Home / সারাদেশ / আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা : জাবি বন্ধ ঘোষণা করে হল ছাড়ার নির্দেশ
ju-victim
৫ নভেম্বর ২০১৯, হামলায় আহত এক শিক্ষার্থীকে উদ্ধার করার চেষ্টা করছেন অপর এক শিক্ষার্থী। ছবিসূত্র: ডেইলি স্টার

আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা : জাবি বন্ধ ঘোষণা করে হল ছাড়ার নির্দেশ

দুর্নীতির অভিযোগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের অপসারণ দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়েছে শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।

৫ নভেম্বর মঙ্গলবার দুপুর পৌনে ১২টা থেকে সোয়া ১২টা পর্যন্ত উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থানরত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর এ হামলার ঘটনা ঘটে। এতে আট শিক্ষকসহ অন্তত ২৫ জন আহত হয়েছেন। এ ছাড়া দায়িত্ব পালন করার সময় চার সাংবাদিককেও মারধর করে আহত করেছে ছাত্রলীগের কর্মীরা।

এ ঘটনার পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের আজ বিকেল সাড়ে ৪টার মধ্যে হল ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, উপাচার্যের অপসারণ দাবিতে গতকাল সোমবার সন্ধ্যা ৭টা থেকে উপাচার্যের বাসভবন ঘেরাও করে রেখেছিলেন ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’ ব্যানারে আন্দোলনরত শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। আজ বেলা সোয়া ১১টার দিকে উপাচার্য সমর্থক শিক্ষক-কর্মকর্তারা উপাচার্যকে বাসা থেকে বের করে তাঁর কার্যালয়ে নিয়ে যেতে আসেন। এ সময় উপাচার্য সমর্থক শিক্ষক ও আন্দোলনকারীদের সঙ্গে উত্তপ্ত বাকবিতণ্ডা চলতে থাকে।

এর মধ্যেই দুপুর পৌনে ১২টার দিকে জাবি শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. জুয়েল রানার নেতৃত্বে একটি মিছিল উপাচার্যের বাসভবনের সামনে আসে। তারা সেখানে অবস্থান নেওয়া আন্দোলনকারীদের চলে যেতে বলেন। এ সময় দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে আন্দোলনকারীরা রাস্তায় শুয়ে পড়েন। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তখন আন্দোলনকারীদের এলোপাতাড়ি লাথি-কিল-ঘুষি দিয়ে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এ সময় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের একাধিক শিক্ষকসহ কয়েকজন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীকে চ্যাংদোলা করে দূরে নিয়ে ফেলতে দেখা যায়।

মারধরের সময় উপাচার্য সমর্থক শিক্ষক সোহেল আহমেদ, নাসির উদ্দিন, আতিকুর রহমান, আবদুল মান্নান চৌধুরী, নজরুল ইসলাম, আশরাফুল ইসলাম, মাহমুদুর রহমান জনিসহ কয়েকজনকে ‘ধর ধর’, ‘জবাই কর’ ও ‘মার মার’ বলে চিৎকার করতে দেখা গেছে। হামলা চলাকালে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশকে নীরব ভূমিকা পালন করতে দেখা গেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তাঁরা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

হামলায় আট শিক্ষকসহ অন্তত ২৫ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এ ছাড়া দায়িত্ব পালন করার সময় চার সাংবাদিককেও মারধর করে আহত করেছে ছাত্রলীগ কর্মীরা। আহতদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আটজনকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়েছে বলে জানান জাবি চিকিৎসাকেন্দ্রের চিকিৎসক রেজওয়ানুর রহমান।

আহত শিক্ষকরা হলেন নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাইদ ফেরদৌস, মীর্জা তাসলিমা সুলতানা, দর্শন বিভাগের অধ্যাপক রায়হান রাইন, প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক খন্দকার হাসান মাহমুদ, বাংলা বিভাগের অধ্যাপক শামীমা সুলতানাসহ আরো কয়েকজন।

মারধরে আহত শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৪৪তম আবর্তনের দর্শন বিভাগের মারুফ মোজাম্মেল, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের মাহাথির মুহাম্মদ, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সাইমুম ইসলাম, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের রাকিবুল ইসলাম রনি, ৪৮তম আবর্তনের ইংরেজি বিভাগের আলিফ মাহমুদ, অর্থনীতি বিভাগের উল্লাস, দর্শন বিভাগের রুদ্রনীল ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সৌমিক বাগচীর নাম জানা গেছে। এ ছাড়া ৪৪তম আবর্তনের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ছাত্রী ছন্দা ও ৪৭তম আবর্তনের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাউদা নামের দুই নারী শিক্ষার্থীকেও মারধর করতে দেখা গেছে।

সংবাদ সংগ্রহের সময় হামলায় আহত সাংবাদিকরা হলেন প্রথম আলোর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি মাইদুল ইসলাম, বার্তা টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিনিধি আজাদ, বার্তাবাজারের প্রতিনিধি ইমরান হোসাইন হিমু, বাংলা লাইভ টোয়েন্টিফোরের প্রতিনিধি আরিফুজ্জামান উজ্জ্বল।

