‘বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’ আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম নারী ও পুরুষকে ঠিক এভাবেই দেখেছেন। একটি সুন্দর সমাজ তথা পৃথিবী বিনির্মাণে পুরুষের পাশাপাশি নারীদের ভূমিকাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নারী এবং পুরুষের ভূমিকা আলাদা আলাদাভাবে গুরুত্ববহন করে। ফ্রান্সের প্রথম রাষ্ট্রপতি নেপোলিয়নের বিখ্যাত একটি উক্তিটি আমাদের সকলেরই কমবেশি জানা আছে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও আমি একটি শিক্ষিত জাতি দেব’।
শিক্ষার প্রসারে নারী তথা মা জাতিকে নিয়ে এমন শক্তিশালি উক্তি খুব কমই আছে। একথা সত্য যে বিশ্বের বুকে বর্তমান বাংলাদেশ নারী জাগরণে উল্লেখযোগ্য অবস্থানে রয়েছে। কিন্তু কথা হলো আমাদের সমাজ ব্যবস্থা আধৌ কি নারীদেরকে পুরুষের পাশাপাশি সমান গুরুত্বের নজরে দেখেন? নারী-পুরুষের সমান অধিকার রাষ্ট্র কতৃক স্বীকৃতি পেলেও আধৌ কী নারীরা শতভাগ সমঅধিকার পেয়েছে?
জাতিসংঘ কতৃক স্বীকৃতি পাওয়ার উন্নয়নশীল এই রাষ্ট্রে এখনও নারীরা প্রতিটি পদে পদে নানান ভাবে বঞ্চিত আর হয়রারির শিকার হচ্ছে। তবে অনেকটা আশার কথা হলো এই যে, গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে নারী শিক্ষার হার প্রশংসনিয়ভাবে বেড়েছে। গত কয়েক দশক ধরে কন্যা শিশুর ব্যাপারে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে সরকারি-বেসরকারিভাবে নানান প্রচার-প্রচারণা ও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
যার ফলে প্রাথমিক শিক্ষায় কন্যা শিশুদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। এই মূহুর্তে বাংলাদেশে ছেলেদের চেয়ে মেয়ে স্কুল শিক্ষার্থীর সংখ্যাই বেশি। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নারী শিক্ষায় বর্তমানে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ একটি মডেল।
হতাশাজনক কথা-
তবে হতাশাজনক কথা হলো, বাল্য বিয়ের অশুভ থাবায় আজও এদেশের নারী শিক্ষা মরাত্মকভাবে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের হিসেব মতে, বাংলাদেশে এখনো ৫৯ শতাংশ মেয়েরই ১৮ বছর বয়স হবার আগেই বিয়ে হয়ে যায়। পরিসংখ্যান আরও বলছে যে, পৃথিবীর অনেক দেশের চেয়ে বাংলাদেশে এখনও বাল্যবিয়ে হার বেশি।
চলতি বছরের মার্চে প্রকাশিত ইউনিসেফের হিসাবে, বাংলাদেশে এখনও গড়ে ৫৯ শতাংশ মেয়েই বাল্যবিবাহের শিকার হয়। যদিও এর বিপরিতে সরকারি হিসাব বলছে, এই হার ৫২ শতাংশ। দিন দিন এই সংখ্যা ক্রমে আসছে। সরকারি এবং বেসরকারি হিসেব যাই হোক একথা আমরা শক্তভাবেই বলতে পারি যে বর্তমান বাংলাদেশে এখনও অর্ধেক মেয়েই বাল্যবিবাহের শিকার হয়। এই যখন অবস্থা তখন কী করে আমরা নিশ্চিত হবো যে, কন্যা শিশুর উচ্চ শিক্ষার ব্যাপারে সমাজের মনোভাব কতটুকুন পাল্টেছে?।
বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়ার তথ্যমতে, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল এবং যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান কোরাম ইন্টারন্যাশনালের সহযোগিতায় ‘বাল্যবিয়ের অন্তর্নিহিত কারণ ও প্রভাব’ সংক্রান্ত এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানা যায়, এদেশের গ্রামাঞ্চলে মেয়েদের ক্ষেত্রে বাল্যবিয়ের হার খুবই উদ্বেগজনক। দেশে যে সংখক মেয়ের ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে বিয়ে হয়ে যায় তার অর্ধেক হচ্ছে ১২ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে। যার ফলে এই বাল্যবিয়ের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে শিক্ষাক্ষেত্রে।
খোঁজ নিলে দেখা যাবে গ্রামের একটি স্কুলে প্রাথমিক স্কুল থেকে ৫ম শ্রেণীতে পাশ করে যে সংখ্যক মেয়ে শিক্ষার্থী মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি হয় জেএসসি কিংবা এসএসসিতে তার অর্ধেক কমে যায়। এদেশে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে আইন আছে। তাছাড়া সরকারের প্রশাসন এই বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্বের সাথে দেখছে। আর বিভিন্ন এনজিওগুলোও বাল্যবিয়ে নিরোধে নানা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে চলেছে। সরকারের মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে সাড়ে পাঁচশো কোটি টাকা ব্যায়ে দেশের সকল উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে ‘কিশোর-কিশোরী ক্লাব’ গঠনের উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। যেখানে মূলত মেয়ে শিশুর শিক্ষা এবং মানসিক বিকাশের জন্য নানা ধরণের কর্মকান্ড পরিচালনা করা হবে।
মানবাধিকার কর্মী আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল বলেছেন, ‘মেয়েদের ক্ষেত্রে বিয়ের পরের জীবন খুবই দায়িত্বপূর্ণ জীবন। এখানে একজন মেয়েকে নিজের এবং পরিবারের অনেক দায়িত্ব পালন করতে হয়। এজন্য সবার আগে তার শারীরিক ও মানসিকতার পরিপূর্ণতা প্রয়োজন। যেটি ১৮ বছরের আগে সম্ভব নয়। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় ১৬ বছরের আগে স্কুল জীবন শেষ করা সম্ভব নয়। মূলত দারিদ্র্য, অশিক্ষা, অবহেলা, অসচেতনতা, কুসংস্কার ইত্যাদি বাল্যবিয়ের জন্য অন্যতম দায়ী। বর্তমানে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিরাপত্তাজনিত কারণে অভিভাবকরা মেয়েদের বাল্যবিয়ে দিতে বাধ্য হন। বখাটের উৎপাতের কারণে অনেকেই বিয়ে অনুপযুক্ত মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেন।
আমি মনে করি বাল্য বিয়ে নিরোধে সবার আগে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের পাশাপাশি অভিভাবকদের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। অভিভাবকরা একটু সচেতন হয়ে সরকারি সুযোগ-সুবিধা কাজে লাগাতে পারলে শিক্ষার্থ ঝরে পড়ার হার কমে যাবে এবং বাল্যবিয়ে রোধ করা সম্ভব হবে।
লেখক- সাবিত্রী রাণী ঘোষ, সম্পাদক- পাক্ষিক চাঁদনগর।
লেখকের অন্য লেখা পড়ুন- সংসদ নির্বাচনে নারীদের ভোট ফ্যাক্টর ও ভোটের পরিবেশ
Chandpur Times | চাঁদপুর টাইমস Top Newspaper in Chandpur