Home / আন্তর্জাতিক / কর্মীদের ছাঁটাই করতে মরিয়া সৌদিসহ মধ্যপ্রাচ্যের ৮ দেশ
সৌদিসহ মধ্যপ্রাচ্যের ৮ দেশ

কর্মীদের ছাঁটাই করতে মরিয়া সৌদিসহ মধ্যপ্রাচ্যের ৮ দেশ

করোনার অর্থনৈতিক ধাক্কায় আরব দেশগুলো বৈধ অভিবাসী কর্মীদের ছাঁটাই করে ফেরত পাঠাতে চাইছে। অবৈধ কর্মীদের পাঠিয়ে দিচ্ছে। লাখো মানুষ ফিরলে সঙ্গনিরোধের ঝক্কির সমান বড় হয়ে আসবে তাঁদের জীবিকা ও প্রবাসী আয়ের সংকট। কিন্তু সরকারের প্রস্তাব, দেনদরবারে দেশগুলো টলছে না।

এপ্রিলের শুরু থেকে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের আটটি দেশ বেকার কর্মীদের ফিরিয়ে নিতে সরকারকে চাপ দিচ্ছে। বাংলাদেশের প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা মধ্যপ্রাচ্য থেকে পাঁচ–সাত লাখ কর্মী ফেরার আশঙ্কা করছেন। আর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ধারণা, সংখ্যাটা ১০ লাখ ছাড়াতে পারে।

সৌদি আরব ও কুয়েতের পাঁচ প্রবাসী কর্মী ফোনে প্রথম আলোকে বলেছেন, অভিবাসী কর্মীদের বেশির ভাগই চুক্তিভিত্তিক কাজ করেন। এখন কাজ নেই। অবৈধ ব্যক্তিরা কোনো কাজই পাচ্ছেন না। জীবন হয়েছে মানবেতর, অনেকেই দেশে ফেরার পথ খুঁজছেন।

ফেরত পাঠানোর জন্য কুয়েত সরকার বাংলাদেশের অবৈধ কর্মীদের অস্থায়ী আটক শিবিরে জড়ো করেছে। শিবিরগুলোর বাসিন্দারা বলছেন, তাঁদের মোট সংখ্যা প্রায় সাড়ে ছয় হাজার। মাজ্জাত আটক শিবিরে থাকা মো. রায়হান শেখ ফোনে বলেন, ২২ দিন ধরে বড় একটা স্কুলঘরে গাদাগাদি করে ৬০০ জন আছেন। খাবারের কষ্টের কথা বললে পুলিশ বেদম মারছে। বিভিন্ন শিবিরে চারজন মারা গেছেন। তিনি বলেন, ‘দূতাবাসে দিনে ফোন দিয়েও কাউকে পাই না। আমাদের বাঁচান।’

ইতিমধ্যে সংক্রমণের ভয়ে জেল ও আটকশিবির খালি করে অবৈধ কর্মীদের পাঠানো শুরু হয়েছে। গত ‍দুই সপ্তাহে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে ৩ হাজার ৬৯৫ জন ফিরেছেন। সবাইকে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন বা সঙ্গনিরোধে রাখতে হচ্ছে। ৬ মে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, আগামী কয়েক সপ্তাহে ফিরবেন প্রায় ২৯ হাজার জন, বেশির ভাগই মধ্যপ্রাচ্য থেকে।

সরকারের জনশক্তি প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থান ব্যুরোর (বিএমইটি) হিসাবে, অভিবাসী কর্মীদের প্রায় ৮০ ভাগই আছেন মধ্যপ্রাচ্যের আট দেশে। প্রবাসী আয়ের অর্ধেকের বেশি তাঁরাই পাঠান। কর্মী বেশি ফিরতে পারে সৌদি আরব, আরব আমিরাত, কাতার, কুয়েত ও ওমান থেকে। এই পাঁচ দেশ বাংলাদেশের শীর্ষ ১০টি প্রবাসী আয়ের দেশের মধ্যে পড়ে। বাহরাইন, লেবানন আর জর্ডান থেকেও অনেক কর্মীকে ফিরতে হবে। জর্ডানে প্রায় ৪৫ হাজার কর্মী তৈরি পোশাক খাতে কাজ করেন। রপ্তানি আদেশ বাতিল হওয়ায় কারখানায় কাজ বন্ধ, বেতন পাচ্ছেন না অনেকে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলছে, করোনাকালে মধ্যপ্রাচ্যের তেলনির্ভর অর্থনীতি গত ৪০ বছরে সবচেয়ে বড় ধাক্কার মুখে পড়ছে। আর আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) বলছে, বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) আরব দেশগুলোতে ৫০ লাখ লোক চাকরি হারাতে পারে।

