chandpur times desk:
আবহাওয়াও ক্রমশ খারাপ। পর্বত আরোহীদের অনেকেই নেমে যাচ্ছেন। গাইডরাও ঝুঁকির কথা বিবেচনা করে নেমে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। কিন্তু নামলেন না নিশাত মজুমদার।
বিরূপ আবহাওয়ার কারণে লক্ষ্যে যাওয়ার যাত্রা কিছুক্ষণ থমকে ছিল বটে, তবে দমেননি। এভারেস্ট চূড়ায় যে তাকে উঠতেই হবে। সকল বাধা পেরিয়ে বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বত শৃঙ্গে পা রাখলেন বাংলাদেশের এ নারী। বাতাসের গতিবেগ ছিল তখন ঘণ্টায় তিনশ’ কিলোমিটার। এমন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ২৯ হাজার ২৯ ফুট উপরে বাংলাদেশের পতাকা মেলে ধরলেন।
এভারেস্ট জয়ের ২ বছর ৯ মাস পর দুঃসাহসিক অভিযানের অভিজ্ঞতা বলছিলেন নিশাত মজুমদার। প্রথম বাংলাদেশি নারী হিসেবে তিনি ২০১২ সালের ১৯ মে এভারেস্ট শৃঙ্গ জয় করেন।
আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে সামনে রেখে শনিবার কথা হয় তার সঙ্গে। বলেন, ইচ্ছাশক্তি এবং চেষ্টা আমাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। লক্ষ্য অটুট এবং সে অনুযায়ী নিজেকে তৈরি করলে মানুষ তার প্রত্যাশা পূরণ করতে পারে।
তিনি বলেন, পর্বতের প্রতিটি চূড়াই বাধা। এগুলোকে আমি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি। ‘আমাকে পারতে হবে’ এ মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে চলি। ভয়কে জয় করতে শিখেছি।
আমাদের সমাজের নারীদের জীবনেও পর্বতের মতো অনেক বাধা থাকে, সেই বাধাকে ডিঙ্গাতে হয় তাদেরকেই—এমনই মনে করেন বাংলাদেশ মুখ উজ্জ্বল করা এ নারী।
নিশাত মজুমদার বলেন, একুশ শতকেও একজন নারীর চলার পথে অনেক বাধা আছে। আছে প্রতিবন্ধকতা। এসব বাধা-প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে এখনকার নারীরা এগিয়ে চলছেন। বিভিন্ন সেক্টরে নারীরা তাদের সফলতার চিহ্ন রাখছেন।
প্রথম বাংলাদেশি নারী হিসেবে নিশাত মজুমদার মনে করেন, নারীরা এগিয়ে গেলে দেশ এগুবে। তাই পুরুষদেরও নারীদের প্রতি মানুষ হিসেবে সহযোগিতার মনোভাব দেখানো উচিত। নারী-পুরুষের সমতার ভিত্তিতেই একটি দেশ এগিয়ে চলে।
তিনি বলেন, দেশের প্রতি নারীদেরও দায়বদ্ধতা আছে। সে দায়বদ্ধতা নিয়ে পরিবার, সমাজসহ সবকিছু ঠিক রেখে কাজ করতে চেষ্টা করতে হবে।
এভারেস্ট জয়ের পর নিশাত যখন দেশের মাটিতে পা রাখলেন তখন গর্বে তার বুক ভরে গেছে। বললেন, বিমান থেকে যখন প্রথম বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখলাম, চারপাশে হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতি দেখে মনে হলো, আমার দায়িত্ব তো অনেক বেড়ে গেছে।
এ পর্যন্ত বাংলাদেশের দু’জন (ওয়াসফিয়া নাজরিন) নারীর পৃথিবীর সর্ব্বোচ্চ শৃঙ্গ বিজয় দেশের নারীদের কঠিন কাজের জন্য প্রেরণা জোগাবে বলে মনে করেন এ এভারেস্ট জয়ী।
