Home / চাঁদপুর / একজন করোনাযোদ্ধার প্রস্থান ও স্মৃতিতে তার অবয়ব
করোনাযোদ্ধার
ডা. সুজাউদ্দৌলা রুবেল

একজন করোনাযোদ্ধার প্রস্থান ও স্মৃতিতে তার অবয়ব

কবির হোসেন মিজি:

জন্মিলে মরিতে হবে, এইতো নিয়ম খোদার দুনিয়ায়
তুমি যেমনি করে চলে গেলে
তেমনি করে কেউ কি বলো যায়….?

মৃত্যু চিরন্তন সত্য এমন গানের কথার মতোই আজ শোকাহত মনে বলতে হচ্ছে আপনি যেভাবে হঠাৎ চলে গেলেন। এভাবে চলে যাওয়াটা কখনো কাঙ্খিত ছিলোনা প্রিয়। কেনো আমাদের সবাইকে অদেখা দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে এভাবে হঠাৎ নিরবে চলে গেলেন…? কি এমন অভিমান জমা ছিলো আপনার মনে। কি এমন তাড়া ছিলো বুঝতে কষ্ট হয়। বিধাতা যে এত দ্রুত আপনাকে ডেকে নিবেন এমনটা ভাবিনি কখনো, কোনদিন। তবে এ যাওয়া শেষ যাওয়া হলেও আপনি চিরদিনই স্মৃতিতে বেঁচে থাকবেন অগনিত মানুষের মনের মণিকোঠায়। আপনি যে একজন মানবিক চিকিৎসক, একজন করোনাযোদ্ধা, একজন সেবক, একজন সহযোদ্ধা, একজন ভাই কিংবা বন্ধু। আবার আপনি আমার এবং আমাদের কেউ নন। তবুও যেনো কতো আপন, ভালোবাসার নিবির বন্ধনে কতো গভীর সম্পর্ক জড়িয়ে আছে আপনার সাথে। আপনার হঠাৎ প্রস্থানে যেনো মনের গভীরে অনবরত ঝর্ণা ঝরে পড়ছে। আপনি নেই…!

একথা ভাবতেই যেনো মনের ভেতর কি এক শূন্যতা বিরাজ করছে। যে শূন্যতা কখনো পূরণ হবার নয়। রুবেল ভাই বেঁচে নেই…! কি আশ্চর্য বিষয়, বিশ্বাস করতেই কষ্ট হচ্ছে। হাত পা গুলো খাটো হয়ে আসছে, বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠে বারংবার। মৃতমুখ খানা চোখে পড়তেই মনে হচ্ছে আপনি ঘুমিয়ে আছেন। সময় মতো জেগে উঠবেন। আবার মানুষের সেবায় বাসা থেকে গাড়ি করে দৌড়ে পৌছবেন হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে। এপ্রোন পড়ে রোগীদের বুকের উপর পেশার মেশিন রেখে পরীক্ষা শেষে প্রেসক্রিপশন লিখে দিবেন। রোগীরা সুস্থ হয়ে আল্লাহর দরবারে হাত উঠিয়ে আপনাকে দু,হাত ভরে দোয়া করবেন। হয়তোবা আমার মতো করে এমন কাল্পনিক ভাবেই আপনি মানুষের মনে বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল।

সেদিন আমি চাঁদপুরের বাহিরে, প্রথম যখন একজন শুভাকাঙ্খির কল পেয়ে জানতে পারলাম রুবেল ভাইয়ের অবস্থা তেমন ভালো নেই। তিনি জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রয়েছেন। তখনই যেনো বুকের ভেতর কেমন কম্পন শুরু হলো। সাথে সাথে ডাঃ মাহমুদুন্নবী মাসুম ভাই, ডাঃ ফরিদ আহমেদ চৌধুরী এবং বন্ধু ডাঃ ফেরদৌস নুরকে কল দিলাম। কেউই রিসিভ করছেনা। রুবেল ভাইয়ের অবস্থার সঠিক খবরটা পেতে পাগলের মতো কয়েকজনকে নক দিলাম। একসময় ডাঃ ফরিদ ভাই কল দিয়ে বললো- অবস্থা তেমন একটা ভালো নেই, তিনি লাইফ সার্পোটে রয়েছে, শেষ চেষ্টা চলছে। তখনই আল্লাহর কাছে ভাইয়ের নেক হায়াত কামনা করে সকলের দোয়া চেয়ে ফেসবুকে পোস্ট করেছিলাম। এর মাঝে একে একে সবাই তার মৃত্যুর সংবাদ পোস্ট দিচ্ছে। আমি বিশ্বাস করতে পারছিনা এবং সঠিক খবরটি পাচ্ছিনা বলে কোন পোস্ট দেইনি। কিন্তু ভাবিনি ১৫/২০ মিনিট পরেই আবার এই হাত দিয়ে ডাঃ রুবেল ভাইয়ের মৃত্যুর সংবাদের পোস্ট দিতে হবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফরিদ ভাই কল করে জানালো রুবেল ভাই জীবিত নেই। কথাটা শুনতেই স্তব্ধ গয়ে গেলাম। চোখে মুখে হতাশার ছাপ, কান দিয়ে যেনো গরম ধোঁয়া বেরুচ্ছে। অবুঝোর মতো অবলা হয়ে প্রিয় রুবেল ভাইয়ের প্রোপাইল থেকে একটি ছবি বেঁচে নিয়ে কোনরকম পোস্ট করলাম। চলেই গেলেন প্রিয় ডাঃ সুজাউদ্দৌলা রুবেল ভাই। আর বেশি কিছু লিখতে পারলাম না। কি লিখবো তখন, তার কোন ভাষা খুঁজে পায়নি। আমি যেনো এমন দুঃসংবাদে হতভম্ব হয়ে গেলাম।

