ধানমন্ডির সাব্বির আহমেদ। বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপর্ণ পদে চাকরি করেন। তার ভাগ্নির বিয়ে। অফিসের কাজের চাপে বিয়ের দিন বাসায় ফিরলেন সন্ধ্যা ৬টায়। বাসার সবাই বিয়ের অনুষ্ঠানে চলে গেছেন। তাড়াহুড়ো করছিলেন সাব্বিরও। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চুলের দিকে তাকাতেই মন খারাপ হয়ে যায়। সাদা চুলে কালার করা হয়নি। কেমন উসকোখুসকো লাগছে। এ অবস্থায় বিয়েতে যাওয়া যাবে না। গুলশানের একটি সুপারশপ থেকে দুই দিন আগে কেনা রেভলন হেয়ার কালারের বাক্সটি আলমারি থেকে বের করেন। সেটি নিয়ে বাসার কাছের সেলুনে চলে যান। সেলুনে গিয়ে নিজের কেনা হেয়ার কালার লাগিয়ে নেন। বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে বিয়ের অনুষ্ঠানে চলে যান।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজের বালিশের দিকে চোখ যেতেই আঁতকে ওঠেন সাব্বির। সাদা বালিশ ভর্তি চুল। কী ব্যাপার! তার চুল পড়ছে নাকি? দ্রুত ওয়াশ রুমে গিয়ে গোসল করেন। আশ্চর্য হতে থাকেন। মাথায় বিলি কাটতেই চুল চলে আসছে হাতে। ভয় পেয়ে যান সাব্বির।
পরদিন ডাক্তারের কাছে ছুটে যান। ডাক্তার তার কাছে হিস্ট্রি জানেন। সাব্বিরের কাছ থেকে ডাক্তার এমন কিছু শুনতে পেলেন না যে, চুল পড়ার মতো কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায়। ডাক্তার এ সময় জিজ্ঞেস করেন, চুলে তিনি কালার লাগিয়েছেন কিনা। সাব্বির ভুলেই গিয়েছিলেন চুলে রং করার বিষয়টি। তিনি ডাক্তারকে রেভলনের কথা বলেন। ডাক্তার নিশ্চিত যে, সেই চুলের কালারটি ছিল নকল। সাব্বির গুলশানের বড় একটি দোকান থেকে হেয়ার কালারটি কিনলেও আসলটি পাননি। ভেজাল কালার চুলে দিয়ে নিজেই তার সর্বনাশ করেছেন। তার ঘন চুল পাতলা হতে থাকে। ছয় মাসের মধ্যেই তার মাথায় বড় টাক পড়ে। মিরপুরের গৃহবধূ ফারজানা আক্তার হেড অ্যান্ড শোল্ডার ব্র্যান্ডের শ্যাম্পু ব্যবহার করেন নিয়মিত।
এই ব্র্যান্ডের শ্যাম্পুটি তার চুলের জন্য ভালো কাজ করে। নতুন একটি শ্যাম্পুর কৌটা খুলে মাথায় দিতেই তার অ্যালার্জি শুরু হয়। পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে চলে যায়, পুরো শরীর লাল রেশ উঠে ফুলে যায়। তাকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া না হলে হয়তো বড় ধরনের বিপদ ঘটতে পারত বলে ডাক্তাররা জানিয়েছেন। সে যাত্রায় ফারজানা প্রাণে রক্ষা পেলেও চুল রক্ষা করতে পারেননি। মাথার তালুতে একজিমা তৈরি হয়। ভেজাল শ্যাম্পুর কারণেই তার এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। অথচ তিনি নামকরা বড় একটি দোকান থেকে শ্যাম্পুটি কিনেছিলেন।
বিদেশি মোড়কের ভেজাল প্রসাধনী ব্যবহারে এমনিভাবে কেউ যাচ্ছেন হাসপাতালে, কেউ হারাচ্ছেন সৌন্দর্য। আবার কেউ মরণব্যাধি রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছেন। বড় বড় ঝলমলে বিপনিবিতানগুলো থেকে বিদেশি এসব প্রসাধনী কিনেও রক্ষা পাচ্ছেন না গ্রাহকরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজারের অর্ধেক প্রসাধনী সামগ্রীতেই রয়েছে বিষ। এখন হাত বাড়ালেই মিলছে নকল আর ভেজাল প্রসাধনী। মোড়ক দেখে কারও বোঝার সাধ্য নেই কোনটি আসল আর কোনটি নকল। নকলের ভিড়ে প্রিয়জনের জন্য কেনা হচ্ছে প্রসাধনীর নামে এক প্রকার বিষ। দেশি-বিদেশি বিখ্যাত সব ব্র্যান্ডের প্রসাধনীর মোড়ক নকল করে তা বাজারজাত করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে আবার পরিত্যক্ত মোড়ক ও কৌটাতে নকল প্রসাধনী ঢুকিয়ে দেদার বিক্রি করা হচ্ছে।
