Home / উপজেলা সংবাদ / ফরিদগঞ্জ / ১০ টাকা ফিতে ফরিদগঞ্জের ছলেমান ফিরে পেলো ৭৫ হাজার টাকা
১০ টাকা ফিতে ফরিদগঞ্জের ছলেমান ফিরে পেলো ৭৫ হাজার টাকা

১০ টাকা ফিতে ফরিদগঞ্জের ছলেমান ফিরে পেলো ৭৫ হাজার টাকা

চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার বালিথুবা-পশ্চিম ইউনিয়নের মদনের গাঁও গ্রামের বাসিন্দা ছলেমান তপাদার এলাকায় ভ্যান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। তার মাসিক আয় প্রায় ৭ হাজার টাকা। সাংসারিক জীবনে ২ ছেলে ও ৩ মেয়ের জনক। ১ ছেলে ও ১ মেয়ে অবিবাহিত।

ছলেমান মেয়েকে একই বাড়ির বাসিন্দা রেজ্জাক তপাদার তাদের গৃহস্থালীর কাজের জন্য নেয়। কাজে নেওয়ার সময় শর্ত ছিল যে, তার মেয়ের যাবতীয় দেখভাল ও বিয়ের সময় খরচাদি রেজ্জাক তপাদার বহন করিবেন।

কিন্তু দীর্ঘ দিন ধরে গরীব ও অসহায় মেয়েটি রেজ্জাক তপাদারের গ্রহস্থালীর কাজ করার পরেও শর্ত অনুযায়ী যে প্রাপ্য দেওয়ার কথা তা দিচ্ছিল না। তাই নিয়ে বিরোধ শুরু হয়। এ অবস্থায় মেয়ের অসহায়ত্বের কথা এলাকার গণ্যমান্য, সমাজসেবী ও ব্যবসায়ী নূরে আলম মাসুদ মিয়াজীর কাছে বিস্তারিতভাবে খুলে বলেন।

গ্রাম আদালত সম্পর্কে জানেন। নূরে আলম মাসুদ মিয়াজী গ্রাম আদালত বিষয়ক ‘কমিউনিটি মত বিনিময় সভা’র মাধ্যমে জানতে পারেন গ্রাম আদালত কি, গ্রাম আদালতের এখতিয়ার ও কোন কোন বিষয়ে গ্রাম আদালত বিচার করতে পারে।

এ প্রেক্ষাপটে তিনি অসহায় ছলেমানকে কোনো চিন্তা না করে সরাসরি ইউনিয়ন পরিষদে গ্রাম আদালতে যাওয়ার পরামর্শ দেন। দেরি না করে পরদিনই ছলেমান ইউনিয়ন পরিষদে অবস্থিত গ্রাম আদালতে আসেন এবং গ্রাম আদালত সহকারীকে বিরোধীয় বিষয়টি বিস্তারিত বলেন।

সব কিছু শুনে গ্রাম আদালত সহকারী উম্মে তামিমা বলেন, এটি গ্রাম আদালতের আওতাভূক্ত একটি মামলা। আপনি চাইলে ইউনিয়ন পরিষদের এই গ্রাম আদালতে মামলা দায়ের করতে পারেন।

১০ টাকা ফি প্রদান করে ছলেমান ৭৫,০০০ (পঁচাত্তর হাজার) টাকা ক্ষতিপূরণ দাবী ক’রে ১) রেজ্জাক তপাদার, ২) আছমা এবং ৩) ফাতেমা গঙদের বিরুদ্ধে গত ১৮ অক্টোবর একটি ফৌজদারি মামলা দায়ের করেন।

মামলাটি আদালতের রেজিস্টারে ৫২/২০১৮ নং মামলা হিসেবে নথিবদ্ধ করা হয়। ওই দিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ শফিকুর রহমান পাটওয়ারী প্রতিবাদীগণের প্রতি আদালতের আইন অনুযায়ী সমন জারি করার আদেশ দেন। আদালত সহকারী গ্রাম পুলিশের মাধ্যমে প্রতিবাদীগণের (অভিযুক্তপক্ষ) প্রতি সমন জারি করেন।

সমন পাওয়ার পর গত ২১ অক্টোবর প্রতিবাদীগণ ও আবেদনকারী আদালতে হাজির হন। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ শফিকুর রহমান পাটওয়ারী প্রতিবাদীগণকে আবেদনকারীর অভিযোগ সম্পর্কে অবহিত করলে প্রতিবাদীগণ তা অস্বীকার করায় পক্ষদ্বয়কে আদালত গঠন করার নিমিত্তে বিচারকদের প্যানেল গঠনের জন্য সদস্য মনোনয়ন করার নির্দেশ দেন। গ্রাম আদালত সহকারী তাদেরকে সদস্য মনোনয়ন ফরম দিয়ে সদস্য মনোয়নের বিষয়টি বুঝিয়ে দেন।