আত্মপ্রত্যয়ীরা তাদের কাঙ্খিত জায়গায় পোঁছুতে পারে। মানসিকতা থাকতে হবে শেকড় থেকে শিখরে যাওয়ার। তাহলে সফলতা আসবে। ‘পারবো না’ ‘আমাকে দিয়ে হবে কি-না’ এসব কিছু মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে।
নিজের সম্পর্কে নিশাত বলেন, ভীষণ ঘরকুনো মেয়ে ছিলাম আমি। স্কুল-কলেজ-বাসা। এর বাইরে কোথাও ঘুরতেও যেতাম না তেমন একটা। ২০০৩ সালে ছোট এক বোনের সঙ্গে এভারেস্ট বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত কেওক্রাডং আরোহণ উৎসবে গিয়েছিলাম। সেই থেকে পাহাড় আমার নেশা হয়ে গেল। একসময় বিটিএমসির (বাংলা মাউন্টেনিয়ারিং অ্যান্ড ট্রেকিং ক্লাব) সঙ্গে জড়িয়ে পড়ি। তারপর কেওক্রাডং, দার্জিলিংয়ে প্রশিক্ষণ, এভারেস্টের নারী দল-কোনোটি বাদ দিইনি। ২০০৬ সালে হিমালয় পর্বতমালার মেরাপিক আর ২০০৮ সালে অন্নপূর্ণার সিঙ্গুচুলি পর্বতশৃঙ্গ জয় করি।
পর্বাতারোহী নিশাত মজুমদারের কর্মজীবন ঢাকা ওয়াসায়। প্রতিষ্ঠানটির তিনি হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা।
ব্যবসায়ী বাবা আবদুল মান্নান মজুমদার ও গৃহিণী মা আশুরা মজুমদারের চার সন্তানের মধ্যে নিশাত দ্বিতীয়৷ তার জন্ম ১৯৮১ সালে লক্ষ্মীপুরে৷ জন্ম লক্ষীপুরে হলেও বেড়ে উঠা ঢাকায়। নিশাত ফার্মগেটের বটমূলী হোম উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক, শহীদ আনোয়ার গার্লস কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক এবং ঢাকা সিটি কলেজ থেকে হিসাববিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেছেন৷
বাংলাদেশের প্রথম নারী এভারেস্ট জয়ী নিশাত ২০০৩ সালে এভারেস্ট বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের আয়োজনে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ চূড়া কেওক্রাডং জয় করেন৷ ২০০৬ সালের মার্চে বিশ্ব নারী দিবস উপলক্ষে বিএমটিসি আয়োজিত বাংলাদেশের নারী অভিযাত্রী দলের সঙ্গে ফের কেওক্রাডং চূড়ায় ওঠেন তিনি৷ একই বছরের সেপ্টেম্বরে বিএমটিসি আয়োজিত নারী অভিযাত্রী দলের সঙ্গে তিনি এভারেস্ট বেস ক্যাম্প ট্রেকিংয়ে অংশ নেন৷ এরপর ২০০৭ সালের মে মাসে বিএমটিসির অর্থায়নে দার্জিলিংয়ের হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট থেকে মৌলিক পর্বতারোহণ প্রশিক্ষণ নিয়ে ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে হিমালয়ের মেরা পর্বতশৃঙ্গ জয় করেন নিশাত মজুমদার৷ এভারেস্ট অভিযানের প্রস্তুতি হিসেবে পরের বছরের মে মাসে হিমালয়ের সিঙ্গুচুলি পর্বতশৃঙ্গে ওঠেন৷ নিশাত ২০০৯ সালের এপ্রিলে পৃথিবীর পঞ্চম উচ্চতম শৃঙ্গ মাকালুতে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ অভিযানে অংশ নেন৷ ২০১১ সালের অক্টোবরে বিএমটিসি আয়োজিত হিমালয়ের চেকিগো নামের একটি শৃঙ্গেও সফল অভিযানে যান নিশাত