২০০৪ সালের ২১ আগস্টের ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউ আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ের সামনে জনসভায় ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় আহত কৃষ্ণার শরীরে স্পিøন্টার বিদ্ধ হওয়ার দাগ আজও মুছেনি। গ্রেনেড হামলার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে চাঁদপুরের কচুয়া পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ডের পাটিকর বাড়ির কৃষ্ণ পাটিকর বলেন, আমি ওই সময় তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু এভিনিউ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সমাবেশের ডাক দিয়েছিল। নেত্রীর সেই দিনের ডাকে সাড়া দিয়ে কচুয়া থেকে আমি কৃষ্ণা, উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আহসান হাবীব প্রানজল, দেবীপুর গ্রামের মিজান এবং আমাদের গ্রামের গাজী কামালের বাবা আব্দুল গফুর সহ ৪জন ওই সমাবেশে যোগ দেই।
সমাবেশে ট্রাকের ওপর স্থাপিত অস্থায়ী মঞ্চের খুব কাছেই ছিলাম আমরা। আমাদের নেতা ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরকে মঞ্চে উঠিয়ে দিয়ে একটু দূরে সরে আসি।
এর ফাঁকে প্রানজল বলেন ‘আমি একটু পানি খেয়ে আসি’ তারপর আর তাকে খুঁজে পাইনি। নেত্রীর বক্তব্য শুরু হওয়ার পর মনোযোগ সহকারে শুনছিলাম। বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে হঠাৎ বিকট একটা শব্দের আওয়াজ শুনলাম। আওয়াজের সাথে সাথে দেখলাম আমাদের নেতা-কর্মীরা মাটিতে ঢলে পড়ছে। তখন আমি মনে করলাম তারা ভয়ে মাটিতে শুয়ে পড়ছে। কিছুক্ষণ পর দেখি আমার শরীর উষ্ণ উষ্ণ গরম লাগছে। তখন ভাবলাম আমার শরীর এমন লাগছে কেন। সাথে সাথে আমি আমার শরীরে হাত দেই। চোখে সামনে হাত এনে দেখি তাজা রক্ত। জীবন বাঁচানোর তাগিদে তখন আমিও সবার মত ছোটাছোটি করা শুরু করলাম।
তখন দেখি আমাদের নেতা ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর ঘোরপাক করতেছে, মনে হচ্ছে উনি যে কোন দিক দিয়ে বের হবে সে পথ খুঁজে পাচ্ছে না। তখন আমার শরীর দিয়ে রক্ত ঝড়ছে। নিজের চিন্তা না করে স্যারকে বাঁচানোর জন্য পরক্ষণেই দেখলাম একটি ভ্যান গাড়ি পাশ দিয়ে যাচ্ছে। সাথে সাথেই আমি ভ্যান গাড়িটি থাবা দিয়ে ধরে ভ্যান ড্রাইভারকে বললাম, আমার নেতাকে বাঁচাও। তখন ভ্যান ড্রাইভার সহ আমার নেতাকে ভ্যান গাড়িতে তুলে দিয়ে পান্থপথের দিকে পাঠিয়ে দেই। তখন আহত অবস্থায় আমি কাতরাতে কাতরাতে সামনে এসে দেখলাম আমাদের নেত্রীর গাড়িটি পিরামিনিয়া মাকের্টের কাছাকাছি।
নেত্রী গাড়িতে উঠার সাথে সাথে অপরদিক থেকে নেত্রীর গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি করতে শুরু করে। ওইখানে আরও কয়েকজন নেতা-কর্মী নেত্রীকে ঘিরে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যায়। এমন চলতে চলতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে, তখন নিজের জীবন বাঁচাতে ঘটনাস্থলে পাশাপাশি অবস্থিত আমাদের পাশ্ববর্তী গ্রামের মক্কা ট্র্যার্ভেলসের মালিক জামালের স্বরনাপন্ন হই। ট্রার্ভেলসের দরজার সামনে গিয়ে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। জ্ঞান ফিরার পর আমি দেখলাম জামালের পার্টনার আমার রক্তাক্ত কাপড় পরিবর্তন করে তোয়ালে দিয়ে আমাকে মুড়িয়ে রেখেছেন।
পরে জামাল এবং জামালের পার্টনার আমাকে মনোয়ারা হসপিটালে নিয়ে যায়। ওইখানে গিয়ে দেখি প্রানজল ওই হসপিটালে। প্রানজল আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন। ওই সময় হসপিটালে অনেক রোগী। করো হাত নেই, কারো পা নেই। পরে প্রানজল ডাক্তারদের ডেকে এনে আমার পায়ের এবং মাঝার থেকে স্পিøন্টার বের করে। প্রানজল যদি ওই সময় আমার চিকিৎসার দায়িত্ব না নিত তাহলে আমি মনে হয় বেঁচে ফিরতে পারতাম না। তার দায় আমি কখনো দিতে পারবো না। পরে প্রানজল তার উলনের বাসায় আমাকে নিয়ে যায়। রাতে আমার যখন শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল তখন আমার হাতে-পায়ে সারারাত তেল দিয়ে মালিশ এবং বুকে পাঞ্চ করে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে সহায়তা করে।
সকালে একটু সুস্থ হলে আমি প্রানজলকে বলি আমি বাড়িতে চলে যাবো, প্রানজল আমাকে সায়েদাবাদ এনে কচুয়ার বাসে তুলে দেয়। বাড়িতে আসলে আমার পরিবার, এলাকাবাসী ও আত্মীয়-স্বজন আমাকে দেখে কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। বাড়ি থেকে পরিবারের লোকজন আমাকে কচুয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করে। যদিও সেই সময়ে আমি সুস্থ হই কিন্তু বিগত ১৭ বছর ধরে এ যন্ত্রণা সঙ্গে নিয়ে অভাব অনটনের মধ্য দিয়ে জীবন কাটছে আমার। শরীরে বিদ্ধ হওয়া সেই স্পিøন্টারের দাগ আজও মুছে যায় নি। এখনো মাঝে মাঝে ঘুমের ঘরে ভেসে বেড়ায় ২১ আগস্টের ভয়াবহ ঘটনার চিত্র।
২১ আগস্টে যারা এই বর্বরোচিত হামলায় নিহত এবং আহত হয়েছেন তাদের এবং পরিবারের খোঁজ-খবর নেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নিকট তিনি আকুল আবেদন জানান। ২১ আগস্টের বর্বরোচিত হামলার বিভৎসতা আজও তাড়া করে ফিরছে কৃষ্ণা পাটিকরের। কিন্তু ইহা বরই মর্মান্তিক যে, ২১ আগস্টের পর এক এক করে কৃষ্ণা পাটিকরের জীবন থেকে ১৭ টি বছর কেটে যাচ্ছে অথচ আজও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তার খোঁজ-খবর নেওয়া বা কোন প্রকার সহায়তা প্রদান করা হয়নি।
প্রতিবেদক:জিসান আহমেদ নান্নু,২গ আগস্ট ২০২১