জাতীয়

করোনা মোকাবেলায় সতর্কতাই বেশি জরুরি

গুটিগুটি পায়ে অবশেষে বাংলাদেশেও চলে এসেছে ভয়াবহ করেনাভাইরাস। রোববার তিনজনের দেহে এ ভাইরাস শনাক্ত করা হয়েছে। পর্যবেক্ষণে রয়েছেন দু’জন। এ খবর ছড়িয়ে পড়ার পরই জনমনে দেখা দিয়েছে আতঙ্কা।

এ অবস্থায় দেশবাসীকে আতঙ্কিত না হয়ে সতর্কতা অবলম্বন করার পরামর্শ দিয়েছেন রোগতত্ত্ব,রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা.মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা।

বর্তমান বিশ্বের এক ভয়াবহ আতঙ্কের নাম করোনাভাইরাস। তাই এ নিয়ে আমাদের অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। দেশজুড়ে সরকারি ও বেসরকারিভাবে জনগণের জন্য নানা ধরনের প্রচারণাও চালাতে হবে। তাই বলে অযথা আতঙ্ক বা গুজব ছড়িয়ে তো কোনও লাভ নেই। এতে বরং পরিস্থিতি সামাল দিতে সমস্যা দেখা দিবে। তার বদলে সতর্কতা ও মানবিক আচরণ জরুরি।

করোনা সংক্রান্ত খবর পরিবেশনের সময় সংবাদ কর্মীদের সবচেয়ে বেশি সতর্ক থাকতে হবে। এমন কোনও নিউজ দেয়া যাবে না যাতে লোকজন আরও বিভ্রান্ত হয় এবং তাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। একই সঙ্গে করোনা আক্রান্তদের নাম ঠিকানা প্রকাশ করা যাবে না কোনভাবেই। আর কেউ করোনায় আক্রান্ত হয়েছে শুনেই সংবাদকর্মীরা যেন তাদের সংবাদ সংগ্রহের জন্য ঝাঁপিয়ে না পড়েন। তাদের প্রত্যক্ষ কোনও বার্তা না দিয়েও তো সংবাদ প্রকাশ করা যায়।

এ নিয়ে অধ্যাপক ডা.মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা জানান, রোববার নারায়ণগঞ্জে করোনা আক্রান্তের বাড়িতে হানা দেন সংবাদকর্মীরা। তারা তাদের বাড়ি ঘিরে রাখেন। এতে উল্টো আতঙ্কিত হয়ে পড়েন আক্রান্তরা। এ ধরনের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা কিছুতেই কাম্য নয়। আর করোনা সংক্রান্ত খবর সংগ্রহ করার জন্য স্থানীয় প্রশাসন কিংবা আইইডিসিআ‘র কাছে যাওয়াই ভালো।

করোনা নিয়ে নানা ধরনের গুজব ছড়িয়ে পড়ছে। শুধু আমাদের দেশে নয়, বিশ্বের অনেক দেশেই এমনটা হচ্ছে। যেমন কেউ কেউ বলছেন, তুলসি পাতা বা বাঁচা রসুন খেলে করোনা দূরে থাকে। এ ধরনের পথ্য খেয়ে আনেকে উল্টো অসুস্থ হচ্ছেন। ইতালির এক নারী একসঙ্গে অনেকগুলো রসুন খেয়ে পেটব্যাথায় আ্রকান্ত হওয়ার পর তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, রসুন একটি স্বাস্থ্যকর খাবার। এতে বেশ কিছু ভেষজ উপাদান রয়েছে। তাই বলে রসুন কেরোনা ঠেকাবে এর কোনও সত্যতা নেই। তাই এ ধরনের গুজবে কান না দেয়াই ভালো।

চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য মাস্ক অতীব জরুরি। কিন্তু করোনায় আক্রান্তের খবর মেলার পর দেশে মাস্ক সঙ্কট দেখা দিয়েছে। ফলে এটি সবচেয়ে জরুরি যাদের জন্য,সে স্বাস্থকর্মীরাই বিপদে পড়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) তরফ থেকে এর আগেও বারবার বলা হয়েছে,সুস্থ লোকজনের জন্য মাস্ক ব্যবহার জরুরি নয়। বরং যারা এতে আক্রান্ত হয়েছেন তাদেরই এটি পরা প্রয়োজন। যাতে অন্য লোক এ ভাইরাসে আক্রান্ত না হন। তাছাড়া সব মাস্ক করোনা ঠেকাবে এমনও তো নয়। এজন্য রয়েছে বিশেষ ধরনের মাস্ক যা আমাদের দেশে কমই মিলছে। আর বাংলাদেশে গণহারে মাস্ক ব্যবহারের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।

