বিশেষ সংবাদ

কুকুরের দুধ পান করে বেড়ে উঠা ‘কুকুবালক’ নিয়ে ব্যাপক হইচই

বনের রাজা টারজানের মতো মধুপুরে কুকুবালককে নিয়ে চলছে ব্যাপক হইচই। কুকুর বালকের নাম ফখরুদ্দীন ওরফে ফখরা। ফখরা টাঙ্গাইলের মধুপুর পৌরসভার কাজী পাড়ার বাসিন্দা।

কুকুরের দুধ পানে বড় হওয়া বিস্ময়কর এক বালক ফখরার অবিশ্বাস্য এক গল্প এখন মানুষের মুখে মুখে। জন্মের ছয় মাসের মাথায় বাবা ফখরার মা জমেলা বেগমকে তালাক দেয়। অভাবী সংসারের ঘানি টানতে মধুপুর শহরের হাটবাজারে ময়লা-আবর্জনা সাফের কাজ নেয় জমেলা। হাটের অপরিচ্ছন্ন সব রাস্তার ধারে অনাদরে বসিয়ে রাখতেন মাসুম ফখরাকে। ক্ষুধায় কাঁদলে হাতের কাজ ফেলে পান করাতেন বুকের দুধ।

ক’দিন পর খেয়াল করলেন অনাদরে পড়ে থাকা ফখরার বেজায় ভাব বেওয়ারিশ কুকুরের সঙ্গে। তখন থেকে বুকের দুধ পানের ব্যাকুলতা কমতে থাকে। দুশ্চিন্তায় পড়ে যায় মা জমেলা। একদিন অবাককাণ্ড দেখে হতবাক হয়ে যান জমেলা। হাটের আবর্জনার স্তূপের আড়ালে দুই ছানার সঙ্গে কুকুরের স্তন চুষছে ফখরা।

তিনি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারেননি। টেনেহিঁচড়ে সরিয়ে নেয় তাকে। এরপর রাস্তার উপর বসিয়ে রাখা ফখরাকে কাজের সময়েও কড়া নজরে রাখতেন। কিন্তু সুযোগ পেলেই দলবাঁধা নেড়ি কুকুর ছুটে আসতো ফখরার কাছে।

আর ফখরা নির্ভয়ে পান করতো কুকুরের স্তন। রাগে ক্ষোভে প্রায়ই মারপিট করতেন শিশু ফখরাকে। জমেলা জানান, একদিন ফখরা হারিয়ে যায়। দুদিন পর সুস্থ ও স্বাভাবিক অবস্থায় পাওয়া যায় পৌরশহরের সান্দারপট্টির জঙ্গলে। এভাবেই কুকুরের সঙ্গে বাড়বাড়ন্তের গল্প ফখরার। পৌরশহরের সব কুকুর এখন ওর খেলার সাথী। বিশ্বস্ত বন্ধু। আসলে কুকুরের দুধ পান করেই বড় হয়ে উঠেছে ফখরা।

