিয়ে অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা চালিয়ে আসছে। অনেক শিক্ষার্থী সামাজিক ও পারিবারিক ইজ্জতের ভয়ে এ বিষয়ে মুখ খুলতো না।
বাগড়া বাজারের বেশ ক’জন ব্যবসায়ীর কাছে তার সম্পর্কে জানা যায়, লম্পট শামীম বাগড়া বাজারে ফরিদগঞ্জ সড়কের পাশে প্যারাগন ইলেক্ট্রনিক্স শো-রুমের নামে প্রায়, বিভিন্ন নারীর সাথে অনৈতিক সম্পর্ক সৃষ্টি করে আসছে। শো-রুমের আড়ালে এখানে তার প্রমোদবালার নিরাপদ স্থান হিসেবে বেছে নিয়েছে। ব্যবসায়ীরা তার অপকর্ম বন্ধ করতে প্রশাসনের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ কামনা করে।
এ বিষয়ে কথা হয় বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য জাহাঙ্গীর খানের সাথে। তিনি জানান, অভিযুক্ত শিক্ষককে সাময়িক বহিস্কার করা হয়েছে। এছাড়া প্রধান শিক্ষকের উপস্থিতিতে বিদ্যালয়ে ১৮ সেপ্টেম্বর ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের যে লাঞ্ছিত করা হয়েছে তা তিনি কেবলমাত্র প্রতিবেদকের কাছ থেকে শুনলেন। তাই ঘটনা সত্য হলে বিষয়টি দেখবেন বলে জানান।
তদন্ত কমিটি প্রসঙ্গে তিনি জানান, সভাপতি ঢাকা অবস্থান করায় তার কাছে অভিযোগসহ অন্য বিষয়গুলো জানানো হয়েছে। তিনি সহসাই এ বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি করে দিবেন। তখন পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
বিদ্যালয়ের সভাপতি আরিফ উল্যাহ চৌধুরীর সাথে তার মুঠোফোনে (০১৭১৩-৪৪৪৭৭) যোগাযোগ করলে তিনি সাংবাদিক পরিচয় জানতে পেয়ে এ ব্যাপারে কথা বলতে অপরাগতা প্রকাশ করে লাইন কেটে দেন।
শিক্ষার্থী নিপীড়ন প্রসঙ্গে সদর উপজেলার মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার সাইফুল হকের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, ছাত্রীর একটি অভিযোগ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পেয়েছে তা ফোনে অবগত করেছে। তবে পরবর্তীতে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে তা শিক্ষা অফিসকে অবগত করেনি বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
জেলা মধ্যমিক শিক্ষা অফিসার সফিউদ্দিন আহম্মেদ জানান, এ বিদ্যালয়ের কোনো অনৈতিক ঘটনার খবর তার জানা নেই। তবে কোনো অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
পুলিশ সুপার সামছুন্নাহার জানান, বাগাদী গণি উচ্চ বিদ্যালয় সহকারি শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রীর যৌন নিপীড়নসহ অনৈতিক ঘটনার কোনো অভিযোগ তিনি পাননি। যদি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারটি লিখিত অভিযোগ দেয় তাহলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এছাড়া যেহেতু আপনাদের মাধ্যমে (প্রতিবেদক) আমি জানতে পেরেছি, তাই আমি শিক্ষার্থীর সাথে কথা বলে খোঁজ-খবরসহ আইনগত প্রদক্ষেপ গ্রহণ করবো।
প্রসঙ্গত, চাঁদপুর সদর উপজেলার বাগাদী গণি উচ্চ বিদ্যালয়টি অনেকটাই অভিভাবকহীন হওয়ায় প্রতিষ্ঠানটি তার অতীত সুনাম হারাতে বসেছে। কারণ হিসেবে এলাকাবাসী বলছে প্রতিষ্ঠানটি স্থানীয় চৌধুরী বাড়ির লোকজন প্রতিষ্ঠা করেছে। তারপর থেকে চৌধুরী পরিবার বংশ পরস্পরায় বিদ্যালয়ের সভাপতি ও দাতা সদস্যের পদে রয়েছে। ফলে চৌধুরী পরিবারটি ঢাকায় অবস্থান করায় স্থানীয় কুুচক্রী মহল বিদ্যালয়টি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। সম্ভ্রান্ত এই চৌধুরী পরিবারকে ব্যবহার করে দীর্ঘদিন ধরে মহলটি নিয়োগ বাণিজ্যসহ অনিয়ম-দুর্নীতি করে আসছে।
চাঁদপুর টাইমস : প্রতিনিধি/ এমআরআর/২০১৫
Chandpur Times | চাঁদপুর টাইমস Top Newspaper in Chandpur