Home / বিশেষ সংবাদ / ওমিক্রন ও শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ
omicron

ওমিক্রন ও শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ

বর্তমানে বিশ্বে আতঙ্ক ও সমস্যাগুলোর সর্বাগ্রে আছে করোনাভাইরাসের নাম। অদৃশ্য এ ভাইরাসের ভয়ে থমকে গেছে অনেক কিছু, আর চেষ্টা চলেছে ঘুরে দাঁড়ানোর। করোনাভাইরাসের তাণ্ডব শুরুর পর থেকে সংক্রমণ, মৃত্যুর হার ছিল সর্বদা পরিবর্তনশীল। অঞ্চলভেদে ভাইরাসের ভয়াবহতার তারতম্য পরিলক্ষিত হয়েছে।

ভাইরাস থেকে সৃষ্ট সমস্যার কারণে অর্থনৈতিক,রাজনৈতিক, ধর্মীয় কাজকর্ম বাধাগ্রস্ত হলেও পরবর্তী সময়ে তার অনেকটা মানিয়ে নেয়া সম্ভব হয়েছে। তবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষা। কারণ মহামারির মধ্যে অন্যান্য সব কাজ অল্পপরিসরে করা গেলেও শিক্ষা গ্রহণে নেমে এসেছিল একেবারে ধীরগতি। তাই ওমিক্রন আতঙ্কে আরও একবার চলমান শিক্ষা কার্যক্রমের গতিশীলতা নিয়ে শঙ্কার সৃষ্টি হচ্ছে।

মহামারি করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর পর ২০২০ সালের মার্চ মাসে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়। অতঃপর কখনও থেমে থেমে আবার কখনও দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকে আক্রান্তের সংখ্যা। এমন পরিস্থিতিতে কয়েকবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার চেষ্টা হলেও শিক্ষার্থীদের সংক্রমিত হওয়ায় ভয়ের কথা বিবেচনা করে প্রতিবারই সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। দীর্ঘ ১৭ মাস পর ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হলেও আবার দেখা দিয়েছে করোনার নতুন রূপ ওমিক্রন আতঙ্ক। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা নিয়ে আবারও গুঞ্জন শুরু হয়েছে। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা কি সব সমস্যার সমাধান!

মহামারিতে দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে দেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থী প্রযুক্তির প্রতি ঝুঁকে পড়েছে এবং তার অন্যতম কারণ টিকটক, পাবজি, ফ্রি-ফায়ার কিংবা অন্যান্য কার্টুন।

করোনাকালে ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সি শিশুদের ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর ইউনিসেফ একটি জরিপ করেছে। সেখানে ২৩৯টি স্কুলের ১ হাজার ২৮১ শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক পরিসংখ্যানে বেশ উদ্বেগজনক তথ্য উঠে এসেছে। জরিপে অংশ নেওয়া ৯৪ শতাংশ শিশুর সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট আছে। এদের মধ্যে ৪৯ শতাংশ ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। ৩৭ শতাংশ শিশু বাবা-মায়ের ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। জরিপে ১১ বছরের নিচে ২৫ শতাংশ শিশুকে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে দেখা গেছে।

৬৫ শতাংশ শিশু নিজের পৃথক কক্ষে ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। যেখানে তারা ইন্টারনেট ব্যবহারের সর্বোচ্চ সুবিধা পাচ্ছে। নিজের ব্যক্তিগত কক্ষ হওয়ায় ইন্টারনেটের ব্যবহারবিধি নিয়ে তাদের প্রশ্নের সম্মুখীনও হতে হচ্ছে না। ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে গড়ে প্রতিদিন ৯৪ শতাংশ শিক্ষার্থী ইন্টারনেট ব্যবহার করছে।

সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, সম্প্রতি ৩২ শতাংশ ছেলে ও ২৪ শতাংশ মেয়ে (শিশু) সাইবার বুলিংয়ের শিকার। তাদের মধ্যে ২৬ শতাংশেরই সোশ্যাল নেটওয়ার্ক ব্যবহার, রিপোর্ট, ফেক অ্যাকাউন্ট, আনওয়ান্টেড কনটেন্ট সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। গত এক বছরে ১০.৮ শতাংশ শিশু তাদের ব্যক্তিগত তথ্য অনলাইনে অপরিচিত ব্যক্তিদের কাছে শেয়ার করেছে। ৫৭ শতাংশ শিশু অনলাইনে অপরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থেকে তাদের ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করেছে। প্রযুক্তিকেন্দ্রিক এমন সমস্যার পরও আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা এবং আবারও প্রযুক্তির প্রতি নির্ভরশীল হওয়া ‘আগুনে ঘি ঢালার’ মতো অবস্থা তৈরি করবে।

উল্লেখ্য, করোনাভাইরাস সংক্রমণের দিক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নাম সবার ওপরে এবং সবচেয়ে সংক্রমিত এলাকা নিউইয়র্ক। বেশি সংক্রমিত হওয়া সত্ত্বেও নিউইয়র্কের মেয়র অফলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখার পক্ষে। তিনি মনে করেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করার পরিবর্তে সবাই সচেতন থাকা এবং করোনা প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। এ ছাড়া প্রায় দুই বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে শিক্ষার্থীরা করোনা প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে অভ্যস্ত। এ অবস্থায় পুনরায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা শিক্ষার্থীদের জন্য মানসিক চাপ ও বোঝা বাড়বে।

দ্বিতীয়ত, মহামারিতে শিক্ষার্থীদের মাঝে আত্মহত্যা প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। করোনা মহামারির মধ্যে হতাশা, অর্থনৈতিক সমস্যাসহ বিভিন্ন কারণে প্রায় অর্ধশত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। এ ছাড়া স্কুল ও কলেজ শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার সংখ্যা তো এ সংখ্যার কয়েকগুণ। পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক জরিপে গত অর্থবছরের ১০ মাসের তথ্য বিশ্লেষণ করে এ চিত্র পাওয়া গিয়েছে। এভাবে দেশে যত মানুষ করোনাভাইরাসের কারণে মারা গেছে তার থেকে বেশি মানুষ আত্মহত্যা করেছে।

সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ (সিজিএস) সূত্র বলছে, মার্চ ২০২০ থেকে নভেম্বর ২০২০ পর্যন্ত আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে ১ হাজার ৫৮ জন। অন্যদিকে ২০১৯ সালের জুন থেকে ফেব্রুয়ারি ২০২০ এই ৯ মাসে এ সংখ্যা ছিল ৯৪০। অর্থাৎ করোনার ৯ মাসে আত্মহত্যার হার ১৩ শতাংশ বেড়েছে।

এ ছাড়া ইউনিসেফের তথ্যমতে, মহামারিতে সামাজিক দূরত্বের কারণে শিক্ষার্থীদের মাঝে আত্মহত্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। সব মিলিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা মহামারি থেকে ভয়ানক। কারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসার ফলে শিক্ষার্থী মানসিক অবসাদ থেকে মুক্ত থাকতে পারে,আবার নিজের মনের কষ্টের কথা অন্যের সঙ্গে বলতে পারে, শিক্ষকদের থেকে সমস্যা মুক্তির পরামর্শ নিতে পারে ইত্যাদি। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা শিক্ষার্থীদের মাঝে শঙ্কার সৃষ্টি করছে। তৃতীয়ত, বাল্যবিবাহ বৃদ্ধি ও শিক্ষার্থী ঝরে পড়া। করোনাভাইরাসের প্রভাবে অন্য একটি মারাত্মক সমস্যা শিক্ষার্থী ঝরে পড়া।

