Thursday, April 09, 2015 01:15:39 PM
চাঁদপুর টাইমস ডট কম :
চাঁদপুরের বিভিন্ন উপজেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে সিলেবাস বাণিজ্যের শিকার হয়েছে প্রাথমিকে পড়ুয়া ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা। প্রথম শ্রেণী থেকে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত ২/১জন বাদে সকল শিক্ষার্থীকে কিনতে হয়েছে এই সিলেবাস। সিলেবাসের গায়ে চাঁদপুর জেলা লিখা ছাড়া প্রকাশক বা কারা এটি তৈরি করেছে তার কিছুই লিখা নেই।
তবে অন্য একটি সূত্রে জানা গেছে, জেলা থেকে সংশ্লিষ্ট উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসগুলো সাড়ে ৩ টাকা করে এই সিলেবাস ক্রয় করেছে। আর এই সিলেবাস বিদ্যালয়গুলো ১০ টাকার কমে বিক্রি করেনি।
দেখা গেছে যে, এ সিলেবাসে প্রকাশক রচনাকারী কিংবা প্রকাশনী সংস্থার কারো নাম নেই। এমন কি এর দাম উল্লেখ নেই। কিছু শ্রেণীর সিলেবাস রঙ্গিন আবার কিছু সাদা কাগজে ছাপানো। এর উপরের মলাটে ‘শুধুমাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয় সমূহের সাময়িক ও বার্ষিক পরীক্ষার নম্বরসহ অধ্যায় বিভাজন ২০১৫’ বড় করে একটি বঙ্রে ভেতরে ‘চাঁদপুর জেলা’ লিখা রয়েছে। নিচে আরেকটি বঙ্ দেয়া আছে যেটি শিক্ষার্থীদের পরিচিতি লিখার ঘর।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে বিদ্যালয় প্রধান কিংবা ক্লাস শিক্ষকের কাছ থেকে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে নির্দিষ্ট টাকার বিনিময়ে সিলেবাস কিনতে হয়েছে। জেলা অফিস থেকে হাজীগঞ্জ উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস ৬ টাকায় আর চাঁদপুর সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস এই সিলেবাস ৫ টাকা দরে প্রতিটি বিদ্যালয়ে বিক্রি করেছে। আবার এই সিলেবাস বিদ্যালয়ের প্রধানগণ কিংবা ক্লাস শিক্ষকগণ শিক্ষার্থীদের নিকট ১০ থেকে ১৫ টাকায় বিক্রি করেছেন। বিনামূল্যে কোনো শিক্ষার্থী এখনো সিলেবাস পায়নি বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
হাজীগঞ্জ উপজেলার ছয়ছিলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫ম শ্রেণীর শিক্ষার্থী তুষার (রোল-২৯), মেহেদী হাসান (রোল- ১৭) ও রবি শঙ্কর (রোল ১৯) জানায়, তাদের হেড স্যার থেকে ১২ টাকা করে সিলেবাস তারা কিনেছে। এই বিদ্যালয়ের ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা ১২ টাকা করে সিলেবাস কিনলেও ১ম এবং ২য় শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা ১০ টাকা করে সিলেবাস কিনেছে বলে জানা গেছে।
পার্শ্ববর্তী রাধাসার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫ম শ্রেণীর সুমাইয়া (রোল- ২৭), রাকিবুল (রোল-২) ও ৪র্থ শ্রেণীর ফয়সাল (রোল-২৯) জানায়, তারা ১০ টাকা করে এই সিলেবাস কিনেছে।
একই উপজেলার সন্না সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫ম শ্রেণীর তাবাসুম (রোল-৩), সাকিবুন নাহার (রোল-৮), ৪র্থ শ্রেণীর মাহি আক্তার (রোল-১) ও মাহিন (রোল-২) জানায়, তারা তাদের শিক্ষক থেকে ১৫ টাকা করে সিলেবাস কিনেছে।
ছয়ছিলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মোঃ আঃ কাদের জানান, আমাদের বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অনুযায়ী সিলেবাস কিনে আনতে হয়েছে। আরেক প্রশ্নে এই শিক্ষক বলেন, ৬ টাকা করে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস এই সিলেবাস আমাদের দিয়েছে। তবে অবিক্রিত রয়ে গেছে বেশ কয়েকটি।
উপজেলা থেকে ৬ টাকা করে সিলেবাস কিনে ১৫ টাকায় বিক্রির বিষয়ে সন্না সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আমেনা বেগম জানান, অনেককে বিনামূল্যে দিতে হবে। অনেকে আবার কিছুটা কম দেয়।
