২০০৩ সালের ঢাকা থেকে লালমোহনগামী লঞ্চ এমভি নাসরিন-১ মেঘনা নদীর চাঁদপুরের ডাকাতিয়া এলাকায় যাত্রী নিয়ে ডুবে যায়।
এতে প্রাণ হারায় জেলার তিন উপজেলার অন্তত ৪ শতাধিক মানুষ।
৮ জুলাই বৃহস্পতিবার ভোলার ইতিহাসে ভয়াবহ একটি দিন।
ওই দুর্ঘটনার পর থেকে এক এক করে পেরিয়ে গেছে ১৮ বছর। সেই দুর্ঘটনায় কেউ হারিয়েছে বাবা, কেউবা পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে।
মর্মান্তিক সেই দুর্ঘটনার কথা মনে করে আজও আঁতকে ওঠে স্বজনহারা মানুষরা। আজও থামেনি তাদের কান্না।
দুর্ঘটনায় অনেকেই সপরিবারে মারা যান। কেউ বা পরিবারের এক বা একাধিক স্বজনকে হারান। অনেক মানুষের লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি। নিখোঁজরা ফিরে আসবেন এমন প্রতিক্ষায় এখনো অনেকে অপেক্ষায় আছেন। প্রিয়জন হারানোর পর পরিবার-পরিজন নিয়ে অনেকেই ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু স্বজনহারা ক্ষত আজো কাঁদায় তাদের।
ভোলার লালমোহন উপজেলার পশ্চিম চর উমেদ ইউনিয়নের গজারিয়া বাজার সংলগ্ন ব্যাপারি বাড়ির বশির উদ্দিন ব্যাপারি পেশায় বাসচালক ছিলেন। চাকরির খোঁজে তিনি ঢাকায় গিয়েছিলেন। দুর্ঘটনাকবলিত সেই লঞ্চের যাত্রী ছিলেন। সেদিন তিনিও ফিরছিলেন নিজের বাড়িতে। কিন্তু দুর্ঘটনার পর থেকে নিখোঁজ।
আজও তার লাশ পাওয়া যায়নি। নিখোঁজ বশিরের পরিবারের সদস্যরা তাকে অনেক খোঁজাখুজি করেও লাশ পাননি। ছেলে মাহফুজের বয়স তখন ৬ মাস। এখন তার বয়স ১৮ বছর।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে মাহফুজ জানায়, কোনোদিন বাবার আদর ভালোবাসা পাইনি’। বাবার জন্য কুব কষ্ট হয়। বাবার অভাব কনোদিন পূরণ হবার নয়।
বশিরের স্ত্রী নাহার বেগম জানান, ছেলে-মেয়েদের অনেক কষ্ট করে বড় করেছি, দুর্ঘটনার পর থেকে কেউ আমাদের খবর নেয়নি। আমার কাছে কেন জানি মনে হয় সে ফিরে আসবে। তার ফিরে আসার অপেক্ষায় আছি এখনো। যদি ভাগ্যে থাকে তো ফিরে আসবে সে।
বশিরের মত ইলিশ কান্দির গ্রামের সিরাজ পাটোয়ারী নাসরিন-১ লঞ্চ দুর্ঘটনায় নিখোঁজ। তারও লাশ পাওয়া যায়নি। তিনি পেশায় কৃষক ছিলেন। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে কষ্টে দিন কাটিয়েছেন স্ত্রী পারুল বেগম। ছেলে-মেয়েরা বড় হয়েছে, পড়াশোনা করছে। অভাব-অনটনের মধ্যে দিন কাটিয়েছেন তিনি। এখন ভালো আছেন। কিন্তু স্বজনহারা ব্যথা এখনো ভুলতে পারছেন না পারুল বেগম।
তিনি বলেন, দুর্ঘটনার পর থেকে কেউ আমাদের খবর নেয়নি। অনেক কষ্টে করে ১৮ বছর পার করেছি।
সিরাজের ছেলে তুহিন বলেন, তখন তার বয়স এক বছর। সেই শিশুকালে বাবাকে হারিয়েছি। এ কষ্ট ভুলে যাবার নয়। বাবার কথা মনে হলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
জানা গেছে, অতিরিক্ত যাত্রী ও মালবোঝাই করার কারণে পানির প্রবল ঢেউয়ে নাসরিন-১-এর তলা ফেটে গেলে প্রায় ২ হাজারের বেশি যাত্রীসহ ডুবে যায়। লঞ্চে থাকা যাত্রীদের মধ্যে এক তৃতীয়াংশের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে। ধারণা করা হয়, লঞ্চ ডুবিতে কমপক্ষে ৮শ যাত্রীর সলিল সমাধি ঘটে।
এদের মধ্যে শুধু লালমোহনেরই যাত্রী ছিলেন ৪ শতাধিক। এছাড়া চরফ্যাশনসহ অন্য উপজেলারও কিছু যাত্রী ছিলেন। এরপর ১৮ বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু স্বজনহারাদের কান্না আজও থামেনি। আজও সেই ভয়াল স্মৃতির কথা মনে করেন তারা। এ দিন এলেই তারা কান্নায় ভেঙে পড়েন।
স্থানীয় সূত্র জানায়, ওই দুর্ঘটনায় অনেকেই সপরিবারে মারা যান। অনেক নিখোঁজদের লাশ পাওয়া যায়নি। দুর্ঘটনার এক-দেড় মাস পরও নিহতদের লাশ লালমোহন, চরফ্যাশন, মনপুরা ও দৌলতখান সংলগ্ন মেঘনা ও তেঁতুলিয়ার বিভিন্ন পাড়ে ভেসে উঠতে থাকে। অর্ধগলিত ওই লাশগুলো শেষ পর্যন্ত শনাক্তও করতে পারেননি স্বজনরা। অনেক লাশ আবার বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়।
লালমোহন উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ গিয়াস উদ্দিন বলেন, লঞ্চটি ত্রুটিপূর্ণ ছিলো। মর্মান্তিক সেই ‘দুর্ঘটনায় অনেক মানুষ মারা গেছে, তাদের মধ্যে লালমোহনের মানুষই বেশি। লঞ্চ মালিকপক্ষ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত এবং নিহত-নিখোঁজ পরিবারে সহায়তা করে সেই দাবি জানাচ্ছি। একইসঙ্গে এ রুটে আরো ভালো মানের লঞ্চ চলাচলের পাশাপাশি নৌপথে মানুষকে আরো সতর্ক হয়ে চলার আহ্বান জানাচ্ছি।
অনলাইন ডেস্ক