এদিকে হামলার পর প্রশাসনিক ভবনে আন্দোলনকারীদের ঝুলিয়ে দেওয়া তালা ভেঙে দেন উপাচার্যপন্থী শিক্ষকরা। এরপর উপাচার্যকে সেখানে নিয়ে যান শিক্ষকরা।

এ সময় উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম বলেন, ‘হাতে গোনা কয়েকজন শিক্ষার্থী যা শুরু করেছেন, তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। ঢোল-তবলা বাজিয়ে তাঁরা আমার বাসার সামনে আমাকে গালিগালাজ করেছে।’

‘ধাক্কাধাক্কি’ হামলা হতে পারে না উল্লেখ করে উপাচার্য বলেন, ‘বরং আমাদের ওপর হামলা করা হয়েছে।’

উপাচার্য ফারজানা ইসলাম বলেন, ‘এই যে আমাদের অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে, এটা কি হামলা নয়? সরকারের উচিত এই চক্রকে শনাক্ত করা। কেন বিশ্ববিদ্যালয়কে অশান্ত করা হচ্ছে, তা বের করতে হবে।’

উপাচার্য আরো বলেন, ‘গুটি কয়েক শিক্ষক ও শিক্ষার্থী আন্দোলনের নামে ক্যাম্পাসে হাজার হাজার মানুষের কর্মযজ্ঞ বন্ধ করে রেখেছে। ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ করে দিয়ে আমাকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে। আমরা এ ঘটনায় মর্মাহত।’

উপাচার্য ফারজানা ইসলাম তাঁর কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার সহকর্মী ও ছাত্রলীগ কর্মীদের এ গণঅভ্যুত্থানের জন্য ধন্যবাদ। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন খুলে দেওয়া হয়েছে। এখন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় তার স্বাভাবিক গতিতে চলবে।’

এদিকে, সংবাদ সম্মেলন শেষে জরুরি সিন্ডিকেট সভায় বসেন উপাচার্য। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে বিকেল সাড়ে ৪টার মধ্যে শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।

ছাত্রলীগের হামলার বিষয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষক পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক খবির উদ্দিন বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এ রকম ন্যক্কারজনক হামলার ঘটনা ইতোপূর্বে দেখা যায়নি। উপাচার্যপন্থী শিক্ষকদের উপস্থিতি ও প্রত্যক্ষ উসকানিতে ছাত্রলীগ আমাদের ওপর হামলা চালিয়েছে। শিক্ষকদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার এটি একটি নজিরবিহীন ঘটনা। ছাত্রলীগ যখন আমাদের ওপর হামলা চালিয়েছে, তখন উপাচার্যপন্থী শিক্ষকরা তাদের স্বাগত জানিয়ে হাততালি দিয়েছে।’

হামলার বিষয়ে জাবি শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. জুয়েল রানা বলেন, ‘আমরা শিবিরমুক্ত ক্যাম্পাস চাই। আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে শিবির সংশ্লিষ্টতার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল।’

তবে আন্দোলনে শিবির সম্পৃক্ততার ছাত্রলীগের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন আন্দোলকারীদের মুখপাত্র দর্শন বিভাগের অধ্যাপক রায়হান রাইন। তিনি বলেন, ‘আন্দোলনে কোনো শিবির সংশ্লিষ্টতা নেই। যেকোনো শক্তিকে প্রতিহত করার জন্য শিবির ব্লেইম দেওয়াটা পুরোনো অপকৌশল। বুয়েটের আবরার ফাহাদকে এভাবেই হত্যা করা হয়েছে, এখানেও একইভাবে অভিযোগ তুলে হামলা চালানো হয়েছে। উপাচার্য অপসারণ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত এমন অনেকেই আজ ছাত্রলীগের হামলায় আহত হয়েছে, যারা ক্যাম্পাসে বামপন্থী রাজনীতির চিহ্নিত মুখ। তাই তাদের এসব কথা তাদের দুর্নীতি ঢাকার অপকৌশল।’

হামলার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর (ভারপ্রাপ্ত) আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান বলেন, ‘ঘটনাস্থলে মব তৈরি হয়েছিল। চেষ্টা করেও আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। বড় ঘটনা এড়াতে আমরা তৎপর আছি।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি উন্নয়ন প্রকল্পের দরপত্র ছিনতাইয়ের অভিযোগ ওঠে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। এরপর ‘ঈদ সেলামির’ নামে ছাত্রলীগের দুই কোটি টাকা চাঁদা নেওয়ার অভিযোগ উঠলে তিন দফা দাবিতে গত ২৩ আগস্ট থেকে আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একটি অংশ।

কয়েক দিন আন্দোলন চলার পর গত ১২ সেপ্টেম্বর আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ওই আলোচনায় আন্দোলনকারীদের দুটি দাবি মেনে নিলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন প্রকল্পের টাকা নিয়ে দুর্নীতির তদন্তের দাবি পূরণ করেনি বলে অভিযোগ ওঠে। এরপর ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’ ব্যানারে উপাচার্যের অপসারণের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। -এনটিভি

বার্তা কক্ষ, ৫ নভেম্বর ২০১৯