চাঁদপুর সদর উপজেলার মনিহার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫ম শ্রেণীর শিক্ষার্থী সজিব (রোল-১১), মাহবুব আলম (রোল-৫) ও মেহরাজ (রোল-৫) জানায়, তাদের ক্লাসের আপার কাছ থেকে ১০ টাকা করে তারা এই সিলেবাস কিনেছে।
টাকা না থাকার কারণে এখনো সিলেবাস কিনতে পারেনি একই ক্লাসের মিরাজ (রোল-৩০)। একই বিদ্যালয়ের ১ম শ্রেণীর তানজিনা ও নাসরিনসহ সকলেই ১০ টাকা করে সিলেবাস কিনেছে বলে ক্লাসে তারা চিৎকার করে বলেছে।
একইভাবে সদর উপজেলার ৪৭নং উত্তর কামরাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২য় শ্রেণীর নাদিয়া (রোল- ২), সানজিদা (রোল-১)সহ সকলে ১০ টাকা করে স্যারদের কাছ থেকে সিলেবাস কিনেছে।
মনিহার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা ফরিদা আক্তার জানান, উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস থেকে আমাদেরকে ৫ টাকা করে এই সিলেবাস দিয়েছে। এ ছাড়া এই সিলেবাসের সাথে ৩শ’ টাকা করে ৬শ’ টাকা দাম ধরে দুটি বই বাধ্যতামূলকভাবে দিয়েছে। তাই খরচ পুষিয়ে নেয়ার জন্যে আমরা একটু বেশি দামে এই সিলেবাস বিক্রি করেছি।
এ সিলেবাসের বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাজীগঞ্জের একটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জানান, বইয়ের চাহিদা অনুযায়ী উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস আমাদেরকে সিলেবাস দিয়েছে। শিক্ষার্থীরা সিলেবাস ক্রয় করুক বা না করুক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অনুযায়ী এই সিলেবাস কিনতে হয়েছে।
এ বিষয়ে চাঁদপুর সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নাজমা বেগমের সাথে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমি রিলেটেড নই। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস থেকে উপজেলা সহকারী শিক্ষা অফিসারগণের (এটিও) মাধ্যমে এই সিলেবাস বিক্রি করা হয়েছে। এর বাইরে আমি কিছুই বলতে পারবো না।
নির্ভরযোগ্য বেশ কজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এই সিলেবাস উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসগুলো ৩.৫০ টাকা করে জেলা থেকে ক্রয় করে এনেছে।
অপরদিকে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসগুলো এই সিলেবাস সরাসরি বিদ্যালয় প্রধানদের কাছে বিক্রি করেছে বলে বেশ কজন প্রধান শিক্ষক জানিয়েছেন।
হাজীগঞ্জ উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুল আউয়াল সিলেবাসের বিষয়টি পাশ কাটিয়ে বলেন, এটা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস থেকে দিয়েছে না জেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি থেকে দিয়েছে তা আমি বলতে পারবো না।
চাঁদপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি হাফেজ আহম্মদের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এটা আসলে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস কিংবা শিক্ষক সমিতি কেউ করেনি। তবে জেলার বেশ কজন ভালো ট্রেনার এবং আমরা একসাথে বসে একটি সিলেবাস তৈরি করে ছাপাখানায় দিয়ে দেই। সেই ছাপাখানার খরচ ৫ টাকা ধরে সংশ্লিষ্ট উপজেলাগুলো ছাপাখানা থেকেই সিলেবাস নিয়ে গেছে।
সিলেবাসের বিষয়ে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ আক্তার হোসেন বলেন, সিলেবাস বিষয়ে আমার অফিসের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। বাচ্চাদের এবং অভিভাবকদের চাহিদা অনুযায়ী উপজেলাগুলোতে সিলেবাস করে থাকে। এর ছাপা খরচ বাবদ শুধু সামান্য পরিমাণ ফি নেয়ার কথা। তবে ৫ টাকার উপরে নেয়া বাঞ্ছনীয় নয়। এখানে ব্যবসা কোনো উদ্দেশ্য নয়। বাচ্চাদের কাছে একটি সিলেবাস থাকলে ভালো হয়। এক্ষেত্রে অতিরিক্ত অর্থ আদায় অবশ্যই অন্যায়। বিষয়টি যখন জানলাম আমি এ ব্যাপারে খোঁজ খবর নেবো।
চাঁদপুর টাইমস : এমআরআর/২০১৫