ইরানে সাম্প্রতিক বিক্ষোভের জন্য দেশি-বিদেশি শত্রুদের দুষছে তেহরান। পূর্বাপর আমলে নিলে এই দাবি পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আবার বিক্ষোভের কারণ হিসেবে যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের কথা বলা হচ্ছে, তাও অস্বীকার করার উপায় নেই।
তেহরানের বিদেশি ‘শত্রুরা’ সবার পরিচিত। সৌদি আরব, ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র সব সময় তক্কে তক্কে থাকে—এ কথাও সত্য। ইরানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হাসান রুহানি সরকারের প্রতিপক্ষ আছে। সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের তৎপরতা নতুন কিছু নয়।
তবে হতাশাজনক হলো, বিক্ষোভকে আগাগোড়া ষড়যন্ত্র তত্ত্বের আলোকে দেখছে ইরানের বর্তমান শাসকগোষ্ঠী। তারা বিক্ষোভকারীদের দেশদ্রোহী হিসেবে বর্ণনা করছে। কথিত এই দেশদ্রোহীদের ইতিমধ্যে দমন করা হয়েছে বলেও সদর্পে ঘোষণা দিয়েছে দেশটির সরকার।
রুহানি সরকারের বিরুদ্ধে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র অমূলক নয়। কিন্তু তাই বলে সবকিছুতে ষড়যন্ত্রের সিল সেঁটে বাস্তবতাকে ধামাচাপা দেওয়ারও সুযোগ নেই।
দারিদ্র্য, বেকারত্ব, নিম্ন মজুরি, বৈষম্য, মুদ্রাস্ফীতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, সরকারি দুর্নীতির মতো অভিযোগ তুলে গত মাসের শেষ দিকে ইরানে বিক্ষোভ শুরু হয়। দেশটির এমন সব প্রদেশে বিক্ষোভের সূত্রপাত, যা একসময় বর্তমান সরকারের ঘাঁটি হিসেবেই পরিচিত ছিল। কিন্তু সেখানকার বাসিন্দা, বিশেষ করে তরুণেরা রাস্তায় নেমে আসে। একপর্যায়ে এই অসন্তোষ সরকারবিরোধী বিক্ষোভে পরিণত হয়। দেশজুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।
ইরানের ৮০টির বেশি শহরে বিক্ষোভ হয়েছে। বিক্ষোভে হাজারো মানুষ অংশ নিয়েছে। বিক্ষোভকালে ২২ জন প্রাণ হারিয়েছে। গ্রেপ্তার হয়েছে হাজারো বিক্ষোভকারী। এই বিক্ষোভকে শুধু শত্রুপক্ষের কাজ বলে সাধারণীকরণ করা হলে, তা হবে বাস্তবতাকে অস্বীকারের শামিল।
বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ, তারা কষ্টে আছে। অন্যদিকে, ধনিক এলিট শ্রেণি সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে। তারা দেশে কিংবা দেশের বাইরে গিয়ে ভোগ-বিলাসিতা করছে।
বিক্ষোভ সূত্রপাতের পক্ষে যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের কথা উঠে এসেছে, তার সত্যতা খতিয়ে দেখতে কিছু নমুনা তুলে ধরা যেতে পারে।
ইরানে দ্রব্যমূল্য বেড়েই চলছে। দ্রব্যমূল্যের লাগামছাড়া প্রবণতায় বিশেষ করে নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত ভোক্তাদের নাভিশ্বাস উঠেছে। ইরানের মুদ্রার মান ব্যাপকভাবে পড়ে গেছে। এতে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে।
ওবামা প্রশাসনের সময় ইরান ও বিশ্বের শক্তিধর ছয় রাষ্ট্রের মধ্যে পরমাণু চুক্তি হয়। ঐতিহাসিক ওই চুক্তির বিনিময়ে ইরানের ওপর জারি থাকা নিষেধাজ্ঞা শিথিল হয়। ইরানে অর্থ প্রবাহের পথ খোলে। কিন্তু প্রাপ্ত অর্থ ইরানের ধনিক এলিটদের পকেটে যাওয়ার অভিযোগ আছে। ফলে ইরানের সাধারণ মানুষের অবস্থার বদল ঘটেনি; বরং দিন দিন তাদের জীবন-জীবিকার সংগ্রাম আরও কঠিন হয়েছে।
জনগণের জীবনযাত্রার মানের উন্নতির চেয়ে ইরান আঞ্চলিক পর্যায়ে প্রভাব বিস্তারের বিষয়ে অধিক মনোযোগী বলে অভিযোগ রয়েছে। আর এই খাতে তেহরানকে বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে।
বিশেষভাবে বললে, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য সাধারণ ইরানিদের রাস্তায় নামতে বাধ্য করেছে। অথচ দেশটির এলিট শ্রেণিকে বিলাসী জীবন যাপন করতে দেখা গেছে। শুধু তা-ই নয়, তারা সেসব ছবি সামাজিক মাধ্যমেও পোস্ট করেছেন।
ইরানে ধনি-গরিবের মধ্যকার বৈষম্য যে কতটা প্রকট, তা বুঝতে ওই সব ছবির দিকে তাকানো যেতে পারে। ইরানের আলালের ঘরের দুলাল-দুলালিদের বিলাসিতার খতিয়ান এই ছবি। তারা দলেবলে বসে ফুর্তি করছে। দামি পোশাক, জুতা পরছে। নামী ব্র্যান্ডের ঘড়ি, চশমা, মোবাইল ব্যবহার করছে। বিলাসী গাড়ি হাঁকাচ্ছে।
দেশটির ধনিরা যখন বিলাসিতায় মত্ত, তখন গরিবেরা সংসারের ঘানি টানতেই ব্যতিব্যস্ত। অভাব-অনটনে পড়ে গরিব মানুষ বাধ্য হয়ে তাদের কিডনি পর্যন্ত বেচে দেয়।
ইরানি সাংবাদিক আমির আহমাদি আরিয়ানের লেখায়ও তাঁর দেশে ধনি ও গরিবের মধ্যে বিদ্যমান প্রকট বৈষম্যের বিষয়টি উঠে এসেছে। তিনি লিখেছেন, ইরানের সম্পদশালী তরুণেরা তাদের সম্পদের উৎস জানে না। তারা গরিবের চোখের সামনে তেহরানের রাজপথে নামীদামি গাড়ি দাপিয়ে বেড়ায়। আর তারা তাদের বিত্তবৈভবের ছবি ইনস্টাগ্রামে দেন।
নিউজ ডেস্ক
আপডেট, বাংলাদেশ সময় ৩: ৫০ পিএম, ১৭ জানুয়ারি ২০১৮,বুধবার
এএস