এভাবেই ফখরার জীবন ঘনিষ্ঠ গল্পের আক্ষরিক বর্ণনা দেন জমেলা বেগম।

পনেরো বছর বয়সে জমেলার বিয়ে হয় জটাবাড়ির আলীম উদ্দীনের সঙ্গে। তিন মেয়ের পর ফখরার জন্ম ২০১১ সালে। অভাবের সংসারে জমেলার মাথা গোঁজার ঠাঁই ভাইয়ের ভিটায়। বলা অনাবশ্যক, দেড় বছর বয়স থেকে কুকুরের সঙ্গে হাঁটাচলা, মেলামেশা অবিশ্বাস্য সখ্যতায় রূপ নেয়। চব্বিশ প্রহর পথ চলা, আহারবিহার ও নিশিযাপনে তৈরি হয় অবিচ্ছেদ্য রজু। পাড়ার সব বেওয়ারিশ কুকুরের সঙ্গে ভাব হলেও আদুরী আর বাবুলি সর্বক্ষণের সাথী। ওদের নিয়ে মধুপুর পৌরশহর ছাড়াও গাঙ্গাইর, রক্তিপাড়া, আশ্রা, মোটের বাজার, গারোবাজারসহ উপজেলার হাটবাজার ও গঞ্জ চষে বেড়ায় ফখরা। দূরের রাস্তায় কুকুরের পিঠে চড়ে পাড়ি দেয়। যেন ঘোড়সওয়ার। বন্ধুর মতো গড়াগড়ি, গলাগলি, কামড়াকামড়ি ও কসরত দর্শকদের মুগ্ধ করে। পাঁচ-দশ টাকা বকশিশ মেলে। তাতে কেনা হয় কলা-পাউরুটি। ভাগাভাগি করে খাওয়া। এভাবেই কলা আর পাউরুটিতে দিন কাটে কুকুরবান্ধব ফখরার।

অনেক সময় খাবারের লোভে দল বাঁধা কুকুর পিছু নেয় ফখরার। আর শহরে নবাগত অতিথিদের সঙ্গে ভাব জমাতে সময় লাগে না তার। মহল্লায় নবাগত আর মনিব অনুগত দু’দল কুকুরের আবহমান ঝগড়ায় দাঁত খেঁচিয়ে সেই গালি “কেন আইলি” প্রত্যুত্তরে “যাইস খাইস” বিবাদ মেটাতে তৎপর থাকে ফখরা। ডজন খানেক ‘যাইস খাইস’ বন্ধু নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর সময় শহরবাসী কেউ কেউ কুত্তার বাচ্চা তুলে গালি দেয়। তাতে গায়ে মাখে না ফখরা। দিনাবসানে মধুপুর বাসস্ট্যান্ডের ফুটপাথে কুকুরের সঙ্গে কুণ্ডলি পাকিয়ে আরামসে সময় কাটায় এ কুকুরবালক। মা জমেলা এখনো মধুপুর বাসস্ট্যান্ডের পরিচ্ছন্নতা কর্মী।

তিনি জানান, ছেলেকে অনেক বুঝিয়েছেন। লাভ হয়নি। কুকুর না দেখলে উদভ্রান্ত হয়ে পড়ে। খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দেয়। তাই ওকে ওর মতো করে ছেড়ে দিয়েছি।
মধুপুর বাসস্ট্যান্ডের পরিবহন শ্রমিক নির্মল জানান, রাতে এক ডজন কুকুরের কড়া পাহারায় বাড়ি ফেরে ফখরা। মায়ের রান্না করা খাবার ভাগ করে খায়। কাকডাকা ভোরে দলবেঁধে যায় বাসস্ট্যান্ডে।

ফখরার তিন বোনের সবার বিয়ে হয়েছে। বড় বোন শাহেদার আক্ষেপ, কুকুরের সঙ্গে থাকা-খাওয়ায় পড়শিরা বিরক্ত। ঘৃণা করে। বকাঝকা করে। কেউ মেশেনা। এমনকি আত্মীয়স্বজন বাড়িতে আসে না। কিন্তু ফখরার ওসবে তোয়াক্কা নেই।

জমেলা বলেন, ‘আবাল্য মেশামেশিতে অবুঝ প্রাণীর সঙ্গে এখন যেন নাড়ির বন্ধন। বোবা প্রাণী ওর আপনজন। ওদের ভাষা বুঝে। আকার ইঙ্গিতে ভাব বিনিময় করে। কুকুরের সঙ্গে জামাতে খাবার না দিলে অঝোর ধারায় কাঁদে ফখরা। বেশি ক্ষেপলে হাঁড়িপাতিল ভাঙ্গে। অস্বাভাবিক আচরণ করে। তখন ভয় লাগে।

