কাজী নজরুল ইসলাম। প্রেমিক, বিদ্রোহী। একজন প্রেমিকই পারে বিদ্রোহী হতে। প্রেম তাকে সাহসী বানায় অন্যায়ে ভীত না হয়ে প্রতিবাদ করতে। তিনি নজরুল,যাঁর প্রেমিক সত্তা মিশেছে বিদ্রোহে। তিনি নজরুল, যাঁর বিদ্রোহ একীভূত হয়েছে শোষিত মানুষের প্রেমে, ছড়িয়ে গেছে ব্যক্তিগণ্ডির সীমানা ছাপিয়ে।
তিনি মানুষকে ভালোবাসেন বলেই মানুষের শোষণ, যন্ত্রণা তাঁর প্রেমিক সত্তায় ক্ষতের সৃষ্টি করতে পেরেছিল। তিনি শাসকের অন্যায়ের বিরুদ্ধে শোষিতের জবান হয়ে লড়েছেন। শাসক খোদ ব্রিটিশ রাজ হলেও তাতে নজরুল নির্বিকার। লেখনী মহাশক্তিশালী অস্ত্র, সেটি শাসকগোষ্ঠীর অজানা নয়। তারা ভীত ছিল লেখনীর শক্তিতে। একে একে নজরুলের পাঁচটি গ্রন্থ নিষিদ্ধ করা হলো। কিন্তু এসবে নজরুলকে স্খলিত করা সম্ভব হয়নি একবিন্দু।
অন্যায়ের বিরুদ্ধে সদা উচ্চকিত এই স্বর কখনো কোনো শাসকের শাসনে-নির্যাতনে রুদ্ধ হয়নি। নজরুলের এ প্রতিবাদী সত্তা আমাকে সব সময় অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। এখনো চোখের সামনে যেকোনো অন্যায় দেখলে মনে হয় ‘লাথি মার ভাঙরে তালা, আগুন জ্বালা, আগুন জ্বালা।’
বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর কাজী নজরুল ইসলামকে ‘জাতীয় কবি’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তাঁকে রাষ্ট্রীয় সম্মানে ভূষিত করার মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্র নিজেকেই সম্মানিত করেছে। আমার মনে হয়, কোনো বিদ্রোহীর, প্রেমিকের বা কবির সীমানা জাতীয়তার সীমা দিয়ে এঁকে দেয়া যায় না। তাঁরা বৈশ্বিক; নজরুলও তাই। সারা বিশ্বের সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিনি ‘প্রতিবাদ’।
প্রেম ও বিদ্রোহের জাতি, রাষ্ট্রের সীমানা হয় না। মানবতার পক্ষে বা অন্যায়ের পক্ষে—সীমানা বলতে এতটুকুই। নজরুলের মানবতার পক্ষে, মানুষের পক্ষে। মানুষের প্রতি প্রেম তাঁকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী করেছে। যিনি শতকোটি নিরন্ন মানুষের মুখের গ্রাস লুণ্ঠনকারীর সর্বনাশ চেয়েছেন নিজের রক্তের বিনিময়ে, তিনি কখনো রাষ্ট্রীয় গণ্ডির কবিরূপে সীমাবদ্ধ হতে পারেন না।
পৃথিবীর যত দেশে যত মানুষ প্রতিনিয়ত অমানবিকতার সাক্ষী হচ্ছে, নজরুল তাদের কবি, তাদের আত্মীয়। যত দিকের যত অন্যায়, নজরুল তার বিরুদ্ধে বাধার বিন্ধ্যাচল। তাঁকে নির্দিষ্ট কোনো জাতীয়তার সীমায় আটকানো যায় না। তাঁর সত্তা অনুভব করা যায় তাঁর প্রেমে, তাঁর দ্রোহে। জীবনে চলার পথে প্রেরণা জোগান নজরুল।
সামস্ সাহেলা,বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
১৯ মে ২০২৩