চাঁদপুর

আমদানীকৃত ইলিশসাদৃশ্য শ্যাড ফিশে হুমকিতে প্রকৃত ইলিশ

দেশে ইলিশের উৎপাদন বাড়ার পাশাপাশি প্রতিবছর আমদানির পরিমাণ লাফিয়ে বাড়ছে। গত অর্থবছরের তুলনায় এ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে আমদানি বেড়েছে আড়াই গুণের বেশি।

দেশে যখন ইলিশ ধরা বন্ধ থাকে তখনি ইলিশসদৃশ্য শ্যাড ফিশ আমদানী করে কিছু অসাধু ব্যবসায়ীরা।

বিদেশি ইলিশের পাশাপাশি ওমান থেকে আমদানি হচ্ছে ইলিশসদৃশ শ্যাড ফিশ। মৎস্য অধিদপ্তরের মতে, এই মাছে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর সিসা ও ক্যাডমিয়াম রয়েছে।

তাছাড়া ইলিশের দামে এসব মাছ কিনে প্রতারিত হচ্ছেন ক্রেতারা।

এতে দেশি মৎস্যজীবী ও ইলিশ জেলেরা ব্যবসায়িক ক্ষতির মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সৈয়দ আরিফ আজাদ বলেন, ‘দেশে গত অর্থবছরে ৩ লাখ ৯৮ হাজার টন ইলিশ মাছ উৎপাদিত হয়েছে। চাহিদার প্রায় সমপরিমাণ সরবরাহ রয়েছে। এ অবস্থায় ইলিশ আমদানির প্রয়োজন নেই বললেই চলে। কারণ, আমদানি বাড়লে দেশের মৎস্যজীবীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এসব ভেবেই আমরা ইলিশ আমদানিকে নিরুৎসাহ করার ব্যাপারে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে মতামত দিয়েছি।’

মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, চট্টগ্রামের তথ্য অনুসারে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরের মার্চ মাস পর্যন্ত আট মাসে বিদেশ থেকে ২৬০০ দশমিক ৪২২ মেট্রিক টন ইলিশ মাছ আমদানি করা হয়েছে, যা আগের অর্থবছরগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। জুন মাসে এ অর্থবছর শেষ হতে যাচ্ছে। আগের অর্থবছরের তুলনায় আমদানি তিন গুণ বেশি হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।

২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৪৯৫ দশমিক ৮১৫ মেট্রিক টন ইলিশ আমদানি করা হয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চসংখ্যক ইলিশ এসেছে সিঙ্গাপুর থেকে, তা হচ্ছে ২৪০ দশমিক ৯৫ মেট্রিক টন। মিয়ানমার থেকে আমদানি হয়েছে ১৯৩ দশমিক ৪৭ মেট্রিক টন এবং মালয়েশিয়া থেকে আমদানি হয়েছে ৬১ দশমিক ৩৯৫ মেট্রিক টন ইলিশ।

২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১০৯৩ দশমিক ৭৩৮ মেট্রিক টন ইলিশ আমদানি করা হয়েছে তিন দেশ থেকে। ওই বছর মিয়ানমার থেকে সর্বোচ্চসংখ্যক ইলিশ আমদানি করা হয়েছে। এর পরিমাণ ৮১৪ দশমিক ৬৪৮ মেট্রিক টন। এরপরই মালয়েশিয়ার অবস্থান। সেখান থেকে ১৫০ দশমিক ৫৫০ মেট্রিক টন ইলিশ আমদানি করা হয়েছে। আর সিঙ্গাপুর থেকে আমদানি করা হয়েছে ১২৮ দশমিক ৫৪০ মেট্রিক টন।

এর বাইরে ওমান থেকে শ্যাড ফিশ নামে ইলিশসদৃশ একটি মাছ আমদানি করা হচ্ছে। এটা স্থানীয় বাজারে চন্দনী ও কলম্বো নামে বাজারজাত হয়। ইলিশ ভেবে এ মাছগুলো কিনে প্রতারণার শিকার হন ক্রেতারা। এ মাছ স্বাস্থ্যকর নয় বলেও মনে করছে মৎস্য অধিদপ্তর। এ অর্থবছরের মার্চ মাস পর্যন্ত ওমান থেকে শ্যাড ফিশ এসেছে ৭ হাজার ৭২৯ মেট্রিক টন।

মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্রমতে, ২০১৪ সালে শ্যাড ফিশের কিছু নমুনা পরীক্ষা করে এতে সিসা ও ক্যাডমিয়ামের উপস্থিতি পাওয়া যায়, মানবদেহের জন্য যা ক্ষতিকর।

এ ছাড়া বরফায়িত ও হিমায়িত মাছগুলো প্যাকেটজাত হওয়া থেকে আমদানি ও বাজারজাতকরণের বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় ক্রেতার কাছে পৌঁছাতে কয়েক মাস সময় লেগে যায়। ফলে সাধারণভাবেও তা মানবদেহের জন্য স্বাস্থ্যকর নয়।

