গরম বাড়তেই রমজানে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের আশ্বাস উবে গেছে। গত কয়েক দিন গ্রামাঞ্চলে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। ইফতার ও সেহরির সময়ও বিদ্যুৎ থাকছে না। একবার গেলে টানা দুই ঘণ্টা বিদ্যুৎ আসছে না । প্রচণ্ড গরমে বারবার বিদ্যুৎ বিভ্রাটে জনজীবন জেরবার। বিঘ্নিত হচ্ছে সেচসহ স্বাভাবিক কার্যক্রম।
দেশজুড়ে এখন মৃদু তাপপ্রবাহ চলছে। চলতি সপ্তাহে তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠেছে। আবহাওয়ার পূর্বাভাস বলছে, আগামী কয়েক দিন তাপমাত্রা আরও বাড়তে পারে। এ অবস্থায় পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে বিতরণ কোম্পানিগুলো। তাদের ভাষ্য, এলাকাভেদে চাহিদার তুলনায় ৩০ থেকে ৫০ ভাগ বিদ্যুৎ কম মিলছে। বাধ্য হয়ে লোডশেডিং দিতে হচ্ছে। সরবরাহ না বাড়লে সামনে ভোগান্তি আরও বাড়বে।
পাওয়ার গ্রিড কোম্পানির (পিজিসিবি) তথ্যমতে, এখন বিদ্যুতের চাহিদা প্রায় ১৬ হাজার মেগাওয়াট, যা সামনে বেড়ে সাড়ে ১৭ হাজার হতে পারে। তবে গত দু-তিন দিন সর্বোচ্চ উৎপাদন হয়েছে ১৪ হাজার মেগাওয়াট। যদিও উৎপাদন সক্ষমতা ২৬ হাজার মেগাওয়াট। জ্বালানি সংকটের কারণে চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন করতে না পারায় লোডশেডিং করতে হচ্ছে। গ্যাস সরবরাহ না বাড়লে সামনে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
পিজিসিবির তথ্য অনুসারে, বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টায় সারাদেশে দেড় হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং ছিল। সন্ধ্যার পর বিদ্যুতের চাহিদা বাড়তে থাকে। সঙ্গে বাড়ে লোডশেডিং। বিতরণ কোম্পানিগুলোর সূত্র জানায়, পিক সময়ে (সর্বোচ্চ চাহিদা) দেশে প্রায় আড়াই হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং দিতে হচ্ছে। পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) ঘাটতি সবচেয়ে বেশি। এ জন্য গ্রামগঞ্জে লোডশেডিংও বেশি। বিশেষ করে ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, শেরপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম ও রংপুরে বেশি লোডশেডিং। কিছুটা স্বস্তি বরিশাল বিভাগে।
এ ব্যাপারে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, গ্যাস সরবরাহ কমে যাওয়ায় উৎপাদনে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। গ্যাস সংকটে ১ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট উৎপাদন কম হয়েছে। দু-এক দিনের মধ্যে পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে বলে জানান তিনি।
বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে দিনে অন্তত ২৩২ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা থাকলেও সরবরাহ হচ্ছে ১০০। পেট্রোবাংলার কাছে গ্রীষ্মের জন্য অন্তত ১৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাস চেয়েছে পিডিবি। দেশে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা ১২ হাজার ২২৬ মেগাওয়াট। সরবরাহ কম থাকায় গড়ে সাড়ে ৫ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন হচ্ছে।
তেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা ৬ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। খরচ বেশি বলে এগুলো কম চালানো হয়। তবে গরমে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় চালানো হচ্ছে এসব কেন্দ্রও। এতে পিডিবির খরচ বেড়ে গেছে। তবে এখানেও রয়েছে জ্বালানি সংকট। বেসরকারি খাতের তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো তেল আমদানির জন্য পর্যাপ্ত ডলার পাচ্ছে না। পিডিবির কাছে বড় অঙ্কের বকেয়া পড়েছে তাদের।
পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, এখন দিনে ২৬৪ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। এর মধ্যে এলএনজি থেকে ৬০ কোটি ঘনফুট মিলছে। একটি এলএনজি টার্মিনাল বন্ধ থাকায় কমপক্ষে ২৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস কম পাচ্ছে। এ টার্মিনাল চালু হলে গ্যাস সরবরাহ বাড়তে পারে। গত মাসে সামিটের টার্মিনালটি চালুর কথা থাকলেও গ্যাস সরবরাহ এখনও শুরু করেনি।
খুলনায় বিঘ্নিত কাজকর্ম
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলায় লোডশেডিং বেড়েছে। রমজানে মানুষ অতিষ্ঠ এবং ঈদ ঘিরে স্বাভাবিক কাজকর্ম বিঘ্নিত হচ্ছে। এ অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহের দায়িত্বে থাকা ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি জানিয়েছে, গত বুধবার রাত ৯টায় চাহিদার ৬৭৫ মেগাওয়াটের বিপরীতে সরবরাহ ছিল ৫৯২। নগরীর ক্লে রোডের পাঞ্জাবি দোকানের মালিক সোলায়মান শেখ বলেন, গত দু-তিন দিন ধরে প্রতি রাতেই দুই থেকে তিনবার লোডশেডিং হচ্ছে। বেচাকেনা করা যাচ্ছে না। ডুমুরিয়ার সাজিয়াড়া গ্রামের কৃষক নোয়াব আলী সরদার বলেন, ২৪ ঘণ্টায় পাঁচ থেকে ছয়বার বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ গেলে ঘণ্টার বেশি থাকছে।
অতিষ্ঠ ফরিদপুরের জনজীবন
গত এক সপ্তাহ ধরে অব্যাহত লোডশেডিংয়ে ফরিদপুর পৌরবাসী ক্ষুব্ধ। পৌরসভার আলীপুর মহল্লার গৃহিণী রমা খান বলেন, ভ্যাপসা গরমে লোডশেডিং জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। সময়মতো রান্না করতে পারছি না। সেহরি ও ইফতারি দূরে থাক, ঠিকঠাক ইবাদতও করতে পারছি না। সবচেয়ে কষ্ট পাচ্ছে শিশুরা। অসুস্থ হয়ে পড়ছে তারা। পড়ালেখা করতে চাচ্ছে না।
ওজোপাডিকো ফরিদপুরের বিক্রয় ও বিপণন বিভাগ-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী আমিনুর রহমান বলেন, কোমরপুর গ্রিডে চাহিদা ৬৫ মেগাওয়াট হলেও পিক আওয়ারে মিলছে ৪০-৪৫। শুধু শহরেই প্রয়োজন ২১ মেগাওয়াট। বাধ্য হয়ে লোডশেডিং দিতে হচ্ছে।
বগুড়ায় গরমের সঙ্গে পাল্লা লোডশেডিংয়ের
বগুড়ায় অঞ্চলভেদে দিনে ২ থেকে ৪ ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। চাহিদার তুলনায় এ জেলায় ১০ থেকে ৩০ শতাংশ ঘাটতি থাকছে। বগুড়া পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ এর সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার আমজাদ হোসেন বলেন, চাহিদা ৮০ মেগাওয়াট। সরবরাহ মিলেছে ৬৫ থেকে ৭০ মেগাওয়াট। দিন-রাতে ১৫ শতাংশ সময় লোডশেডিং করতে হচ্ছে।
নওগাঁয় ব্যাহত সেচ
এক সপ্তাহ ধরে নওগাঁর ১১ উপজেলায় দিনের অর্ধেক সময় বিদ্যুৎ থাকছে না। নওগাঁ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ ও সমিতি-২ সূত্রে জানা গেছে, চাহিদার তুলনায় প্রায় ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ সরবরাহ কম পাওয়া যাচ্ছে। নওগাঁ সদরের সরাইল শিকারপুর এলাকার কৃষক দেওয়ান আব্দুস সালাম বলেন, গভীর নলকূপে এক বিঘা জমিতে সেচ দিতে চার ঘণ্টা লাগছে। ভোর ৪টায় সেচ শুরুর পর ৮টার মধ্যে দু’বার বিদ্যুৎ গেছে। ধান পাকতে মাসখানেক লাগবে। এভাবে লোডশেডিং হলে আবাদ করা কষ্টকর হবে।
