Home / ফিচার / আজব দেশ
আজব দেশ

আজব দেশ

আজকাল যেহারে ধনী বাড়ছে সে হারে যদি মানুষের বুদ্ধিবিবেক বাড়ত, তা হলে বোধ হয় পৃথিবীটা আজ স্বর্গে পরিণত হত। বিশ্বমানব নীতি আজ কোথায়? শিক্ষানীতিতে দেখ ত নীতির কোন শিক্ষা আছে কিনা? ছাত্রীকে ধর্ষণ করছে শিক্ষক! আবার দেখা যাচ্ছে শিক্ষক-শিক্ষিকাকে নাজেহাল করছে ছাত্র! সমাজে চলছে অনৈতিক কার্যকলাপ। সমাজপতিরা হয়ে যাচ্ছে অর্থপতির পূজারি, প্রভাব কাটাচ্ছে সহায়সম্বলহীনদের উপর।

একদিন আমাকে বের হতে হল ব্যাংকের কিছু কাজে। আমার বাহন ছিল মোটরবাইক। বলতে গেলে তখন, সংসারের ঝটঝামেলা নিয়ে তেমন একটা মাথা ঘামাতে হচ্ছে না আমার। ভাইরা এসব কাজকর্ম সমাধা করে চলছে। তার পরেও মধ্যে মধ্যে কিছু-না-কিছু যে করতে হয় না এমন কথাও নয়। জানি, সংসারের দায়িত্বভার সকল পুরুষকে একদিন কাঁধে উঠিয়ে নিতে হয়; এটাই সংসারের নিয়ম। সংসার-রচয়িতা যেখানে এ সংসার রচনা করে দায়দায়িত্ব শেষ মনে করতে পারেননি, সেখানে আমরা সংসারীরা কেন মনে করব নিষ্কৃতি লাভ? সৃষ্টির মঙ্গলার্থে যেমন সৃষ্টিকর্তার দায়দায়িত্ব অপরিসীম, তেমন এ সংসারের সৌন্দর্যরক্ষার্থে সৃষ্টিরও অনেকবেশি দায়িত্ব থাকা উচিত এবং আছে।

সৃষ্টিকর্তা যদি আশ্চর্যরকমের সুন্দর না হতেন তা হলে কি তাঁর প্রত্যেকটি সৃষ্টিকর্ম এমন সুচারুভাবে সৃষ্টি করতে পারতেন? তাই স্রষ্টা যেমন সুন্দর তাঁর প্রত্যেকটি সৃষ্টিকর্মই তেমন সুন্দর, হোক মানুষ অথবা দেশ যেটুকু আমাদের দেখা; তিনি সবকিছুই নিখুঁতভাবেই সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু মহাবিশ্বের অনেক কিছুই ত অজানা রয়ে গেছে, যা মানুষের পক্ষে দেখা বা জানা সম্ভব না। তবু আমরা বুঝি, মানুষ সৃষ্টির সেরা। আমাদের বোঝাপড়া হয়তো সঠিক হতে পারে কিন্তু অত নির্ভুল মনে করাও বোধহয় ঠিক না। কারণ অনেক সঠিক বোঝাপড়ার মধ্যেও অনেক সময় অনেক ভুল রয়ে যায়। তবে আমাদের বোঝাপড়া সঠিক অথবা বেঠিক যাই হোক, প্রায় মানুষের আদত কিন্তু বিশ্রী। এটা নিয়ে গবেষণা হতে পারে তবে তর্ক করা চলে না।

ব্যাংকদালানের সামনে এসে দেখি, রাস্তার অপর পাশে ফুটপাত ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে একটা তালা আটকানো ভ্যানগাড়ি। ভ্যানটার পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে কালোরঙের একটা মোটরকার। যদিওবা এটা কোন পার্কিং নয়, যান চলাচলের ব্যস্ততম সড়ক। তবু আমরা সবটাই সড়ক মানতে রাজি নই। কেননা সরকারিমাল ব্যবহারের উপর সরকারের যেমন একটা হক আছে তেমন জনগণেরও একটা হক থাকে। এখানে আমরা আবার খুববেশি দায়িত্ববান। কারণ, আমরা এমন এক জাতি হাতে করতে না পারলেও মুখে ঠেলে নিতে পারি কয়েক মাইল। আমাদের তুলনা করা ভার!

