একটা সময় ছিল যখন সিনেমার নায়ক-নায়িকা, টিভি অভিনেতা-অভিনেত্রী কিংবা মডেলদেরকে আইডল মেনে ছেলে-মেয়েরা সাজ-পোশাক বেছে নিতো।
শাবানার মতো চুলের সাজ কিংবা ববিতার মতো নাকফুল- এটুকুতেই সন্তুষ্ট থাকতো মেয়েরা। প্রয়াত নায়ক সালমান শাহ্`র চুলে ঝুটি বাঁধার ধরন ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল সেইসময়ের ফ্যাশনপ্রেমি তরুণদের মধ্যে।
বদলে যাওয়া সময়ের ধারাবাহিকতায় এখন আর কে মডেল এবং কে সাধারণ তা আলাদা করে বোঝার উপায় নেই! এখন মানুষের হাতে হাতে ক্যামেরা এবং সহজলভ্য হয়েছে প্রসাধনের উপকরণও।
গ্রামের সহজ-সরল কিশোরীটিও যুক্ত হচ্ছে ইন্টারনেটের সঙ্গে। পরিচিত হচ্ছে উন্নত জীবনব্যবস্থার সঙ্গে। নিঃসন্দেহে ইতিবাচক দিক।স্বস্তি ছিল যদি এই বিষয়গুলো শুধু ইতিবাচক দিক নিয়েই বজায় থাকতো।
কিন্তু তা তো হচ্ছে না। উন্নত, ঝলমলে এবং অন্যের চোখে ঈর্ষণীয় একটি জীবনের লোভে পড়ে নিতান্তই সাধারণ মেয়েটিও আজ `তারকা` তকমা পেতে উঠে পড়ে লেগেছে।
পথেঘাটে এখন কোনো অচেনা মেয়ের সঙ্গে দেখা হলেই আপনার মনে হবে, কোথায় যেন দেখেছি! আসলে কোথাও দেখেননি। সব মেয়েরই এক সাজ, একইরকম চুল কাটার ধরন, একই ঢঙে চোখে কাজলের টান, একইরকম গাঢ় করে আঁকা ভ্রুযুগল, একইরকম পোশাক-আশাক আপনাকে এমনটা ভাবতে বাধ্য করবে।
এভাবে না সাজলে লোকে `ক্ষ্যাত` ভাববে, এই পোশাক না পরলে লোকে আনস্মার্ট ভাববে, ফেসবুকে অমুককে ফলো না করলে লোকে সেকেলে ভাববে, এমন মানসিকতা থেকেই মেয়েরা হারিয়ে ফেলছে তাদের নিজস্বতা। অন্ধ অনুকরণের মধ্যে নিজের স্বকীয়তা কীভাবে বিলীন হয়ে যায়, `আধুনিকতা`র তালে তাল মেলাতে গিয়ে তা তারা একবারও টের পাচ্ছে না!
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এর প্রভাবটা সবচেয়ে বেশি লক্ষ করা যায়। প্রতিদিন নতুন ও আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড করে মোটামুটি হাজার দশেক ফলোয়ার জুটিয়ে ফেলতে পারলেই `বোকা` মেয়েগুলো নিজেদেরকে `তারকা` ভাবতে শুরু করে! তারকা হয়ে ওঠা যে কতটা সাধনার ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার, তা তাদের কল্পনারও বাইরে।
`এখনই চাই` নীতিটা সবদিক থেকে গ্রাস করে ফেলছে নতুন এই প্রজন্মকে। দেহ দেখিয়ে, সৌন্দর্য বিকিয়ে যে তারকা হওয়া সম্ভব নয় সেকথা তারা বুঝতে পারছে না। এরা মাতৃভাষা দিবসে কালো শাড়ি পরে নানা অঙ্গভঙ্গি করে ছবির জন্য পোজ দেয় বটে, তবে মাতৃভাষা দিবসের ইতিহাস জানে না! এরা বিজয় দিবসে লাল-সবুজ পোশাক পরে ঘুরে বেড়ায়, তবে স্বাধীনতা সংগ্রামের গৌরবময় ইতিহাস সম্পর্কে সঠিক ধারণা নেই অনেকেরই। নিজের জন্য যেটুকু সুবিধাজনক, ততটুকু নিয়েই এরা পরিতৃপ্ত থাকে।
ফেসবুকে জ্যাকুলিন মিথিলা নামের প্রায় নগ্ন এক মেয়ের আইডিতে দেখলাম ৪২, ৬৪৩ জন ফলোয়ার। জ্যাকুলিন মিথিলা পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের `পর্নস্টার` সানি লিওনের অনুসারী। বিভিন্ন ছবিতে সে সানি লিওনের স্টাইলে পোজ দিয়েছে।