যেভাবে এই প্রিয় মানুষটির সাথে আমার সু-সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো-

কোন একদিন দ্বি-প্রহরে হঠাৎই জিন্সের পকেটে থাকা মোবাইল ফোনটি বেজে উঠলো। একটি অপরিচিত নম্বর। রিসিভ করে সালাম দিয়ে অপর প্রান্তের কণ্ঠ শুনেই বুঝতে পারলাম খুব প্রিয় এবং সুপরিচিত একজন মানুষ। ওপাশ থেকে বললো-এই কবির আমি ডাঃ সুজাউদ্দৌলা, কোথায় আছো তুমি…? জ্বি ভাই আমি শহরেই আছি। তুমি একটু বেলভিউ হাসপাতালে আসো তো। তোমাকে একটা নিউজ করতে হবে। ওকে ভাই আসতেছি। প্রায় আধাঘন্টা পর বেলভিউ হাসপাতালের তৃতীয় তলায় রুবেল ভাইয়ের চেম্বারের সামনে গিয়ে তার দরজা নক করতেই তিনি মৃদু হেসে বললো- বসো। তারপর ভালো একটি সত্য সংবাদ করার জন্য ভাই আমাকে বিভিন্ন তথ্য দিয়ে বললো -তুমিও তোমার মতো করে সত্যটা যাচাই করে নিও। সেই থেকে নিজের মোবাইলফোনের গ্যালারিতে ডাঃ সুজাউদ্দৌলা রুবেল নামে তার নাম্বারটি সেভ করে রাখা হয়। কয়েকদিন পর ভাইয়ের দেয়া সেই তথ্য অনুযায়ী সংবাদটি প্রকাশ হওয়ার পর পত্রিকা নিয়ে তার কাছে গেলে তিনি আমার করা সংবাদটির বেশ প্রশংসা করে খুশি মনে আমাকে হাজার দুয়েক টাকা ধরিয়ে দিলো। আমিও মহা খুশিতে সেদিন থেকেই ভাইকে ভীষণ ভাবে ভালোবেসে ফেলি। তারপর থেকেই ডাঃ রুবেল ভাইয়ের সাথে আমার সু-সম্পর্ক গড়ে উঠে। আমার ফোন নাম্বার টিও ভাইয়ের ফোনটিতে সেভ করা ছিলো। তাই প্রায় বিভিন্ন বিষয়ে তিনি আমাকে কল করে নক দিতেন। আমিও হাসপাতাল সংক্রান্ত কোন বিষয়ে লিখলে রুবেল ভাইয়ের বক্তব্য এবং পরামর্শ নিতাম। এভাবেই চলতে থাকলো কয়েকটি বছর।

করোনাযোদ্ধার

 