বৈধ-অবৈধ দুই পথেই চীন থেকে আসছে শুধু ব্র্যান্ডের নকল কৌটা আর বাহারি মোড়ক। এতে ভেজাল প্রসাধনী ভরে বিক্রি হচ্ছে আসল দামে। পুরান ঢাকাকেন্দ্রিক ভেজাল আর নকল পণ্যের পসরা অনেকটা ওপেন সিক্রেট।
অভিযোগ রয়েছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট দফতরের অসাধু কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর সহযোগিতায় নকল ও ভেজাল পণ্যের বড় সিন্ডিকেট কাজ করে যাচ্ছে বছরের পর বছর। এতে প্রতি বছর শত শত কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। এসব পণ্য পরীক্ষা করে দেখা গেছে, নকল পণ্যে যেসব কেমিক্যাল ব্যবহার হয় তা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। দীর্ঘকাল এসব পণ্য ব্যবহারে স্বাস্থ্যের বড় ক্ষতি হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি প্যানটিন প্রোভি শ্যাম্পু, গার্নিয়ার, হেড অ্যান্ড শোল্ডার, ল-রেল, রেভলন ও প্যানটিন, নিভিয়া লোশন, লাক্স লোশন, মাস্ক লোশন, অ্যাকুয়ামেরিন লোশন, ফেড আউট ক্রিম, ডাভ সাবান, ইমপেরিয়াল সাবান; সুগন্ধির মধ্যে হুগো, ফেরারি, পয়জন, রয়েল, হ্যাভক, কোবরা সবই এখন ভেজাল আর নকলে ভরা। আর রয়েছে অলিভ অয়েল, কিওকারপিন, আমলা, ভ্যাসলিন হেয়ার টনিক, জিলেট ফোম, আফটার সেভ লোশন, জনসন, প্যানটিন প্রোভি ও হারবাল অ্যাসেনশিয়াল লোশন। কসমেটিকস দোকানগুলোতে রকমারি এসব বিদেশি পণ্যের সমারোহে চোখ ধাঁধিয়ে যায়।
লালবাগে ভেজাল প্রসাধনী সামগ্রী তৈরির সঙ্গে জড়িত রয়েছেন এমন একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পুরান ঢাকার মিটফোর্ড এলাকার বিভিন্ন পারফিউমের দোকান থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করে এসব নকল প্রসাধনী তৈরি করা হয়। তিনি বলেন, গ্লিসারিন, মোম রং আর পানি মিশিয়ে হয়ে যায় বডি লোশন আর ফেসওয়াশ। বাথরুমের পানিতে গ্লিসারিন, লবণ, সাদা পাউডার আর পারফিউম মিলিয়ে তৈরি হচ্ছে শ্যাম্পু। এ ছাড়া গার্মেন্টে ওয়াশিং প্লান্টে ব্যবহূত ডিটারজেন্ট দিয়েও তৈরি হচ্ছে শ্যাম্পু। বিদেশি মোড়কে ভরে এসব চলে যায় নামিদামি বিপণিবিতানে। নামিদামি ব্র্যান্ডের খালি বোতল জোগাড় হয় বিভিন্ন টোকাই আর ভাঙ্গারিওয়ালার কাছ থেকে। এগুলোতে ভরে বাজারজাত করা হয় ওইসব শ্যাম্পু। পুরান মেশিনের জং বা মরিচা তোলা হয় এমন তেলের সঙ্গে সুগন্ধি মিশিয়ে ফেলে দেওয়া প্যারাসুট, গন্ধরাজ ও জুঁই তেলের কৌটায় ভরে বাজারজাত করা হয়। সয়াবিন তেলও ব্যবহার করা হয়ে থাকে এসব কনটেইনারে। আসল আমদানিকারকের স্টিকারের মতো হুবহু স্টিকারও লাগানো হয় নকল সব পণ্যের প্যাকেটের গায়ে। রয়েছে উৎপাদন ও মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ এবং সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যের ছাপ।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) তথ্য অনুযায়ী, বাজারে প্রতিষ্ঠিত অনেক ব্র্যান্ডের প্রসাধনীর লেভেল ও মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ নেই। এক জরিপে দেখা গেছে, ৪৫ ভাগ প্রসাধন পণ্যের বিএসটিআইর সনদ নেই, ৭৫ ভাগ পণ্যের উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা নেই।