সিলেটে ৫১ ভাগের বেশি লোডশেডিং
সিলেটের বিভিন্ন উপজেলায় এখন ১৫-২০ ঘণ্টাই বিদ্যুৎ থাকে না। তিনটি কেন্দ্র বন্ধ থাকায় এ অঞ্চলে লোডশেডিং বেড়েছে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল কাদির সমকালকে জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার সিলেটে ৫১ ভাগের ওপর লোডশেডিং করা হয়েছে। ঈদের কেনাকাটা শুরুর পর লোডশেডিংয়ের কারণে ব্যবসায় ব্যাঘাত ঘটছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। ভবনে আগে জেনারেটর চালাতে ২০-৩০ লিটার ডিজেল লাগলেও এখন ৬০-৮০ লিটার লাগছে বলে জানিয়েছেন ব্লু-ওয়াটার শপিং সিটির সহকারী ব্যবস্থাপক সংকর দাস।
বরিশালে এক-তৃতীয়াংশ লোডশেডিং
গত রোববার থেকে লোডশেডিং বরিশালবাসীর জীবনকে অসহনীয় করে তুলেছে। মঙ্গলবার বিভিন্ন এলাকায় কমপক্ষে ১০ বার বিদ্যুৎ বিভ্রাট হয়েছে। বুধবার দিনে কিছুটা উন্নতি হলেও বৃহস্পতিবার আবার একই দুর্ভোগে পড়েন নগরবাসী। ওজোপাডিকোর বরিশাল সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আব্দুল মজিদ বলেন, বরিশাল ও ঝালকাঠী জেলায় চাহিদার চেয়ে ৩০ ভাগ কম বিদ্যুৎ পাচ্ছেন। ফলে লোডশেডিংয়ে বাধ্য হচ্ছেন।
কুমিল্লায় গড়ে ৩০ শতাংশ বিদ্যুৎ ঘাটতি
কুমিল্লা জেলা সদরে অন্তত ৭ থেকে ৮ বার লোডশেডিং হচ্ছে। তবে উপজেলা পর্যায়ে দিনের অর্ধেক সময় বিদ্যুৎ থাকছে না। কুমিল্লা নগরীতে বুধবার বিকেল ৫টা থেকে বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টা পর্যন্ত ৮ বার লোডশেডিং হয়েছে। লোডশেডিংয়ে হাসপাতালগুলোতে ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসা কার্যক্রম।
চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহে ৮ ঘণ্টার লোডশেডিং
ময়মনসিংহ নগরীতে লোডশেডিং কম হলেও উপজেলা পর্যায়ে অবস্থা ভয়াবহ। ৮ ঘণ্টার ওপর লোডশেডিং হচ্ছে। বুধবার বিকেল ৫টা থেকে বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টা পর্যন্ত গড়ে ৮ ঘণ্টা লোডশেডিং হয়েছে বলে জানিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড চট্টগ্রাম দক্ষিণ অঞ্চলের (বিতরণ) তথ্য অনুযায়ী, জেলায় বিদ্যুতের চাহিদা প্রায় ১ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট। বিপরীতে পাওয়া যাচ্ছে ১ হাজার থেকে ১০০। ফলে লোডশেডিং হচ্ছে ২০০ মেগাওয়াটের বেশি। রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও কক্সবাজারে তিন-চার ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের তথ্য জানা গেছে।
লক্ষ্মীপুরের রামগতিতে দিনে ১০-১৫ বার বিদ্যুৎ যাওয়া-আসা করায় সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীরা পড়েছেন বিপাকে। স্থানীয় বিদ্যুৎ অফিসের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (ডিজিএম) রেজাউল করিম জানান, ১৪ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে মিলছে ৫ থেকে ৬। ফলে বাধ্য হয়ে লোডশেডিং দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হচ্ছে। (সমকাল)
চাঁদপুর টাইমস ডেস্ক/ ৫ এপ্রিল ২০২৪