এ প্রসঙ্গে মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সৈয়দ আরিফ আজাদ বলেন, ‘শ্যাড ফিশের ক্ষেত্রে কিছু নমুনা পরীক্ষা করে “ভারী ধাতুর” উপস্থিতি পাওয়া গেছে। গত বছরের শুরুতে এ বিষয়ে আমরা মতামত দিয়েছি মন্ত্রণালয়ে। পরে মন্ত্রণালয় তা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেছে। তবে এখনো এ ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।’

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, আমদানি নিষেধাজ্ঞা না থাকায় বিদেশি ইলিশের পাশাপাশি ইলিশসদৃশ শ্যাড ফিশ আমদানি অব্যাহত রয়েছে।

গোয়ালন্দের মাছ ব্যবসায়ী মো. বাদল বিশ্বাস বলেন, আমদানিকারকদের কাছ থেকে বরফায়িত ও হিমায়িত বিদেশি ইলিশ কিনে থাকেন তাঁরা। সাধারণত এই ইলিশগুলো বছরের মার্চ থেকে জুন মাস পর্যন্ত দেশি ইলিশের বিকল্প হিসেবে বেশি বিক্রি হয়। কারণ, এই মৌসুমে দেশি ইলিশ মাছ ধরা বন্ধ থাকে।

তিনি জানান, আমদানি করা ৪০০ থেকে ৫০০ গ্রাম আকারের ২৩টি ইলিশের (১০ কেজি ওজন) প্যাকেট ৩০০ টাকা কেজি দরে আমদানিকারকের কাছ থেকে কেনেন। বিক্রি করেন প্রতি কেজি ৩৩০ টাকায়। হিমায়িত দেশি ইলিশের ক্ষেত্রে এ দাম বেশি। এই সময় একই পরিমাণ দেশি ইলিশ কোল্ড স্টোরেজ থেকে প্রতি কেজি ৪০০ টাকায় কিনে বিক্রি করেন ৪২০ টাকায়। স্থানীয় বাজারে ৫০০ গ্রাম ওজনের একটি দেশি ইলিশ ২৫০ টাকায় বিক্রি করেন। সেখানে মিয়ানমারের ইলিশের দাম পড়ে ২২০ টাকা। ওমানের শ্যাড ফিশ, যেটা স্থানীয়ভাবে চন্দনী ও কলম্বো নামে পরিচিত, তা প্রতি কেজি ৯০ টাকা করে বিক্রি করেন।

এ মাছগুলো মৌসুমি মাছ বিক্রেতারা ইলিশ নামে গ্রামাঞ্চলের মানুষের কাছে বিক্রি করেন বলে স্বীকার করেন বাদল বিশ্বাস। তিনি বলেন, এ ধরনের মাছগুলো উত্তরবঙ্গে বেশি বিক্রি হয়। দাম কম বলে ক্রেতাদেরও আগ্রহ রয়েছে। বৈশাখে সিলভারের পাতিলে করে হেঁটে হেঁটে বিক্রি করেন মৌসুমি বিক্রেতারা। মাছগুলো কেটে লবণ দিয়ে বরিশালের লোনা ইলিশ বলে গ্রামের সাধারণ ক্রেতাদের ঠকানো হয়।

জাহাঙ্গীর আলম নামের এমনই এক মৌসুমি মাছ বিক্রেতা বলেন, পয়লা বৈশাখের আগে ১০ থেকে ১২ দিন ধরে একটি দলের সঙ্গে তিনি গোয়ালন্দ উপজেলার কয়েকটি গ্রামে হেঁটে হেঁটে মাছ বিক্রি করেছেন। ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলা থেকে এ মৌসুমে মাছ বিক্রি করতে এসেছেন। তবে মাছগুলোকে তিনি ইলিশ বলে দাবি করেন। তিনি জানান, ২০০ টাকা হালি দরে কিনে এনে প্রতিদিন ২২ থেকে ২৩ হালি ‘ইলিশ’ ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকা হালি হিসেবে বিক্রি করেছেন।

দেশের মৎস্যজীবীদের কথা চিন্তা করে বিদেশ থেকে ইলিশসহ সামুদ্রিক মাছ আমদানি নিরুৎসাহিত করা উচিত বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এম নিয়ামুল নাসের।

তিনি বলেন, দেশের অভ্যন্তরীণ জলাশয় (মুক্ত ও বদ্ধ) থেকে ৮৩ দশমিক ৭২ শতাংশ মাছ উৎপাদিত হয়। আর সামুদ্রিক জলাশয় থেকে উৎপাদিত হয় ১৬ দশমিক ২৮ শতাংশ। মোট ১৩ লাখ ১৬ হাজার জেলে মাছ ধরে থাকেন।

এর মধ্যে সামুদ্রিক জেলে আছেন ৫ লাখ ১৬ হাজার। এ বিপুলসংখ্যক মানুষ এই পেশার ওপর নির্ভরশীল। তাই আমদানি এ হারে বাড়লে এই পেশাজীবীরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

নিউজ ডেস্ক
আপডেট, বাংলাদেশ সময় ৮: ১৩ পিএম, ২২ এপ্রিল ২০১৭, শনিবার
ডিএইচ

Share