গত ডিসেম্বরে মধুপুর পৌরশহরে বেওয়ারিশ কুকুর নিধন নিয়ে লঙ্কাকাণ্ড বাধায় ফখরা। প্রিয় সহকর্মী কালু ও ভুলু নিধন হয় অভিযানে। এতে ক্ষেপে যায় ফখরা। বাড়িতে অস্বাভাবিক চেঁচামেচি শুরু করে। খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেয়। পরে মায়ের পরামর্শে একদঙ্গল কুকুর নিয়ে পৌর ভবনে মেয়র মাসুদ পারভেজের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে।

মেয়রকে জানায়, বন্ধু কালু আর ভুলু কখনো মানুষ কামড়াতো না। তাহলে কেন তারা নিধন হলো। মেয়র আগে থেকেই ফখরাকে চেনেন। ফখরা জানায়, মেয়র তাকে খুব আদর করেন। তাকে কথা দিয়েছেন। বন্ধুদের আর নিধন করা হবে না। এজন্য সে খুবই খুশি। এ ব্যাপারে মেয়র মাসুদ পারভেজ ফখরার কুকুরপ্রীতি ও কুকুরের দুধ পানে বেড়ে উঠার সত্যতা নিশ্চিত করেন।

তিনি বলেন, পৃথিবীতে অনেক অবাক কাণ্ড ঘটে। এটি তার অন্যতম। কুকুর নিধনের প্রতিবাদে ফখরার পৌর অফিসে আসার কথা স্বীকার করে মেয়র বলেন, “কুকুরের সঙ্গে মানুষ হওয়া এ শিশুটির চাওয়া ছিল মানবিক। আসলে বিনা কারণে কুকুর নিধন না করার জন্য নির্দেশনা রয়েছে হাইকোর্টের।

গত ডিসেম্বরে নিধন অভিযানের পর মধুপুর পৌর শহরে বেওয়ারিশ কুকুর কমে যায়। তবে গ্রাম থেকে আসা নবাগত কুকুরের সঙ্গে ফখরার মিতালি গড়ে উঠে সমতালে। পৌর শহরের পাইলট মার্কেটের দোকানি রফিকুল ইসলাম তালুকদার জানান, ফখরাকে ছোটকাল থেকেই কুকুরের সঙ্গে বড় হতে দেখেছি।

কুকুরের দুধ পান করার দৃশ্য অনেকেই অবলোকন করেছেন। মধুপুর পাইলট মার্কেটের গার্মেন্ট ব্যবসায়ী ভুট্টো সরকার বলেন, ‘আজন্ম কুকুরের সঙ্গে মিতালির দরুন কখনো কখনো ওর মধ্যে অসহিষ্ণু ও ক্ষিপ্ত আচরণ দৃষ্ট হয়। রাগলে গলা দিয়ে অস্বাভাবিক স্বর বের হয়। সর্বক্ষণ জিহ্বা বের করে রাখতে পছন্দ। হাঁটা ও পা ফেলার স্টাইলে কুকুরের অনুকরণ লক্ষণীয়।

মা জমেলা বলেন, ‘ওর কুকুর সঙ্গ বিরত রাখা বিফলে গেছে। জরুরি চিকিৎসা দরকার। আমরা খুবই গরিব। এক বেলা খাবারই জুটে না। আমার বুকের মানিকের চিকিৎসা করাবো কিভাবে। মানুষে-কুকুরে এ মিতালি বিস্ময়কর না হলেও স্বভাবে হিংস্র ও মানসিক বৈকল্যে আক্রান্ত ফখরার সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসনে সহৃদয়বানদের এগিয়ে আসার আর্তি জানান জমেলা বেগম।

আরো পড়ুন- কুকুরের দুধই সেলিমের সম্বল

নিউজ ডেস্ক
: আপডেট, বাংলাদেশ ২: ৪০ পিএম, ১০ আগস্ট ২০১৭, বৃহস্পতিবার
ডিএইচ

Share