খেলাধুলা

ক্রিকেট আমাদের স্বপ্নের নাম

এবার বাংলাদেশে আসার পর ঘটনাচক্রে আমাকে মোটর সাইকেলে চড়তে হলো। চলতে চলতে আমার যিনি চালক, তিনি বললেন, ‘স্যার, এই বাংলাদেশের ক্রিকেটের আজ এত রমরমা, এই সব কিন্তু আপনাদের সেই আইসিসি ট্রফি থেকে শুরু হয়েছে।’

কথাটা শুনে ভালো লাগল। মানুষ এখনো সেই ১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফি জয়ের কথা মনে রেখেছে। সেটা ছিল আমাদের ক্রিকেটে আরেকটা ধাপ পার হওয়ার গল্প। আমাদের জাতীয় প্রেরণা হয়ে ওঠার গল্প। তবে ক্রিকেটকে যদি আমাদের জাতীয় স্বপ্নের কথা বলি, সেটা শুরু হয়েছে আরও আগে থেকে।

একটা ক্রিকেট খেলুড়ে দেশ হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে বড় শর্ত হলো, খেলাটার প্রতি ওই দেশের মানুষের ভালোবাসা থাকতে হবে। সেই ভালোবাসা আমাদের এখানে সেই আদিকাল থেকে ছিল। ভালোবাসার কখনো অভাব ছিল না। স্বাধীনতার পর এই দেশের কিছু পাগল ক্রিকেটভক্ত মানুষ খেলাটা নিয়ে উঠেপড়ে লাগলেন। ক্লাব সংস্কৃতি আরও জোরদার হলো। তারই ধারাবাহিকতায় আমরা আইসিসি ট্রফি খেলা শুরু করলাম।

আমাদের বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্নটা জোরদার হয়ে উঠল ১৯৯৪ সালে। সে-বারই সুযোগ ছিল আমাদের বিশ্বকাপ খেলার ছাড়পত্র পাওয়ার। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই আইসিসি ট্রফিতে ব্যর্থ হলাম আমরা। সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা ১৯৯৭ সালের জন্য প্রস্তুত হলাম। গর্ডন গ্রিনিজের মতো কোচ আনা হলো আমাদের জন্য। ফলাফল তো সবার জানা। সেই এক বলে এক রান নিয়ে আইসিসি ট্রফি জয় করলাম এবং এর আগেই সেমিফাইনালে আমরা নিশ্চিত করলাম বিশ্বকাপ খেলা।

গর্বের সাথে বলতে চাই, বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম অধিনায়ক হিসেবে গিয়েছিলাম আমি। সেই ধারাবাহিকতায় আমরা টেস্ট স্ট্যাটাস পেলাম। বলতে ভালো লাগে যে, সে সময় কর্মকর্তারা দারুণ পরিকল্পনা করতে পেরেছিলেন, স্বপ্ন দেখতে পেরেছিলেন। যার ফলে আমরা টেস্ট স্ট্যাটাস পেলাম।

হ্যাঁ, শুরুর কয়েকটা বছর আমাদের একটু হোঁচট খেতে হয়েছে টেস্ট অঙ্গনে বা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। কিন্তু সেসব পর্ব পার করে বাংলাদেশ এখন ক্রিকেটে এক পরাশক্তি হয়ে উঠেছে। এই পরাশক্তি হয়ে ওঠার পথটা সোজা ছিল না। প্রথমে আমাদের ওয়ানডে-তে উন্নতি করতে হয়েছে আস্তে আস্তে।

২০০৪ সাল পর্যন্ত ওয়ানডেতে আমরা জয়ই পাচ্ছিলাম না সেভাবে। এরপর আমরা আস্তে আস্তে জিম্বাবুয়ের মতো দলকে হারাতে শিখি। একসময় ভারত, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, শ্রীলঙ্কাকে হারাই। মাঝে একটু পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম। কিন্তু সেই ওয়ানডে দলের ধারাবাহিকতায় একসময় আমরা ওয়ানডে-তে বড় দল হয়ে ওঠি। ২০০৭ বিশ্বকাপে ভারতকে হারিয়ে আমরা দ্বিতীয় পর্বে যাওয়ার ভেতর দিয়ে সেটার ইঙ্গিত দিয়েছিলাম। এরপর আমরা গত বিশ্বকাপে খেলে এসেছি কোয়ার্টার ফাইনাল।