ডাঃ সুজাউদ্দৌলা রুবেল ভাই বিভিন্ন প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি আড়াই শয্যা বিশিষ্ট চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসারের (আরএমও) দায়িত্বে থাকার কারনে প্রায়ই স্থানীয় সংবাদকর্মীরা বক্তব্য নেয়ার জন্য তার কক্ষে প্রবেশ করতেন। সবার সাথে আমিও তাই করতাম। এ সুবাদে তার টেবিলের সামনে বসে প্রায় বিভিন্ন গল্প কথা হতো। আর এমন ভালোবাসার সম্পর্কের কারনে মহামারী করোনা কালীন সময়ে প্রিয় রুবেল ভাই যে কতটা কষ্ট করে মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন সে দৃশ্য প্রতিদিন কাছ থেকে তা দেখেছি। যখনই তার কক্ষে উঁকি দিতাম, তখনই দেখতে পেতাম হাজারো করোনা,র রির্পোটের কাগজ তার সামনে টেবিল জুড়ে উচু হয়ে আছে। আর সেই কাগজ গুলো তিনি একে, একে মার্কিং কলমের আঁচরে চিহ্নিত করতেন কোনটা নেগেটিভ আর কোনটা পজেটিভ। এর মাঝে আমাদের মতো সংবাদকর্মী, আত্মীয়, স্বজন এবং পরিচিতজনদের তাগিদ থাকতো যাতে তাদের রির্পোটটি একটু আগে দেয়া হয়। এত ব্যস্ততার মাঝেও কখনো কারো আবদার অধিকার তিনি এরিয়ে যেতেন না। সকাল থেকে শুরু করে রাত পর্যন্ত এমন কঠিন ব্যস্থতার মাঝেও কখনো তিনি পরিচিতজনদের সাথে বিরক্ততা দেখাতেন না। তখকার এমন ভয়াবহ মহামারীতে মানুষের কল্যানে কাজ করতে দেখে তিনি হয়ে উঠেন একজন মানবিক চিকিৎসক। ধীরে ধীরে র্নিদ্বিদায় মানুষের মনে গভীর জায়গা করে নিয়েছিলেন তিনি। তাই হয়তো তার মৃত্যুর সংবাদ শোনার মুর্হুতেই চাঁদপুরবাসির ফেসবুক জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে তার মৃত্যুর খবর এবং তার প্রতি শোক ও শ্রদ্ধা। এ মৃত্যু যেনো কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারেননি চিকিৎসক সমাজসহ চাঁদপুরবাসিও। এমন একজন মানবিক চিকিৎসকের মৃত্যুতে সেদিন সর্বত্র ছিলো গভীর শোকের ছাঁয়া। যা এখনো অনেকের মনে দাগ কেটে যায়।

করোনাবালীন থেকে শুরু করে যখনই তার কক্ষের গ্লাসটা টেনে সালাম দিতাম। তখনই রুবেল ভাই মুছকি হেসে বলতো – কি রে তোর খবর কি…? কিছু বলবি…? আচ্ছা তাহলে ফ্রি হলে আসিস। আবার কখনো কখনো কোন সংবাদের বিষয়ে বলতো-তুই পরে কল দিস, আমি জানিয়ে দিবো। এছাড়াও অনেক সময় তিনি নিজেও কল দিয়ে বলতেন -এই কবির একটু দেখা করিস তো। একদিন আমার একজন রোগীকে ঢাকা রেপার করার বিষয়ে ভাইয়ের সাথে দুটি কথা বলেছিলাম। তখন রুবেল ভাই, আমাকে ছোট ভাইয়ের মতো অধিকার খাটিয়ে চিকিৎসার বিষয়ে বুঝিয়ে বলে-শাসনের মতো রাগারাগি করেছিলেন। আমি তাতে মোটেও কষ্ট পাইনি। তার কয়েকদিন পরেই একদিন তার এবং আমার পরিচিত একজন মানুষ নিয়ে উনার চেম্বারে যেতেই বললো- কবির তো আমার খুব কাছের মানুষ। ওরে ঐদিন অনেক বকা দিয়েছি। ওরে ভালোবাসি তো তাই বকা দিলাম। এরে তুই কি রাগ করেছিস…? না ভাই মোটেও না। আমার হাসিমুখে এমন উত্তর শুনে রুবেল হেসে বললো-ঠিক আছে তুই বস আমি একটু উনার সাথে কথা বলি। এসব স্মৃতিগুলো আজ বার বার হৃদয়কে নাড়া দিয়ে যায়। চোখ বন্ধ করে এসব ভাবতেই যেনো শরীর শিউরে উঠে। আর কখনো, কোনদিন এমন করে কথা বলা হবেনা প্রিয় মানুষটির সাথে। আর কখনো কোনো আবদার অধিকার নিয়ে তার সামনে দাঁড়াতে পারবোনা। আর কখনোই দেখা হবেনা প্রিয় মুখখানি।

ওপারে ভালো থাকবেন প্রিয়জন। আপনার ডাক্তারি জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এবং করোনাকালীন সময়ে যেসব মানুষকে চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন। এমন মানবসেবার উচিলায় যেনো মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আপনার জীবনের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দিয়ে জান্নাতুল ফেরদাউস নসীব করেন। আমিন।

ফুল ফুটে ঝরে যায়, এই তো রীতি
মানুষ মরে যায়, রেখে যায় স্মৃতি…..! তেমনি ভাবে আপনি পৃথিবীর বাগান থেকে ঝরে পড়লেও আপনার রেখে যাওয়া ভালো কাজ এবং মানবসেবার জন্য মানুষের মনে স্মৃতি হয়ে বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল।

লেখক পরিচিতি : সংবাদকর্মী, গীতিকার ও লেখক