প্রবাসীকল্যাণ ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তিনজন কর্মকর্তা বলেছেন, বাংলাদেশের অধিকাংশ শ্রমিক অদক্ষ। তাঁরা নির্মাণ খাতেই কাজ করেন বেশি। অর্থনৈতিক চাপে ব্যয় সংকোচনের কারণে দেশগুলোতে এই খাতের কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। অন্যান্য খাতের শ্রমিকেরাও কাজ হারিয়েছেন। আবার নানা কারণে অবৈধ হয়ে পড়া শ্রমিকেরাও এখন বেকার। হাজার হাজার শ্রমিক দেশগুলোর সরকারি খরচে বাংলাদেশে ফিরতে নিবন্ধন করেছেন। দুই দিনে ১০টি উড়োজাহাজে কর্মী পাঠাতে চেয়েছিল বাহরাইন। বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধের পর ধাপে ধাপে পাঠাতে রাজি হয়েছে।

অভিবাসীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা একাধিক ব্যক্তি বলেছেন, এই দুর্যোগকালে ইউরোপের দেশগুলো অবৈধ কর্মীদের তাড়িয়ে দিচ্ছে না। কর্মহীন বৈধ কর্মীদের নানা সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে। বাংলাদেশের তাই মধ্যপ্রাচ্যের চাপ মেনে না নিয়ে আন্তর্জাতিক ফোরামে প্রতিবাদ জানানো উচিত।

এদিকে করোনার ভয়ে গত জানুয়ারি-মার্চে দেড় লাখের বেশি প্রবাসী শুধু মধ্যপ্রাচ্য থেকে ছুটি নিয়ে দেশ ফিরেছিলেন। তাঁদের কাজে ফেরার সুযোগ বন্ধ হচ্ছে। গত দুই মাসে এক লাখের বেশি নতুন কর্মী যেতে পারেননি। বেকারের তালিকায় তাঁদের নামও উঠবে। সব মিলিয়ে অর্থনীতির খুঁটি প্রবাসী আয় বিপন্নতর হবে।

বড় আঘাত ও অবৈধরা

বড় আঘাতটা আসবে বিশ্বে বাংলাদেশের শ্রমের সবচেয়ে বড় বাজার সৌদি আরব থেকে। দেশটির বাংলাদেশ দূতাবাস বলেছে, সেখানে ২২ লাখ বাংলাদেশি কাজ করছেন। গত বছর মোট অভিবাসী কর্মীর প্রায় ৬০ শতাংশ ওই দেশে গেছেন। কর্মকর্তাদের কারও কারও আশঙ্কা, এই দেশ থেকে সাত লাখের মতো শ্রমিক ফিরে আসতে পারেন।

দূতাবাস সূত্র বলছে, দেশে ফিরতে বাধ্য করার জন্য সৌদি সরকার ইকামা বা কাজের বৈধ অনুমতিপত্রের মেয়াদ না বাড়িয়ে কর্মীকে অবৈধ করে দিতে পারে। ইকামার নবায়ন ফি কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিতে পারে। অন্য দেশগুলোও এমন নানা কৌশল নিতে পারে।

সৌদি আরবে মো. সোহাগসহ আটজন এক ঘরে থাকেন। দুই মাস ধরে কারও কাজ নেই। জমা টাকা শেষ। তিনি ফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আর কিছুদিন গেলে না খেয়ে মরতে হবে।’

দেশটি দুই বছর ধরে অবৈধ শ্রমিকদের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান চালাচ্ছে। করোনাকালে পরিস্থিতি কঠিনতর হচ্ছে। অভিবাসন খাতের একাধিক সূত্র বলছে, তথাকথিত ‘ফ্রি ‍ভিসা’ নিয়ে দেশটিতে গিয়ে অবৈধ হয়েছেন কয়েক লাখ প্রবাসী।