টেস্টেও আমাদের এরকম কঠিন একটা পর্ব পার হতে হয়েছে। আমি প্রথম টেস্টে সেঞ্চুরি করেছিলাম। সেই টেস্টের পারফরমেন্সকে আমরা দীর্ঘদিন ছাড়িয়ে যেতে পারিনি। এরপর মুলতান, ফতুল্লা, চট্টগ্রামে আমাদের বারবার স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে। কিছুতেই সেই স্বপ্নটা, মানে টেস্ট জয়কে হাতে নিতে পারছিলাম না। অবশেষে ২০০৫ সালে জিম্বাবুয়েকে হারানোর ভেতর দিয়ে সেটাও অর্জিত হয়েছে। এরপর আমরা ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তাদের দেশে গিয়ে তাদের হোয়াইট ওয়াশ করে এসেছি।

আমাদের এই উন্নতির ধারা কিন্তু ধরে রেখেছি আমরা। দেশের মাটিতে ২০১২ এশিয়া কাপের ফাইনাল খেলেছি আমরা। মাত্র ২ রানের জন্য জিততে পারিনি সে-বার ট্রফিটা। এরপর দেশের মাটিতে নিউজিল্যান্ডকে পরপর দু’ বার হোয়াইট ওয়াশ করেছি। এই সাফল্যের ধারা আমাদেরকে একটা ক্রিকেট জাতি হিসেবে পরিচয় এনে দিয়েছে।

বাংলাদেশ এখন ভারত, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দলকে বলে কয়ে সিরিজ হারায়। এখন বাংলাদেশ ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়াকে টেস্ট হারায়। এই বাংলাদেশ ইংল্যান্ডকে হারিয়ে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল, নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়নস ট্রফি সেমিফাইনাল খেলে। এই বাংলাদেশ পুরো জাতির জন্য এক আশা-ভরসার নাম।

বাংলাদেশে আমরা হয়তো অনেক সুযোগ-সুবিধা পাই না। নানা রকম কষ্ট সব দেশের মানুষেরই আছে। সে তুলনায় আমাদের আন্তর্জাতিক অর্জন বিভিন্ন ক্ষেত্রে কম। সেই জায়গাটায় এখন ক্রিকেট হয়ে উঠেছে আমাদের স্বপ্ন দেখার একটা দারুণ হাতিয়ার। আমি একজন সাবেক ক্রিকেটার এবং আইসিসি কর্মকর্তা হিসেবে এখন বেশিরভাগ সময় দেশের বাইরেই থাকি। সেখানে দেখতে পাই যে, কীভাবে আমাদের ক্রিকেটের কারণে দেশটাই দারুণ একটা শ্রদ্ধার জায়গায় চলে গেছে।

আমি এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলের কর্মকর্তা হিসেবে খুব জোর দিয়েছিলাম চীনের ওপর। সেখানে নিয়মিত ক্রিকেট নিয়ে কাজ করতে যেতাম। ওখানে অনেক লোক ক্রিকেট অনুসরণ করে না। কিন্তু খেলাধুলা যারা বোঝে, তারা বাংলাদেশ নামটা জানে। তারা জানে, ক্রিকেট নামে একটা খেলা আছে, যে খেলায় বাংলাদেশ এখন অনেক বড় একটা দল।

চীনে আমরা একটা কাজ করতাম, বিভিন্ন ক্রিকেট ম্যাচের ভিডিও পাঠাতাম। কোন ম্যাচের ভিডিও, সেটা আমি আর মনজু (মঞ্জুরুল ইসলাম) ঠিক করতাম। আমরা বেছে বেছে বাংলাদেশের জয়ের ম্যাচের ভিডিও অবশ্যই ওই তালিকায় রাখতাম। ওরা ওই ভিডিওগুলো দেখে খেলাটা বোঝার চেষ্টা করত। তো বাংলাদেশের জয়ের ভিডিও দেখতে দেখতে ওদের ধারণা হলো, ক্রিকেটে বাংলাদেশের চেয়ে বড় দল আর নেই। ওদের খেলাধুলার কর্মকর্তারা আমাকে বললেন, ‘বাংলাদেশ তো আসলেই অনেক বড় দল। তো আমরা সামনের গুয়াংজু গেমসে দেখব, বাংলাদেশ কেমন করে।’

