জাতীয়

গা শিউরে উঠার সে ভয়াল ২৪ এপ্রিল আজ

২৪ এপ্রিল, ২০১৩। সকাল থেকেই সূর্য বেশ তেঁতে ছিল। বিএনপি ও বিশ দলীয় জোটের ডাকা হরতালের গরম নেই। সড়কে যান চলাচল পচাঁত্তর শতাংশের বেশিই ছিল। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, গণজাগরণ মঞ্চ, হেফাজতে ইসলামের হাঁকডাক, সব মিলিয়ে রাজনীতির উত্তাপ তখন বাংলাদেশে।

তবে সেদিনের ভোরটা অন্যদিনের মতো হলেও বেলা শুরু হতেই সকাল ৯টার দিকে অনলাইনে চোখ বুলিয়ে বা টিভি স্ক্রিনে তাকিয়ে থমকে ওঠে দেশবাসী। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখেন, সাভারে রানা প্লাজা নামে একটি গার্মেন্টস ভবন ধ্বসে পড়ে আছে আরেকটি ভবনের উপর। ভবনটির ভেতরে হাজারের ওপর মানুষ ছিলেন কর্মরত।

রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়া শ্রমিকের আর্তনাদে ভারী হয়ে ওঠে সাভার। থমকে দাঁড়ায় পুরো জাতি, শিউরে ওঠে পুরো দুনিয়া!

সকাল ১০ নাগাদই চারিদিকে চাউর হয়ে যায় খবর। উদ্ধার কাজে দমকল বাহিনী, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী এবং সামরিক বাহিনীর সঙ্গে হাত মেলায় স্থানীয়রা। আহত ব্যক্তিদের উদ্ধার করতে ঝুঁকি নেন স্বেচ্ছাসেবকরা। বের হয়ে আসেন অনেক শ্রমিক। তাদের কারো হাত নেই, কারো পা কেটে বের করে আনা হয়েছে, কারো মাথা থেঁতলে গেছে, কোমর ভেঙে গেছে। জরুরি রক্তের হাহাকার শুনে ছুটে যায় সর্বস্তরের মানুষ। বিরোধী দলও হরতাল বাতিল করে। জরুরি সাহায্যের জন্যে এগিয়ে আসে পুরো জাতি।

আহত ব্যক্তিদের নিয়ে যাওয়া হয় এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। কলেজের ছাত্ররা সাহায্যের জন্যে নিজেদের মেলে ধরেন। আহতের চিৎকারে ভারী হয়ে থাকে চারপাশ। এনাম মেডিকেলের পেছনের আঙিনায় চাটাইতে বিছিয়ে রাখা হয় লাশের সারি। সেদিন সব লাশের স্বজনেরা এসেও পৌঁছেনি।

দিন পেরিয়ে যায়। এনাম মেডিকেল কলেজে আর লাশের সংকুলান হয় না, লাশের লাইন ছুটে যায় অধরচন্দ্র স্কুলে। দিন, সপ্তাহ পেরিয়ে গেলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে উদ্ধার অভিযানে দীর্ঘ সময় প্রয়োজন। গ্রাম থেকে ছুটে হতাহত শ্রমিকদের পরিবারের সদস্যরা। লাশের চেহারা দেখে চেনা যায় না। মেয়ের কানের দুল, হাতের বালা দেখে চেনার চেষ্টা করেন বাবা-মা। মায়ের চুল দেখে, কাপড়ের কোনা দেখে চেনার চেষ্টা করে সন্তান। বাবার খোঁজে রানা প্লাজার সামনে দিনের পর দিন ঠাঁয় দাড়িয়ে থাকে শিশু সন্তানরা। এক হাতে সন্তানের ছবি নিয়ে আরেক হাতে চোখের জল মোছেন বাবা-মা।

অধরচন্দ্র স্কুল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, এনাম মেডিকেলে নিখোঁজ ভাইয়ের, বোনের ছবি টানিয়ে রাখেন স্বজনরা। কেউ যেন খুঁজে পেলে জানায়। তারপরও মন মানে না। নিজেরাও খুঁজতে থাকেন। এক সময় চোখের জল ফুরিয়ে আসে। ক্ষুধার্ত পেটে বা বন রুটি চিবিয়ে রাত কাটে স্কুলের মাঠে। গাড়িতে করে লাশ আনলেই ছুটে যান সেখানে। হারিয়ে যাওয়া সন্তানের মৃতমুখ না দেখে আবারও এসে বসেন অভিভাবকরা।

ভবনের বিম সরিয়ে, কংক্রিটের স্তূপ থেকে লাশ বের করে আনা কঠিন হয়ে পড়ে। ভবনটি পূর্ব দিকে ঝুঁকে পড়ার সম্ভাবনাও তৈরি হয়। সতর্কতার সঙ্গে পরিচালিত হয় উদ্ধার অভিযান। ভেতরে জমে থাকা লাশগুলোতে পচন ধরে। বাতাসে সেই দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে আশেপাশের কয়েকশো মিটার এলাকায়।

উদ্ধার অভিযানে যাওয়া স্বেচ্ছাসেবকরাও মৃত্যু ঝুঁকিতে পড়েন। ভেতরে উদ্ধার করতে যেয়ে আটকে থাকাদের ভয়াবহ অবস্থা দেখে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন অনেকে। পড়ে এই স্বেচ্ছাসেবকদের অনেককে বিদেশেও চিকিৎসার জন্যে পাঠানো হয়।

মাসব্যাপী অভিযানে উদ্ধার কাজ শেষ হয়, সরকারি হিসেবে এক হাজার ১৩৫ জন শ্রমিকের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। আহত শ্রমিকের সংখ্যা, নিখোঁজের সংখ্যা এখনও নিশ্চিত নয়।

ভবনের মালিক রানার বিরুদ্ধে মামলা হলে সে সময়ই নাটকীয়ভাবে তাকে আটক করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।

বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এসেই তৈরি পোশাক খাতে এক বিপ্লবী যাত্রায় রথ ভাসায় বাংলাদেশের শ্রমিকেরা। ইউরোপ-আমেরিকাসহ উন্নত দেশগুলোর বাজারে পৌঁছে যায় বাংলাদেশের তৈরি পোশাক। লাখ লাখ ছেলে-মেয়ে গ্রাম থেকে উপশহরগুলোতে এসে ওঠে।

গড়ে ওঠে দৈর্ঘ্য আর প্রস্থে বিশাল আকৃতির সব তৈরি পোশাকের কারখানা। একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের গোড়াতেই হাজারেরও ওপর গার্মেন্টস শ্রমিকের এই মৃত্যুর মিছিল সব কিছুকেই উল্টে-পাল্টে দেয়। শতাব্দীর অন্যতম মৃত্যুর মিছিল রচিত হয় সাভারে।

নিউজ ডেস্ক
আপডেট, বাংলাদেশ সময় ৩: ০০ এএম, ২৪ এপ্রিল ২০১৭, সোমবার
ডিএইচ

Share