আবারও বলছি সুস্থ মানুষের গণহারে মাস্ক ব্যবহারের কোনও কারণই নেই। যাদের ‘কোভিড-১৯’ভাইরাসের সংক্রমণ হয়েছে তাদের মাস্ক ব্যবহার করা উচিত। যারা হেল্‌থ কেয়ার সার্ভিসে আছেন তাদেরও বাধ্যতামূলক ভাবে মাস্ক ব্যবহার করা দরকার। আর যারা কোভিড-১৯ আক্রান্তদের চিকিৎসা করছেন তারা অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করবেন।

করোনার আতঙ্কে অনেকে চাল-ডালসহ প্রয়োজনীয় পণ্য মজুদ করতে শুরু করেছেন বলেও খবর পাওয়া যাচ্ছে। এ অতি সচেতনতা দেশে করোনা মোকাবেলাকে বরং কঠিন করে তুলবে। তাই আমাদের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সাবধানতা (যেমন বারবার হাত ধোয়া, ভিড় এড়িয়ে চলা) অবলম্বন করে স্বাভাবিক জীবনযাপনই শ্রেয়।

নিজের পরিচিত কোনও ব্যক্তি বা প্রতিবেশী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে শুনেই তার প্রতি অমানবিক হবেন না। আগে জেনে নিন, তিনি সত্যসত্যিই এ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন কিনা। এজন্য তাকে যথাযথ চিকিৎসা নিতে সহায়তা করুন। আর একজন করোনায় আক্রান্ত হয়েছে বলেই ওই এলাকার সবাই এতে আক্রান্ত হবেন এমন কোনও কারণ নেই। কারণ আপনি তার সংস্পর্শে না আসা পর্যন্ত এতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনা নাই। আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশির সংস্পর্শে এলে বা তার সঙ্গে হাত মেলালে এটি হতে পারে। তাই তার সচেতনভাবে তার সংস্পর্শ এড়িয়ে চলাই যথেষ্ট।

জ্বর হলেই আপনি করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন এমনটি ভাবা চরম বোকামি। ঋতু পরিবর্তনের কারণে এমনিতেই অনেকে জ্বর-কাশিতে ভুগছেন। তাই বলে তার সবাই কিন্তু এতে আক্রান্ত নন। তাই আমাদের আগে করোনার লক্ষণগুলো জেনে নিতে হবে।

করোনা আক্রান্ত হলে প্রথম ১০ দিনে ১০৪ ডিগ্রি জ্বর থাকবে। কারণ এই ভাইরাসের প্রকোপ মানব দেহে ১০ দিন স্থায়ী থাকে। আর সঙ্গে শুকনো কাশি এবং পরে শ্বাসকষ্ট। কিন্তু সাধারণ জ্বরে সর্দি, নাক বন্ধ, গলা খুশখুশ বা কাশি হয়। কিন্তু করোনাতে নাক বন্ধ কিংবা সর্দির লক্ষ্মণ দেখা যায় ন। এই ভাইরাস সোজা শ্বাসযন্ত্রকে আক্রমণ করে, তাই শুকনো কাশির সঙ্গে ১০৪ ডিগ্রি জ্বর শরীরকে দুর্বল করে তোলে।

তবে যাই হউক না কেন,অসুস্থ হলেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। নিজে নিজে ওষুধ সেবন না করাই ভালো।

মনে রাখবেন করোনাই বিশ্বের প্রথম ভয়াবহ রোগ নয়। এর আগে কেলেরা, বসন্ত, প্লেগের মতো রোগে বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। ১৩৪৬-১৩৫৩ সালের মধ্যে ইউরোপ ও এশিয়া মহাদেশের ৮ থেকে ২০ কোটি মানুষ মারা গেছে।

এছাড়া চলতি শতাব্দীতে এবোলা সার্স ভাইরাসের মত রোগেও মারা গেছে অনেক মানুষ। তখনও সাহসী মানুষেরা এসব দক্ষতার সঙ্গে এসব রোগকে মোকাবেলা করে পুথিবীকে নিরাপদ করে তুলেছে। এবারও এর ব্যতিক্রম হবে না।।

ঢাকা ব্যুরো চীফ , ৯ মার্চ ২০২০

Share