গত ২৫ অক্টোবর আবেদনকারীর পক্ষে ১) জাকিয়া বেগম, ইউপি সদস্য; ২) নূরে আলম মাসুদ মিয়াজী, স্থানীয় ব্যক্তি এবং প্রতিবাদীর পক্ষে ১) মোঃ আমির হোসেন কিরণ, ইউপি সদস্য; ২) মুন্না তপাদার, স্থানীয় ব্যক্তিকে গ্রাম আদালতের বিচারক প্যানেলের সদস্য হিসেবে মনোনিত করেন।

ইউপি চেয়ারম্যান ও পক্ষদ্বয় কর্তৃক মনোনীত বিচারক প্যানেল সদস্যদের নিয়ে দায়েরকৃত মামলার জন্য গ্রাম আদালত গঠন করা হয়। এরপর গ্রাম আদালত গত ৩০ অক্টোবর অত্র মামলার প্রথম শুনানীর জন্য দিন ধার্য্য করে।

৩১ অক্টোবর উভয় পক্ষ ও প্যানেল সদস্যগণ মামলার শুনানীতে হাজির হন। আদালতের কাঠ-গড়ায় দাঁড়িয়ে উভয় পক্ষ তাদের নিজ নিজ বক্তব্য উপস্থাপন করেন। পক্ষদ্বয়ের বক্তব্য অনুযায়ী আবেদনকারী কর্তৃক প্রতিবাদীর বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগের প্রাথমিক ভিত্তি পাওয়া যায়। বিচারক প্যানেল ৫ নভেম্বর তারিখে পক্ষদ্বয় ও গ্রাম আদালতের মনোনীত প্যানেল সদস্যগণ হাজির হন।

পক্ষদ্ধয় ও সাক্ষীদের জবানবন্দীর আলোকে ও মামলার প্রেক্ষাপট পর্যালোচনায় প্রতিবাদীর বিরুদ্ধে আবেদনকারীর আনিত অভিযোগ প্রমাণিত হয়। আবেদনকারী ও প্রতিবাদীর সামাজিক অবস্থা ও পুনর্মিলনের বিষয় বিবেচনা করে পক্ষদ্বয়ের মনোনীত সদস্যগণ সর্ব সম্মতিক্রমে আবেদনকারীকে ৭৫ হাজার টাকা পরবর্তী ৭ দিন তথা১২ নভেম্বরের মধ্যে ক্ষতিপূরণ হিসেবে গ্রাম আদালতের মাধ্যমে পরিশোধ করার আদেশ দেন।

আদেশ অনুযায়ী রেজ্জাক তপাদার গং আবেদনকারী ছলেমান তপাদারকে ইউনিয়ন পরিষদের গ্রাম আদালতের মাধ্যমে ৭৫,০০০ (পঁচাত্তর হাজার) টাকা বুঝিয়ে দেন। এর ফলে গ্রাম আদালতের ঘোষিত রায় যথাসময়ে কার্যকর হয়।

মামলার রায় পেয়ে ছলেমান বলেন, “ইউনিয়ন পর্যায়ে সঠিক বিচার পাওয়ার নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল হচ্ছে গ্রাম আদালত। আমি সাধারণ মানুষ হিসেবে ভাবতেও পারিনি আমার এই অসহায় মেয়ের প্রাপ্য মজুরী ফিরে পাব যা আমার মত অসহায় ও দরিদ্র পরিবারের কাছে মহামূল্যবান অর্জন। আমি আশা করি এই রায় সমাজের কাছে একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।”

হিসেব অনুযায়ী ৫ দিনের মধ্যে মাত্র দুটি শুনানীর মাধ্যমেই মামলাটি নিস্পত্তি হয় এবং ৭ দিনের মধ্যে মামলার রায় শতভাগ বাস্তবায়িত হয়। মামলাটির জন্য আবেদনকারীকে মোট ৪ বার আদালতে আসতে হয়েছে।

তাই দরিদ্র ও অসহায় মানুষের জন্য স্বল্প সময়ে ও অতি অল্প খরচে ন্যায়-বিচার পাওয়ার আশ্রয়স্থল হয়ে উঠছে চাঁদপুরের গ্রাম আদালত। ফলে সাধারণ মানুষ গ্রাম আদালতের সুফল পেতে শুরু করেছে।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ সরকার, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং ইউএনডিপি -এর আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় বাংলাদেশে গ্রাম আদালত সক্রিয়করণ (২য় পর্যায়) প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এ প্রকল্পের মূল ভিত্তি হচ্ছে, গ্রাম আদালত আইন ২০০৬ (সংশোধন ২০১৩) এবং গ্রাম আদালত বিধিমালা ২০১৬। এ আইন বাস্তবায়ন করার মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ের সাধারণ মানুষ বিশেষভাবে নারী, দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া মানুষ অল্প সময়ে ও স্বল্প ব্যয়ে সঠিক বিচার পাচ্ছেন।

স্টাফ করেসপন্ডেট
০৬ ডিসেম্বর,২০১৮