হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গ বলে আমরা যাদের দূরে সরিয়ে রাখি, তারা আসলে এ সমাজেরই অংশ। তাদেরও অধিকার আছে মাথা উঁচু করে ভালোভাবে বাঁচার। আর তাদের সে অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব আমাদেরই। এসব নিয়ে লিখেছেন মো: আবদুস সালিম
সম্প্রতি রিকশায় চড়ে মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর থেকে মিরপুর ২ নম্বর যাচ্ছিলাম আমাদের আত্মীয়ের এক বিয়ের অনুষ্ঠানে। আমাদের রিকশা মিরপুর ২ নম্বর পৌঁছার একটু আগেই কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগে একটি হিজড়ার দল আমাদের রিকশাকে প্রায় ঘিরে ফেলে। তাতে আমি শুধু বিব্রতই হইনি, বরং রীতিমতো ভয়ও পেয়ে যাই।
তাদেরই একজন (হিজড়াদের) আমার একেবারে সামনে এসে বলে, ‘মামা কই যাইতাছো? আমাগোরে কিছু দিয়া যাইবা না?’ তখন আমি তাদের কাছ থেকে দ্রুত সরে যেতে আমার পকেট থেকে ১০ টাকার একটি নোট তার হাতে দিতে চাওয়া মাত্র সে বলে, ‘আমরা এতজন মানুষ আর টাকা মাত্র ১০টা! মামা ২০ টাকা না দিলে যাইতেই দিমু না।’ তখন বাধ্য হয়ে তাদের খুশি করিয়েই কৌশলে সেই স্থান ত্যাগ করি।
শুধু আমি কেন, এভাবে কত মানুষ প্রতিদিন হিজড়াদের এসংক্রান্ত সমস্যায় পড়ে তার কোনো হিসাব নেই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে হেনস্তা করা দৃশ্যও অনেকের চোখে পড়ে।
অনেকের অভিযোগ, হিজড়ারা নানা ধরনের অপরাধের সাথেও যুক্ত। এরা সুযোগ পেলে পথচারীকে পথরোধ করে পকেটে হাত ঢুকিয়ে দেয়। বিভিন্ন বাজারে গিয়ে দোকানে দোকানে চাঁদা আদায় করে। তা দিতে বিলম্ব হলে অনেক সময় দোকানে থাকা পণ্য নিয়েই সটকে পড়ে। তাদের কিছু বলতে গেলেই অশ্লীল গালাগাল দেয়। নানা রকম বাজে অঙ্গভঙ্গিও করে। মান-সম্মানের কারণে অনেকেই তাদের এড়িয়ে চলে। এরা সহজ-সরলদের ধরে বেশি। অনেক সময় সাথে থাকা শিশুরা পর্যন্ত ভয় পায়। চিৎকারও দেয়। অনেক সময় দোকানিকে হুমকি দিয়ে বলে- ‘ট্যাকা দে, নইলে দোকান সাফ অইয়া যাইবো।’
কিছু হিজড়া বাসাবাড়িতে গিয়ে লোকদের নানা সমস্যায় ফেলে দেয়। বিশেষ করে যখন বাসায় পুরুষ না থাকে তখনই এরা বেশি আসে। এখানে এসেও বাসার মহিলাদের কাছে টাকা, কাপড় প্রভৃতি ভয় দেখিয়ে বা চাপ প্রয়োগ করে আদায় করে।
প্রশ্ন হলো, যেখানে সাধারণ মানুষ তাদের প্রতি সহানুভূতি থেকেই সহযোগিতা করতে পারে সেখানে এভাবে কেন টাকা আদায় করা হয়? এর ফলে তাদের প্রতি সাধারণ মানুষের সহানুভূতি নষ্ট হয়।
নীলা নামের এক হিজড়াকে এসব না করার পরামর্শ দিলে সে বলে, ‘মাইনষের কাছ থেইকা টাকা না নিলে আমরা বাঁচুম কেমনে? কেউই তো আমাগো দেহে না। কোনো কারণে মাইনষের কাছে গেলে তারা আমাগো দূরে সরাইয়া দেয়। আমগো চাকরি দিলে আপনাগো আর বিরক্ত করতাম না।’
প্রকৃত সত্য হলো, হিজড়ারা আমাদের সমাজেরই মানুষ বা একটি অংশ। তাদের অবহেলা করা ঠিক নয় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এ ব্যাপারে সরকার যতটুকু তৎপর হয়েছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম।
অনেক হিজড়া জানেও না সরকার তাদের ব্যাপারে কিছু করছে। আর এ কারণেই এখন পর্যন্ত তারা অবহেলিত জনগোষ্ঠী। অনেকে তাদের হিজড়া বলার পাশাপাশি হিজলাও বলে থাকেন। হিজড়াদের অনেকেই বলে- ‘আমগো যা খুশি কন কিন্তু হিজলা কইয়েন না।’ এ শব্দটিকে তারা গালাগালের মতো মনে করে।
