Home / লাইফস্টাইল / করোনা হলে মানুষের ঘ্রাণশক্তি কেন চলে যায়?
মানুষের ঘ্রাণশক্তি, ঘ্রাণশক্তি

করোনা হলে মানুষের ঘ্রাণশক্তি কেন চলে যায়?

করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হলে উপসর্গ হিসেবে আক্রান্ত ব্যক্তির ঘ্রাণশক্তি চলে যেতে দেখা যায়। কিন্তু এত কিছু থাকতে কেন এ উপসর্গ? গবেষকেরা বলছেন, এ ধরনের লক্ষণ দেখা দেওয়ার পেছনের প্রক্রিয়াটি তাঁরা বুঝতে শুরু করেছেন।

সায়েন্টিফিক আমেরিকান ডটকমের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কোভিড-১৯–এর সঙ্গে গন্ধ এবং স্বাদের লক্ষণ হঠাৎ চলে যাওয়াকে হাইপোস্মিয়া বা অ্যানোসিমিয়ার (গন্ধের হ্রাস বা পুরোপুরি চলে যাওয়া) সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বলে মনে করা হয়। তবে কেবল গন্ধ না পাওয়ার অর্থ এই নয় যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেছে।

কিছু মানুষের ক্ষেত্রে কিছু অ্যানোসিমিয়া বা ঘ্রাণশক্তি হারানো কোভিড-১৯–এর প্রথম বা প্রাথমিক লক্ষণ এবং কিছু লোকের জন্য একমাত্র লক্ষণ হতে পারে। তাই রোগ শনাক্ত করার ক্ষেত্রে অ্যানোসিমিয়ার দিকে নজর দেওয়া যেতে পারে বলে মনে করেন গবেষকেরা। এই মুহূর্তে করোনাভাইরাস সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে বেশি সংক্রমণের হার যেসব শহরে, সেখানে মানুষের ঘ্রাণশক্তির হঠাৎ হ্রাস সম্ভবত অন্য যেকোনো কিছুর চেয়ে কোভিড-১৯ সংক্রমণের ইঙ্গিত দিতে পারে।

গবেষকেরা বলছেন, বিভিন্ন পরিস্থিতিতে ঘ্রাণশক্তি হারানোর ঘটনা ঘটতে পারে। সাধারণ সর্দি থেকে শুরু করে সাইনাসে সংক্রমণ, প্রাথমিক পর্যায়ের আলঝেইমার এবং পার্কিনসন রোগ বা সাধারণভাবে বার্ধক্যে ঘ্রাণশক্তি কমে যেতে পারে। হাইপোস্মিয়া বা অ্যানোসিমিয়াকে স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে দেখা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ৪০ বছরের বেশি বয়সী মানুষের ১২ দশমিক ৪ শতাংশ ক্ষেত্রে ঘ্রাণশক্তি কমে যাওয়ার সমস্যা রয়েছে এবং ৩ শতাংশের ক্ষেত্রে পুরোপুরি চলে যাওয়ার ঘটনা দেখা যায়। তবে মহামারির এ সময়ে ঘ্রাণশক্তি পুরোপুরি হারানোকে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের পূর্ব লক্ষণ হিসেবে ধরে পরীক্ষা করা যেতে পারে। সম্প্রতি বিষয়টি নিয়ে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, সান ডিয়েগোর গবেষকেরা ছোট আকারের একটি গবেষণা করেছেন। তবে তাতে দেখা গেছে, শুধু ঘ্রাণশক্তি চলে যাওয়ার সমস্যাকে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার লক্ষণ হিসেবে ধরে নেওয়া যাবে না।

ঘ্রাণশক্তি চলে যাওয়ার বিষয়টি সার্স-কোভ-২ ভাইরাস কীভাবে কাজ করে, তা বুঝতে সাহায্য করতে পারে। গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে গবেষকেরা এ নিয়ে আলোচনা শুরু করেন। এ নিয়ে তৈরি হয়েছে গ্লোবাল কেমোসেন্সরি রিসার্চ কনসোর্টিয়াম। গবেষকেরা সেখান থেকে অনলাইন সমীক্ষা চালিয়ে বৈশ্বিক তথ্য সংগ্রহ করছেন। ইতিমধ্যে ৩১টি ভাষায় প্রায় ৩০ হাজার প্রতিক্রিয়া পেয়েছেন। তাঁরা বলছেন, এর ফলাফল কনসোর্টিয়ামের গবেষকদের ঘ্রাণশক্তি, স্বাদ, মুখ, নাক ও ত্বকের সংবেদন হারানোর সঙ্গে কোভিড-১৯ বা অন্য শ্বাসতন্ত্রের রোগের সম্পর্ক আছে কি না, তা জানতে সাহায্য করবে।