দুঃখের বিষয় হলেও সত্যি, সামাজিক যোগাযোগের এই শক্তিশালী মাধ্যমটিতে জ্যাকুলিন মিথিলাদের সংখ্যা একেবারে কম নয়! জ্যাকুলিন মিথিলা বাংলাদেশের মেয়ে। এবং বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ। এদেশের নিজস্ব সংস্কৃতি, নিজস্ব রুচিবোধ, নিজস্ব আইন, নিজস্ব পতাকা, নিজস্ব ভুখণ্ড রয়েছে। সেসবের বাইরে গিয়ে তিনি এমনটা করলে তা নিশ্চয়ই নীতিবহির্ভূত। কারণ আমাদের সংস্কৃতি এবং আর্থসামাজিক মূল্যবোধের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই তা করা উচিত।
আমি বাজি ধরে বলতে পারি, যে ৪২,৬৪৩ জন ব্যক্তি জ্যাকুলিন মিথিলাকে ফেসবুকে ফলো করছেন, তাদের কেউ-ই নিজের মা-বোন কিংবা প্রিয়তমাকে জ্যাকুলিন মিথিলার স্থানে দেখতে সম্মত হবেন না!
সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিচারেই একটি দেশের সরকারপ্রধান নির্বাচিত হয়, সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিচারেই একটি দেশে আইনের প্রণয়ন হয়, সেই সংখ্যাগরিষ্ঠতার হিসাব করলে এদেশের অধিকাংশ সাধারণ মানুষই এমন নির্লজ্জ্ব উলঙ্গপনার বিপরীতে মত দেবে।
জ্যাকুলিন মিথিলারা তাদের দেশীয় ঐতিহ্য তুলে ধরুক, তারা কেন সানি লিওন হতে যাবে? তারকা হতে চাইলে কঠিন অধ্যবসায় করুক। বেগম রোকেয়ার মতো সমাজ সংস্কারক হয়ে; সুফিয়া কামাল, কামিনি রায়, জাহানারা ইমাম, রাবেয়া খাতুন, সেলিনা হোসেনের মতো সাহিত্যিক হয়ে; শাবানা, ববিতা, সুচরিতা, সুচন্দা, সুবর্ণা মুস্তাফাদের মতো অভিনেত্রী হয়ে, রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমিন, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার মতো কণ্ঠশিল্পী হয়ে; শামীম আরা নিপার মতো নৃত্যশিল্পী হয়ে; জোবেরা রহমান লিনু, রানি হামিদ, সালমা আকতারের মতো খেলোয়াড় হয়ে, নিশাত মজুমদার, ওয়াসফিয়া নাজরীনের মতো এভারেস্টজয়ী হয়ে বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে পরিচিত করুক।
অনুসরণ করার মতো এত এত উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত থাকতে আমরা কেন ভুল পথে পা বাড়াবো!
ফেসবুকে ছবি পোস্ট করা যার যার ব্যক্তিগত বিষয়। কিন্তু এর পেছনের উদ্দেশ্য যেন আমাদেরকে হীনমন্য করে না তোলে।
একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীন প্রজন্ম হিসেবে আমাদের জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আরো প্রসারিত, এবং মানবকল্যাণমুখী হওয়া উচিত।
ফেসবুকে একটি ছবি দেখিয়ে দুই-চার হাজার লাইক যে আমাদের ক্যারিয়ার, আমাদের জীবনকে প্রতিষ্ঠা করে দিতে পারে না, সেকথা যত দ্রুত আমাদের মাথায় ঢুকবে, ততই মঙ্গল।
ফেসবুকের আন্তর্জালিক মোহময়তার বাইরে বিশাল যে পৃথিবী রয়েছে, সেখানে আমাদের অবস্থান দৃঢ় হোক, আমাদের পায়ের নিচের মাটি শক্ত হোক যেন আমরা বাকিদেরকেও হাত ধরে টেনে তুলতে পারি।
উলঙ্গপনা নয়, অন্যের জন্য অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যাওয়াই হোক আমাদের লক্ষ্য।
লেখক : সাংবাদিক হাবীবাহ্ নাসরীন | আপডেট: ০৯:২৮ এএম, ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫, রোববার