ফ্রি ভিসার ক্ষেত্রে দালালেরা যোগসাজশ করে সৌদি কোনো নাগরিককে নিয়োগকর্তা দেখিয়ে ভিসা বের করান। যাওয়ার তিন মাসের মধ্যে একই নিয়োগকর্তার কাছ থেকে ইকামা নিতে হয়। ফ্রি ভিসার পাতানো নিয়োগকর্তা কাজ তো দেনই না, ইকামা বা ইকামার নবায়নও হয়তো করে দেন না। কর্মী অবৈধ হয়ে পড়েন। আবার সৌদি আইনে ভিসায় বর্ণিত নিয়োগকর্তা ছাড়া অন্য কারও কাছে কাজ করা যায় না। ধরা পড়লে অবৈধ হতে হয়।

বেসরকারি জনশক্তি রপ্তানিকারকদের মোর্চা রিক্রুটিং এজেন্সি ঐক্য পরিষদের সভাপতি টিপু সুলতান বলছেন, উচ্চ অভিবাসন ব্যয় মেটাতে অন্য মালিকের উপরি কাজ করতে গিয়েও অনেকে অবৈধ হচ্ছেন। ফ্রি ভিসা বলে কিছু নেই। তবু মানুষ যাচ্ছে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, অবৈধ কর্মীদের দায় সবার।

প্রবাসী আয় বিপন্নতর

জনশক্তি প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থান ব্যুরোর হিসাবে (বিএমইটি), গত দুই বছর অভিবাসন কমছে। ২০১৭ সালে গিয়েছিলেন ১০ লাখ কর্মী। কমতে কমতে গত বছর সংখ্যাটা সাত লাখে ঠেকেছে। এ বছর ২৫ মার্চ পর্যন্ত বিমান চলাচল ছিল। দেড় লাখ কর্মী বিভিন্ন দেশে গেছেন। কিন্তু বিশ্বজোড়া লকডাউন শেষ হলেও কর্মী নেওয়ার হার অনেক কমতে পারে।

বেসরকারি খাতে বিদেশে কর্মী পাঠানো এজেন্সিগুলোর সংগঠন বায়রার মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী বলেন, করোনাবিধ্বস্ত প্রতিটি দেশ নিজের অর্থনীতি আর কর্মীদের বাঁচাতে অভিবাসী কর্মী কমাবে। চুক্তি নবায়ন করবে না। বেকারদের দেশে ফিরতে বাধ্য করবে।

তিন বছর ধরে প্রবাসী আয় বাড়ছিল। করোনাকালেও প্রবাসীরা দেশে টাকা পাঠিয়েছেন। তবে ২০১৯ সালের এপ্রিলের তুলনায় গত এপ্রিলে এটা ১১ শতাংশ কমে গেছে।

সরকারের দেনদরবার অরণ্যে রোদন

বিএমইটির মহাপরিচালক মো. শামছুল আলম বললেন, চলমান সংকট সমাধানে প্রবাসীকল্যাণ ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মিলে কাজ করছে। তারপরও যাঁরা ফিরে আসছেন, তাঁদের পুনর্বাসনের জন্য প্রশিক্ষণ ও কম সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছেন, তাঁরা ছাঁটাই করার আগে কর্মীদের অন্তত ছয় মাস সময় দিতে অনুরোধ করেছেন। আরব দেশগুলো সাড়া দিচ্ছে না। কর্মীদের জায়গায় রেখে ব্যবসা বা অন্য কোনো কাজে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার জন্য সরকার দেশগুলোর সঙ্গে যৌথ তহবিল গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিল। কোনো দেশ রাজি হয়নি।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, কয়েক হাজার লোক ফিরলে আলাদা কথা, কিন্তু কয়েক লাখ ফিরলে বিরাট সমস্যা হবে। তাই সব ধরনের চেষ্টা করা হচ্ছে। কর্মীদের পুনর্বাসনের জন্য সরকার আবার তহবিল দেওয়ার প্রস্তাব করতে যাচ্ছে। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তা চাওয়া হয়েছে।

অভিবাসন খাতে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) চেয়ারপারসন তাসনিম সিদ্দিকী বলছেন, বৈধ হোক আর অবৈধ, দুর্যোগের মধ্যে কোনো কর্মী ফেরত পাঠানো আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সরকারকে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়িয়ে কর্মী পাঠানো অন্য দেশগুলোর সঙ্গে মিলে সমঝোতার জন্য বিশ্ব পর্যায়ে চাপ তৈরি করতে হবে। প্রয়োজনে সাবেক কূটনীতিকদের নিয়ে একাধিক দল গঠন করে কৌশল স্থির করতে হবে। (প্রথম আলো)

বার্তা কক্ষ,৯ মে ২০২০