ওই সমীক্ষার ১১ দিন পর তথ্য বিশ্লেষণ করে যে গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে দেখা গেছে, কোভিড-১৯–এর ফলে আক্রান্ত ব্যক্তির ৮০ শতাংশ ঘ্রাণশক্তি, ৬৯ শতাংশ স্বাভাবিক স্বাদ নষ্ট ও ৩৯ শতাংশ ত্বকের স্বাভাবিক সংবেদন নষ্টের তথ্য উঠে এসেছে। পরের গবেষণায় কোভিড-১৯–এর সঙ্গে অন্য রোগের পার্থক্য তুলে ধরা হতে পারে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ভাইরাসটি কীভাবে ঘ্রাণশক্তি নষ্ট করে? এ নিয়ে গবেষণা করছেন বিজ্ঞানীরা। দ্রুত হয়তো ফল জানা যাবে। তাঁরা বলছেন, ঘ্রাণশক্তি হারানোর পেছনে নানা কারণ থাকতে পারে। তবে অধিকাংশ গবেষক একমত হয়েছেন যে করোনাভাইরাস নাকের সংবেদী কোষের ওপর প্রভাব ফেলে মস্তিষ্কে সংকেত পাঠানো বন্ধ করে দেয়। দেখা গেছে, আগের সার্স-কোভের মতো এখনকার সার্স-কোভ-২ ভাইরাস স্পাইক প্রোটিন দিয়ে এনজিওটেনসিন-কনভার্টিং এনজাইম–২ (এসিই–২) রেসেপ্টর ব্যবহার করে কোষের মধ্যে ঢুকে পড়ে। সার্স-কোভ-২–এর ক্ষেত্রে বাড়তি হিসেবে কোষে প্রোটিনের প্রবেশের প্রক্রিয়ায় স্পাইক প্রোটিনকে সহায়তা করার জন্য ‘টিএমপিআরএস–২’ নামের একটি প্রোটিজের দরকার পড়ে। এর অর্থ, ভাইরাস অনুপ্রবেশ করতে সক্ষম হওয়ার জন্য বা তাদের প্রতিলিপি তৈরির জন্য প্রোটিনগুলোকে প্রকাশ করতে হয়।

‘এসিই–২’ এবং ‘টিএমপিআরএস–২’ বিভিন্ন ধরনের কোষে প্রকাশিত হয় এবং নাক, গলা এবং ওপরের শ্বাসনালিতে প্রচুর পরিমাণে প্রকাশিত হয়। নাকের ক্ষেত্রে রেসপিরেটরি এপিথিলিয়াম (আরই) এবং ওলফ্যাক্টরি সেনসরি এপিথেলিয়াম (ওএসই) উভয় ক্ষেত্রেই ভাইরাসটির বিস্তার দেখা যায়। তবে বেশি দেখা যায় সেনসরি এপিথেলিয়াম। এখানে থাকা কোষগুলো সাধারণত সংবেদনশীল নিউরনের স্বাস্থ্য ও শ্লেষ্মা স্তরকে ঠিক রাখে। এগুলো ঘ্রাণের নিউরনকে সক্রিয় করতে পারে। এর মধ্যে যেকোনো একটি কোষের ক্ষয়ক্ষতি হলে পুরো ক্রিয়াকলাপকে প্রভাবিত করতে পারে বা কোষকে হত্যা করতে পারে। তবে অনেক সময় আবার সংবেদনশীল নিউরনে আক্রমণ না করেই ভাইরাস কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে নাক এবং ঘ্রাণ ভালভের পাশাপাশি অন্যান্য পথে চলে যেতে পারে। অনেক সময় দেখা যায়, স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি না হলেও অন্য কোনো কারণে মস্তিষ্কে সংকেত কমে যাওয়ার ঘটনা ঘটতে পারে। এ রকম একটি কারণ হতে পারে সংবেদনশীল এপিথিলিয়ামে প্রদাহ। সংবেদনশীল এপিথিলিয়ামের সাসটেন্টাকুলার কোষে নিউরনের কার্যকারিতাও বিভিন্ন উপায়ে প্রভাবিত হতে পারে। ফলে নিউরনে ঘ্রাণের সংকেত গেলেও তা ঠিকমতো সংকেত স্থানান্তর করতে পারে না। বেশির ভাগ রোগীর মধ্যে ঘ্রাণশক্তি আবার দ্রুত ফিরে আসে বলে সংবেদনশীল নিউরন সক্রিয়তার প্রমাণ পাওয়া যায়।

গবেষকেরা বলেন, জীবদ্দশায় নিউরনের পুনর্জন্ম হতে পারে। তবে হুট করে এর পুনর্জন্মপ্রক্রিয়া শুরু হয় না। কমপক্ষে ৩০ দিন বা তার বেশি সময় লাগে, যাতে সংবেদন আবার ফিরে আসে। তাই শ্বাসকষ্টের লক্ষণ প্রকাশের আগে ঘ্রাণশক্তি হারানোর মতো লক্ষণগুলো ভাইরাস সংক্রমণ বোঝার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। গবেষকেরা আশা করছেন, ঘ্রাণশক্তি হারানোর সঙ্গে ভাইরাসের সম্পর্ক কী, তা নিয়ে আরও রহস্য উদ্ধার করতে পারবেন তাঁরা। এ নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের একদল গবেষক কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।

বার্তা কক্ষ,১৭ জুন ২০২০