জানা গেছে, ভেজাল পণ্যের তালিকার শীর্ষে রয়েছে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে যেগুলোর বিজ্ঞাপন প্রচারিত হচ্ছে সেসব পণ্য। ইউনিলিভার, স্কয়ার টয়লেট্রিজ, কোহিনূর কেমিক্যাল, লালবাগ কেমিক্যালের পাশাপাশি বিদেশ থেকে আমদানি করা বড় বড় ব্র্যান্ডের পণ্য প্রকাশ্যে নকল করে বাজারজাত করছে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। এসব নকল পণ্যের কারখানাগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরা, চকবাজার, বেগম বাজার, রহমতগঞ্জ, কামালবাগ, খাজেদেওয়ান, ইসলামবাগ, দেবীদাসঘাট, বড় কাটরা, ছোট কাটারা ও কামরাঙ্গীরচরে।
চিকিৎসকরা বলছেন, ‘চর্মরোগীদের কাছে আমরা যখন জানতে চাই কী ব্যবহার করেন, তখন তারা কিছু ক্রিম, লোশনের কথা বলেন। যার কিছু নমুনা আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি। সেগুলোতে মারাত্মক ক্ষতিকর উপাদান বিদ্যমান ছিল। রোগীদের পক্ষে অনেক ক্ষেত্রেই জানা সম্ভব না তারা কী ব্যবহার করছে। নকল কসমেটিক ব্যবহারে ইমিডিয়েট অ্যালার্জিক রিঅ্যাকশনে ব্যবহারকারী মারাও যেতে পারেন। এমন ঘটনা আমরা দেখেছি। এ ছাড়া দীর্ঘদিন এসব ব্যবহারে ত্বকসহ কিডনি এবং শরীরে অন্য অংশে মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, বাজারে যত ধরনের দেশি-বিদেশি কসমেটিক আছে তার ৫০ শতাংশেরও বেশি ভেজাল। যার অধিকাংশই বহুজাতিক কোম্পানি ও দেশীয় নামিদামি কোম্পানির।’ তিনি আরও বলেন, ‘বাজারে নবজাতক শিশুদের জন্য কসমেটিকের যে প্যাকেট পাওয়া যায় সেগুলোতেই ভেজাল পাওয়া গেছে। এসব ভেজাল পণ্য ব্যবহারে শিশু বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়। তার শরীরের জ্বালা যন্ত্রণা হলেও সে বলতে পারে না।’
র্যাব ফোর্সেস সদর দফতরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম বলেন, ‘মূলত অতিলাভের লোভে ব্যবসায়ীরা নকল কসমেটিকস তৈরি ও বাজারজাত করছেন। তারা বিদেশি ও দেশীয় নামি ব্র্যান্ডের কসমেটিকসগুলো নকল করেন। রাজধানীর চকবাজারকেন্দ্রিক ভেজাল পণ্যের ব্যবসা বেশি হয়। অভিযান পরিচালিত হওয়ার পর এখন আর আগের মতো নকল জিনিস তৈরি হচ্ছে না। তবে একেবারে যে বন্ধ হয়েছে তাও নয়।
গত ১৮ জানুয়ারি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের দল এমনই ভেজাল কসমেটিক উৎপাদনকারী ও প্রতারণা চক্রের দুজন সদস্যকে গ্রেফতার করেছে। এরা হলেন মফিজুল ইসলাম ওরফে মোফেজ ও মো. সাইফ মাহমুদুল ওরফে বিল্লাল। জিজ্ঞাসাবাদে জানান, তারা দীর্ঘদিন ধরে উৎপাদনকৃত ভেজাল প্রসাধনী ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন মার্কেটে প্রতারণার মাধ্যমে বিক্রি করে আসছেন। শুল্ক গোয়েন্দা ও কাস্টমস অধিদফতর জানতে পারে, কোবরা, ফগ, ওমেন ব্লু, নিভিয়া, ইউনিলিভার, সুপার ম্যাক্সসহ বিদেশি বড় বড় কোম্পানির লেভেল সংবলিত ৪০ ট্রাক বোতল, কনটেইনার জব্দ করে।
নিউজ ডেস্ক:
আপডেট সময় ১২:৫০ পি.এম ৮ এপ্রিল ২০১৮ রোববার
এ.এস