আসলে হিজড়াদের ভাগ্যের পরিবর্তন কবে আসবে তা বলতে পারছেন না কেউই। কারণ আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত হিজড়া জনগোষ্ঠীর সঠিক তথ্য বা পরিসংখ্যান নেই। এ ব্যাপারে সমাজসেবা অধিদফতরকেই আগে এগিয়ে আসতে হবে বলে মনে করছেন সমাজবিজ্ঞানীরা।
তবে ২০১২ সালে এসংক্রান্ত এক জরিপ চালিয়েছিল সমাজসেবা অধিদফতর। তাতে দেখা গেছে, হিজড়া জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৯ হাজারের কিছু বেশি। তবে অনেকে বলেন, তাদের সংখ্যা আরো বেশি হতে পারে। কারণ, তাদের আজকাল একটু বেশিই দেখা যায়। তবে অনেক সময় এসব ব্যাপারে এগিয়ে আসে এনজিও ও আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র। যেমন আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র এসংক্রান্ত জরিপ চালিয়ে এদের সংখ্যা ৯ হাজার হতে পারে বলে জানিয়েছে।
তবে কিছু কিছু হিজড়া নিজের চেষ্টায়ই ভাগ্যের পরিবর্তন করছে বলে জানা গেছে। যেমন অনেকে পড়ালেখা করছে চাকরি পাওয়ার আশায়। এমন শ্রেণীর হিজড়াদের সরকারের পক্ষ থেকে কমবেশি সহযোগিতা করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
এ ধরনের কিছু কর্মসূচিও নাকি নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে শিক্ষাবৃত্তি, নানা কাজের প্রশিক্ষণ দেয়া ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। অনেক সময় তাদেরকে অনুদান, ভাতা ইত্যাদি দানের কথা শোনা যায়।
তবে এ ধরনের ভাগ্যবানের সংখ্যা খুবই কম। অনেক হিজড়া জানেই না যে, সরকারি-বেসরকারিভাবে তাদের জন্য এ ধরনের কিছু করা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকার গুলিস্তানের বাংলাদেশ হিজড়া কল্যাণ ফাউন্ডেশন, কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আবিদা সুলতানা মিতু বলেন, ‘আমাদের দেশের হিজড়া জনগোষ্ঠী আমাদের সমাজেরই মানুষ। অথচ এখন পর্যন্ত তারা খুবই অবহেলিত। আমি মনে করি, তাদের অধিকার প্রদান নিশ্চিত করতে সরকারি-বেসরকারিভাবে নানা কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া দরকার অবিলম্বে। প্রথমে দরকার তাদের সামাজিক স্বীকৃতি। তাদের উন্নতির জন্য তহবিল আরো বাড়ানো দরকার। তা সঠিক কাজে লাগছে কি না তাও দেখা দরকার সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের। সমাজে থেকে তারা তৃতীয় লিঙ্গ (হিজড়া), মাইনাস জেন্ডার ইত্যাদি হিসেবে পরিচিত হবে, যা কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না।’
এ ব্যাপারে সাধারণ জনগোষ্ঠীকেও এগিয়ে আসা দরকার বলে মনে করেন আবিদা সুলতানা মিতু।
তিনি আরো বলেন, ‘তবে বর্তমানে অনেক হিজড়াই লেখাপড়া ও কাজ করছেন। এ ব্যাপারে তাদেরকে উৎসাহ দিতে হবে। তাদের মধ্যে যারা বেশি মেধাবী ও কর্মঠ তাদেরকে ভালো কাজ বা চাকরি করার সুযোগ দিলে আরো ভালো হবে। তাতে করে তারা আর অবহেলিত জনগোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত হবে না। এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে সমাজে। এ ব্যাপারে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়বদ্ধতা যেন একটু বেশিই।’ -নয়াদিগন্ত
নিউজ ডেস্ক : আপডেট, বাংলাদেশ সময় ২:৩০ এএম, ২ সেপ্টেম্বর ২০১৬, শনিবার
ডিএইচ