‘আমি হানড্রেড পারসেন্ট চাটগাঁর মেয়ে’

‘ছোটবেলায় প্রতিবছর শীতকালে আমরা গ্রামের বাড়িতে যেতাম। গ্রামের বাড়ির হলুদ সরিষা ক্ষেত, পুকুর পাড়ে এক কাঠির ওপর শিমের বাগান, পিঠা বানানোর জন্য ঢেঁকিতে চাল গুড়ো করা, সব সবকিছু আমার খুব মনে পড়ে। আমার গ্রাম আমাকে খুব টানে। আমি বুকে হাত দিয়ে বলি, আমি বাংলাদেশের মেয়ে, তার চেয়েও বেশি আমি চট্টগ্রামের মেয়ে, তার চেয়েও বেশি আমি সীতাকুণ্ডের মেয়ে।’

শৈশব-কৈশোরের সুখস্মৃতি মোড়ানো জনপদ চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড নিয়ে কথোপকথনে এভাবেই আবেগ ঝরে পড়ল থাইল্যান্ডে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সাঈদা মুনা তাসনিমের কন্ঠে। ব্যাংককের সুখুমভিতের আকামাই গলিতে বাংলাদেশ দূতাবাসে বসে সাঈদা মুনা যখন স্মৃতির ঝাঁপি খুলছিলেন তখন বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। মেঘ ভরপুর আকাশের দিকে তাকিয়ে সাদিয়া মুনা কখনও স্মৃতিকাতর হয়েছেন, কখনও আবেগাপ্লুত হয়েছেন।

সাঈদা মুনা তাসনিমের বাবার বাড়ি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার জাফরনগরে। বাবা সরকারি চাকরি করতেন, সেই সূত্রে ঢাকায় তার জন্ম, বেড়ে ওঠা, পড়ালেখা। বুয়েট থেকে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে প্রথমে যোগ দেন বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশনে প্ল্যানিং ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে। ১৯৯৩ সালে যোগ দেন ফরেন ক্যাডারে। লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনে, নিউইয়র্ক জাতিসংঘ মিশনে কাজ করেছেন। ২০১৪ সাল থেকে আছেন থাইল্যান্ডে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে। তিন সন্তানের জননী সাঈদা মুনা তাসনিমের শ্বশুরবাড়ি চট্টগ্রাম শহরের পাঁচলাইশে।

জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকায় হলেও চট্টগ্রামের প্রতি আলাদা টান আছে বলে জানালেন সাঈদা মুনা তাসনিম। তিনি বলেন, প্রতি বছর শীতে এবং দুই ঈদে আমরা বাড়ি যেতাম। শহরের পাথরঘাটায় আমাদের একটা বাড়ি আছে সেখানে যেতাম। গ্রামের পুকুর, সবুজ ঘাস, মাটির গন্ধ আমাকে খুব টানে।

‘শীতকালে ভোরে উঠে খেজুর গাছ থেকে রসের হাঁড়ি নিয়ে ঘরে ফেরা, নারকেল আর চালের গুড়া দিয়ে পিঠা বানিয়ে খেজুরের রস দিয়ে খাওয়া, কোরবানির ঈদে প্রতিবেশিদের কাছে গিয়ে গোশত ভিক্ষা করে আনা, পুকুরে জাল ফেলে বাবা-চাচাদের বড় বড় মাছ ধরা সবকিছু আমি ভীষণভাবে মিস করি। ’

‘সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড়ে পায়ে হেঁটে ওঠা, বাড়বকুণ্ড, বিভিন্ন মঠ-মন্দিরে ঘুরে বেড়ানো, বাড়ি থেকে কয়েক মিনিট হেঁটে সাগর পাড়ে চলে যাওয়া, কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকত, রামুতে বৌদ্ধদের প্যাগোডাগুলো, মহেশখালীর আদিনাথ মন্দির আমি খুব খুব মিস করি।’

‘আমি খুবই গর্ব অনুভব করি যে আমি চট্টগ্রামের মেয়ে। আমার কোন পরিচয় সংকট নেই। আমি হানড্রেড পারসেন্ট চাটগাঁর মেয়ে। চট্টগ্রামের সঙ্গে আমার নাড়ির টান। ’ বলেন সাঈদা মুনা তাসনিম।