সেটা ছিল ২০১০ গুয়াংজু এশিয়ান গেমসের আগের কথা। গেমস শুরু হলে আমরা টেনশনে পড়ে গেলাম—বাংলাদেশ মান রাখতে পারবে তো। কী আনন্দের কথা! বাংলাদেশ সেই গেমসে চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেল। সেই সোনা জয়ের পর চীনের লোকজন মেনে নিল, বাংলাদেশ আসলেই ক্রিকেটের অনেক বড় একটা ব্যাপার।

এই ঘটনার পর চীনে ক্রিকেট নিয়ে কাজ করাটা আমার আরও সোজা হয়ে গেল। তারা আমার সাথে কথা বলার সময় এটা মাথায় রাখত যে, আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। বাংলাদেশ মানে ক্রিকেটের অনেক বড় একটা ব্যাপার। এই যে সম্মানটা চীনে আমি পেলাম, সেটা কিন্তু ব্যক্তি আমার কারণে নয়। বাংলাদেশ নামে একটা ক্রিকেট খেলুড়ে দেশের কারণে। বাংলাদেশ ক্রিকেট খেলে বলেই আমি চীন থেকে অস্ট্রেলিয়ায় আজ এই সম্মানটা পাই।

এসিসির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আমাকে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে পাঠানো হলো। আইসিসির কর্মকর্তা হিসেবে আমি সেখানে বসি। আমাকে সব জায়গায় পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলো ‘সাবেক বাংলাদেশি অধিনায়ক’ হিসেবে। ব্যক্তি আমিনুল ইসলাম বুলবুল এখানে ব্যাপার নয়। ব্যাপার হলো, বাংলাদেশের ক্রিকেট। আমাকে ওরা আইসিসির বিভিন্ন সেমিনারে বক্তা হিসেবে ডেকে পাঠায়। সেটা যত না আমার জন্য, তার চেয়ে বেশি আমার বাংলাদেশি পরিচয়ের জন্য। তারা জানে যে, যাকে ডাকছে সে বংলাদেশ নামে নতুন পরাশক্তি একটা দেশের সাবেক অধিনায়ক।

২০১৫ সালে বাংলাদেশ যখন বিশ্বকাপ খেলতে অস্ট্রেলিয়ায় গেল, আমাকে একটা দারুণ সম্মান দিল আইসিসি। বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা ম্যাচের আগে মূল বিশ্বকাপ ট্রফি নিয়ে মাঠে ঢুকতে হলো আমাকে। শ্রীলঙ্কার বিশ্বকাপজয়ী দলের অনেক খেলোয়াড় ছিলেন ওখানে। তাদের বাদ দিয়ে আমাকে বেছে নেওয়া হলো বাংলাদেশের প্রথম বিশ্বকাপ অধিনায়ক হিসেবে। এটা প্রবাসী বাংলাদেশিদের যে কী পরিমাণে গর্বিত করেছে, সেটা বলে বোঝানোর নয়।

একটা গল্প দিয়ে শেষ করি।

কর্মসূত্রে আমাকে প্রায়শ দুবাইতে আইসিসির হেড কোয়ার্টারে যেতে হয়। একবার দুবাইতে ওরকম একটা কাজে গিয়ে কিছু বাচ্চাদের সাথে কথা বলছিলাম। আমি বাংলাদেশের শুনে একটা বাচ্চা আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি সাকিব-মাশরাফির দেশের লোক?’

আমি আনন্দে অস্থির হয়ে গেলাম। আজ এভাবেই বাংলাদেশকে চেনে সারা পৃথিবী। আমরা কোনো নেতিবাচক কারণে শিরোনামে আসি না; আমাদের পরিচয়—আমরা ক্রিকেটের পরাশক্তি। আমাদের সম্পদ আমাদের ক্রিকেট দল।

নিউজ ডেস্ক
: আপডেট, বাংলাদেশ সময় ১ : ১৫ পিএম, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৭, মঙ্গলবার
এইউ

Share