করোনা মহামারিতে অভিভাবকদের আয় কমে যাওয়ায় কর্মহীন হয়ে শহর ছেড়ে গ্রামে ফিরে যেতে বাধ্য হওয়া এবং দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকাসহ নানা সঙ্কটে দু’ বছরে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে। বিশেষ করে এ প্রাদুর্ভাবের পর দরিদ্র থেকে হতদরিদ্রের কাতারে এসে দাঁড়ানো পরিবারগুলো তাদের সন্তানদের লেখাপড়া থেকে সরিয়ে নিয়ে ছোটখাটো কাজে ঢুকিয়ে দিয়েছে। করোনাকালে দীর্ঘদিন সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।

২০২১ সালে মহামারির সময়ে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার অন্যতম কারন পরিবারের আর্থিক অনটন ও বাল্যবিয়ে। গত বছরের এপ্রিল থেকে অক্টোবরে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের জরিপ অনুযায়ী দেশের ২১টি জেলার ৮৪টি উপজেলায় ১৩ হাজার ৮৮৬টি বাল্যবিবাহ হয়েছে। অর্থাৎ মাসে গড়ে ১ হাজার ৯৮৩টি বাল্যবিবাহ হয়েছে।

এ জরিপ থেকে দেশের বাল্যবিবাহের ভয়ঙ্কর চিত্র খুব সহজেই অনুমেয়। এ কারণগুলো ছাড়াও মহামারিতে বাল্যবিবাহ বৃদ্ধির পেছনে আরও কিছু বিষয় জড়িত রয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম একটি ছেলেমেয়ের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। যার ফলে শিক্ষার্থীদের বিরাট একটা সংখ্যা শিক্ষা থেকে দূরে রয়েছে। তবে সমস্যাগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে কিছু প্রশ্ন থেকেই যায়! বাল্যবিবাহের শিকার হওয়া মেয়েগুলো কি পুনরায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরবে? তবে দুঃখের বিষয় হলো বাল্যবিবাহের শিকার অধিকাংশ শিক্ষার্থী আর ফিরতে পারে না তাদের স্বপ্নের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেটরি রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে প্রাথমিক পর্যায়ে ১৯ শতাংশ ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী পড়াশোনার বাইরে চলে গেছে।

২০২০ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী এ হার ছিল প্রাথমিকে ১৪ শতাংশ ও মাধ্যমিকে ২১ শতাংশ করে। অবশ্য গত বছরের সেপ্টেম্বরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর বাল্যবিবাহ আগের তুলনায় কিছুটা কমে এসেছে। সুতরাং ওমিক্রন আতঙ্কে পুনরায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হলে বাল্যবিবাহ ও শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। গত বছরের আগস্টে ইউনিসেফের এক রিপোর্ট প্রকাশিত হয়।

যেখানে দেখা যায়, দেশের প্রায় ৪০ লাখ নতুন শিশু প্রথমবারের মতো স্কুলে গিয়ে সশরীরে ক্লাস করার জন্য অপেক্ষা করছে। আর বিশ্বব্যাপী ১৪ কোটি নতুন শিক্ষার্থী প্রথম স্কুলে যাওয়ার অপেক্ষায় আছে। সুতরাং এ কথা সহজেই অনুমেয় যে চলতি বছরের জানুয়ারিতে নতুন শিক্ষার্থীদের পাঠদান শুরু হয়েছে।

সুতরাং এত অল্পদিনে পুনরায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা তাদের জন্য ক্ষতির কারণ হবে। এ ছাড়া মহামারি প্রাদুর্ভাবের কারণে কিশোর গ্যাং দৌরাত্ম্য, সামাজিক বিশৃঙ্খলা, পারিবারিক কলহসহ অন্যান্য সমস্যা তো আছেই। সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় ওমিক্রন প্রতিরোধে পুনরায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ না করে সচেতনতা অবলম্বন করা এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করা কার্যকরী পন্থা হবে।

লেখক:মুতাসিম বিল্লাহ মাসুম,শিক্ষার্থী,সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়,বৃহস্পতিবার, ১৩ জানুয়ারি ২০২২।