প্রগতিশীল পরিবারে বেড়ে ওঠা সাঈদা মুনা তাসনিম ছায়ানটে দু্ই বছর গান শিখেছেন। সব ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের শিক্ষাটা সেই ছোটবেলা থেকেই অন্তরে গেঁথে নিয়েছেন। চট্টগ্রামে সূর্য সেন-প্রীতিলতাদের বৃটিশবিরোধী আন্দোলন, অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক চেতনা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ সাঈদা মুনাকে গভীরভাবে আবেগতাড়িত করে।

‘আমার ইচ্ছা আছে কোন একসময় চট্টগ্রামকে নিয়ে একটা ছবি বানাব। সূর্য সেন, প্রীতিলতাদের বীরত্বগাঁথা, চট্টগ্রামের ইতিহাস-ঐতিহ্য, বঙ্গবন্ধুর মূলনীতিকে চট্টগ্রাম যেভাবে লালন করে, অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্যের কথা সেই ছবিতে তুলে ধরবো।’ বলেন সাঈদা মুনা।

‘কৌশলগত কারণে মোঘল আমল, বৃটিশ আমল থেকে এখনও পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিশ্বের কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ চট্টগ্রাম দুই দেশের সঙ্গে বর্ডার শেয়ার করে। বে অব বেঙ্গল আছে। আমি যখনই সুযোগ পাই, তখনই চট্টগ্রামের কথা তুলে ধরি। বিশ্বমানের বন্দরনগরী হিসেবে চট্টগ্রাম যেন গড়ে ওঠে সেজন্য আমি আমার অবস্থান থেকে চেষ্টা করে যাব।’ বলেন সাঈদা মুনা।

তিনি বলেন, চট্টগ্রামকে অবশ্যই দুবাই, হংকং কিংবা সিঙ্গাপুরের আদলে গড়ে তোলা সম্ভব। চট্টগ্রামের সব ধরনের সম্ভাবনা আছে। চট্টগ্রাম বন্দরকে একটি গ্লোবাল বন্দর হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। এই ভিশন থাকা উচিত।

‘চট্টগ্রামের পতেঙ্গা, সন্দ্বীপ, কক্সবাজারের সেন্টমার্টিনকে আমরা বিশ্বে ব্র্যান্ডিং করতে পারি। চট্টগ্রামকে পর্যটন নগরী হিসেবে গড়ে তোলার অপার সম্ভাবনা আছে। রাষ্ট্রের উচিত চট্টগ্রামকে আরও গুরুত্ব দেয়া। মিডিয়ার উচিত চট্টগ্রামকে আরও হাইলাইট করা।’

সাঈদা মুনা বলেন, চট্টগ্রামের ইতিবাচক দিকগুলো, প্রাকৃতিক পরিবেশ, নান্দনিকতা আর বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনার কথা আরও তুলে ধরা দরকার। সীতাকুণ্ড শিপ ব্রেকিংয়ের কারণে পরিচিতি পাচ্ছে। অথচ সীতাকুণ্ডের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা আমরা তুলে ধরতে পারিনি।

‘আমি কয়েক বছর আগে চট্টগ্রামে গিয়েছিলাম। ট্রাফিক সিস্টেম আর ময়লা-আবর্জনা দেখে আমি খুব হতাশ হয়েছিলাম। আমাদের পাহাড়তলী, এত সুন্দর একটা জায়গা অথচ অবহেলায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। চট্টগ্রামের একদিকে পাহাড়, একদিকে সাগর, এত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সেটা আমরা হারিয়ে ফেলছি। চট্টগ্রামকে বাঁচাতে হবে। এজন্য সবাই মিলে চট্টগ্রাম শহর বাঁচাও কমিটি করা দরকার। ’ বলেন সাঈদা মুনা।

‘আমি বাংলাদেশের মেয়ে, আমি বাংলাদেশকে ভালবাসি। আমি চট্টগ্রামের মেয়ে, আমি চট্টগ্রামকে ভালবাসি। আমি বুক উঁচু করে সবাইকে বলি, আমি বাংলাদেশের মেয়ে, আমি চট্টগ্রামের মেয়ে।’ এভাবেই কথোপকথন শেষ করলেন থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ইতিহাসে একমাত্র নারী রাষ্ট্রদূত সাঈদা মুনা, যার বাড়ি চট্টগ্রামে। (ছবি ও প্রতিবেদন সূত্র- বাংলা নিউজ)

:  আপডেট, বাংলাদেশ সময় ০৪:২০ পিএম,  ৩১ মে  ২০১৬, মঙ্গলবার

ডিএইচ

Share