অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়নের পাশাপাশি দখল-দূষণ, নদী ভাঙন, আবাসন ও অবকাঠামো নির্মাণ কৃষি জমি কমার মূল কারণ। এর ফলে খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি হুমকির মুখে পড়বে বলে বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছেন।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে কৃষি জমি আছে ৮৫ লাখ ২০ হাজার হেক্টর। এর মধ্যে প্রতিবছর দেশের ৬৮ হাজার ৭শ’৬০ হেক্টর চাষাবাদযোগ্য জমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে। স্বাধীনতার ৪৫ বছরে জমির পরিমাণ কমেছে ১২ লাখ ৪২ হাজার হেক্টর।
বাণিজ্যিক কারণে প্রতিদিন গড়ে ৬শ ’৯২ একর নির্মাণ কাজের কারণে এক হাজার হেক্টর জমি বিলীন হচ্ছে। এভাবে যদি কৃষি জমি কমতে থাকে, তবে একটা সময় দেশে ব্যাপক হারে খাদ্য সংকট দেখা দেবে। বিপুল সংখ্যক মানুষ উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে এবং বেকারত্বের হার বৃদ্ধি পাবে।
কৃষি জমি হারিয়ে অনেকে ভিন্ন পেশা বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে। কৃষি জমি সুরক্ষা আইন না থাকায় যে যেভাবে পারছে জমি বিনষ্ট করে চলেছে।
ভূমি রক্ষায় রাষ্ট্রের সমন্বিত কোনো পরিকল্পনাও নেই। যদিও ২০১৭ সাল নাগাদ ভূমি জোনিংয়ের লক্ষ্য ঠিক করেছে সরকার। তথাপি কৃষি জমির অপব্যবহার কতটা দ্রুত বন্ধ হবে এ নিয়ে সংশয়ের অবকাশ রয়েছে।
বাংলাদেশে ভূমির পরিমাণ ৩ কোটি ৫৭ লাখ ৬৩ হাজার একর। এ জমির সিংহভাগই কৃষি জমি এবং দেশের খাদ্য জোগানের মূল উৎস।
দুঃখের বিষয়, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, শিল্পায়ন, অবকাঠামো নির্মাণ ও আবাসনের কারণে দিন দিন এ জমির পরিমাণ কমছে। কৃষি জমি আমরা ধরে রাখতে পারছি না, ধরে রাখার কোনো উদ্যোগও পরিলক্ষিত হচ্ছে না। যে হারে জমি কমছে। তা’ যদি নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তবে দেশে অচিরেই খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে।
আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন নিয়ে যে গর্ব করছি, তা’ মিলিয়ে যেতে বেশি সময় লাগবে না। এমনিতেই এবং প্রতিবেশি ভারতের বৈরী পানি নীতির কারণে নদ-নদীর নাব্য কমে যাওয়া এবং উপকূলে লবণাক্ততা দেখা দেয়ায়, কৃষক ঠিকমতো ফসল ফলাতে পারছে না, তার উপর যথেচ্ছাচারে বিদ্যমান কৃষি জমি নষ্ট করা হচ্ছে। নগরায়ণ ও শিল্পায়ন এবং অবকাঠামো নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে । তবে তা’ কৃষি জমি ধ্বংস করে করার কোনো যৌক্তিকতা নেই।
কৃষি জমির পরিমাণ না বাড়িয়ে তৈরি জমি ব্যবহার করা আত্মঘাতী কর্মকা- ছাড়া কিছু নয়। বিশ্বের অনেক দেশেই কৃষি জমি সুরক্ষিত করে নগরায়ণ ও শিল্পায়ন করা হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ব্যয়বহুল প্রক্রিয়ায় খাল কেটে মরুভূমিতে ফসল ফলানো হচ্ছে।
ভিয়েতনামে এক শহর থেকে আরেক শহরে যেতে জমির উপর দিয়ে ফ্লাইওভার নির্মাণ করে কৃষি জমি রক্ষা করা হচ্ছে। এর বিপরীতে প্রকৃতিগতভাবে আমাদের দেশ কৃষি উপযোগী এবং কোনো ধরনের চাষ ছাড়াই বীজ ফেলে রাখলে গাছ জন্মে যায়।
কোনো কোনো জমিতে বছরে দুইবারের অধিক ফসল ফলানো যায়। এমন উর্বর দেশ পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায় না। অথচ বছরের পর বছর ধরে প্রকৃতির এ অপার দান স্বেচ্ছায় ধ্বংস করা হচ্ছে। যেখানে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পাশাপাশি উদ্বৃত্ত ফসল রপ্তানি করার অপার সুযোগ রয়েছে, সেখানে কৃষি জমি ধ্বংসের এ প্রক্রিয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
বাংলাদেশে ভূমি অনুযায়ী লোকসংখ্যা অনেক বেশি। প্রতিবছর প্রায় ২৫ লাখ মানুষ বাড়লেও, কৃষি জমি এক শতাংশ বাড়ছে না। বরং আয়তনের এক শতাংশ জমি কমে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে সমুদ্রে দ্বীপ এবং নদীতে চর জেগে উঠার কথা শোনা গেলেও সেগুলো কবে চাষযোগ্য হবে তা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। ফলে আমাদের বিদ্যমান কৃষি জমির দিকেই দৃষ্টি দিতে হবে। এসব জমি যদি হাতছাড়া হয়ে যায়, তবে সংকট যে তীব্র হয়ে উঠবে, তাতে সন্দেহ নেই।
কৃষি জমি রক্ষায় সরকারকে সুনির্দিষ্ট আইন দ্রুত প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। ছয় বছর ধরে কৃষি জমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইন ঝুলিয়ে রাখার অর্থ হচ্ছে, কৃষি জমিকে হারিয়ে যেতে দেয়া। এটা কোনোভাবেই সমীচীন হতে পারে না।
অপরিকল্পিত নগরায়ন, শিল্পায়ন, আবাসন ও অবকাঠামো নির্মাণের রাশ টেনে ধরতে হবে। কৃষি জমি বাঁচিয়ে পরিকল্পিতভাবে এসব কর্মযজ্ঞ সম্পাদন করা দরকার। যে জমি থেকে মানুষের খাদ্যের চাহিদা পূরণ হয়, সে জমি যে কোনো মূল্যে রক্ষা করতে হবে। তা করতে না পারলে একদিকে যেমন কৃষক বেকার হবে, অন্যদিকে দারিদ্র্যের হারও বৃদ্ধি পাবে।
আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ । তবে যেভাবে অলক্ষ্যে কৃষি জমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে। তাতে সংকট দেখা দিতে খুব বেশি সময় লাগবে না। দেশের মানুষের খাদ্য সংস্থান যে জমি থেকে হয়, তা রক্ষায় সরকারকে অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। (ইনকিলাব)
নিউজ ডেস্ক ।। আপডটে, বাংলাদশে সময় ০৫ : ৫০ পিএম, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৬ রোববার
এজি/এইউ