অন্যকে দেখে ভ্যানটার পিছনে একেবারে ফুটপাত ঘেঁষে আমিও দাঁড় করালাম আমার বাইক। যেহেতু আমার দাঁড়ানোটাও কোন বৈধ আইনে পড়ে না। তবু ফুটপাত বলে কথা। কাজেই আমরা অন্যকে দেখে দেখে আদতে অভ্যস্ত। কথায় যে আছে, হাওয়া যেদিকে চলে ছাতা সেদিকে মেলে ধরো। কারণ আমরা জাতিগতভাবে অভ্যস্ত। হুজুকে মাতি! হুজুকে ছুটি! জেনেশুনেই অনেক কিছু করি! একবারও বিবেক দিয়ে চিন্তা করি না যে, কাজটা ভাল কি না মন্দ। ও কেন করল! আমি করলে ক্ষতি কী? এভাবেই চলছে অপরাধ এবং বাড়ছে অপরাধ প্রবণতা।

সামনে বের হওয়ার জন্যে আমার কোন পথ খোলা নেই। আমাকে সামনের দিকে বের হতে হলে হয় ত স্থানত্যাগ করতে হবে কারগাড়িটা আর না হয় ত ভ্যানগাড়িটা। পিছনদিকে তবে বেশ খোলা জায়গা আছে। এমর্মে অন্য উপায় না খুঁজে তড়িঘড়ি করতে গিয়ে আমিও তবে অপরাধের অপরাধী বলব। সুতরাং অই যে আদত : দশজন যেখানে ছুটল–চিন্তা করে দেখি না যে, ওরা ছুটছেইবা কেন, হচ্ছেইবা কী!

গ্রীষ্মকাল, জ্যৈষ্ঠের দুপুর। কোথাও বইছে না আর বসন্তের সু-বাতাস। কাঠফাটা রোদে পুড়ছে শহর। নানা রকম মৌসুমিফলে ছেয়ে গেছে দেশ। ফলের সুগন্ধে যেখানে মশামাছিদের ভোঁ ভোঁ করার কথা সেখানে মাতোয়ারা কোন মাছিমক্ষিকার ভনভনানি নেই। কারণ আজকালকার ফল মানেই মরণব্যাধি। তাই মাছিমশাদেরও জানা হয়ে গেছে ফল মানেই বিষ। দোষ কাকে দেব, আমরা নিজেরাই যেখানে ভেজাল সেখানে অন্যকে দোষারোপ করা ভুল। এ বিষ খেয়েই আমাদের যেতে হবে!

মিনিট দশেকপর ফিরে এসে দেখি আমার বাইকের পিছন ছুঁই ছুঁই আরেকটা সাদারঙের কারগাড়ি দাঁড়ানো! আটত্রিশ ডিগ্রি রোদের উপর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম, তারপর এদিক-ওদিক সবদিকে দেখে একজন পথিককে জিজ্ঞেস করলাম–উপায় কি। ভদ্রলোক একটুখানি গতি থামালেন, সমাধান কী দিবে অতঃপর বোকার মতো হেসে চলে গেলেন। একটু দূরত্বে দেখি জন দুয়েক বসে আড্ডা দিচ্ছে–ভ্যানচালকের মতো লাগছে। ডেকে বললাম, ভ্যানটা আপনাদের কারও কি? ওরা হেসে বলল, আমরা ভ্যানচালক নই জনাব। ওহ্‌, মাফ করবেন; আমি ভাবছিলাম…দুঃখিত। বলতে পারেন, এ মহাশয়রা কে কোথায় গেছে? না স্যার, আমরা ওদিকে খেয়াল করিনি। আর আমাদের দরকারইবা কী। কথা ঠিক, কে কোথায় যাচ্ছে অন্যের গরজ কী। কি আর করি, উতপ্ত রোদের নিচে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হল নিরুপায়। ভেঁপু? অনেক বাজিয়েছি বাপু, কারও সাড়াভাস নেই।

প্রায় ঘণ্টা হতে চলল, কোন ভদ্রলোকের দেখা নেই। ইউটার্ণের মাথায় কালো গাড়িটা ঝঞ্ঝাটের সৃষ্টি করছে। যত গাড়ি টার্ণ করতে যাচ্ছে সকলেই ব্যাঘাতের সম্মুখ হচ্ছে। ভদ্রলোক হলে সভ্যগালি দিয়ে চলে যাচ্ছে আর অভদ্র হলে অশ্লীল। এমুহূর্তে তবে অই গালিগুলো তার ন্যায্যপাওয়া। কারণ, গাড়ি যথাস্থানে রাখার নির্দিষ্ট একটা স্থান সবখানে সবদেশে আছে।

এব্যাপারে সবখানে সবদেশে একটা কার্যকরি আইনও আছে। এটা কোন চালক এবং গাড়িমালিকের অজানা থাকতে পারে বলেও মনে হয় না। কেননা যারা প্রকৃত চালক বা গাড়ির মালিক তারা একটি ড্রাভলাইসেন্সেরও মালিক। আর এ-ই লাইসেন্স নিতে হলে বেশ কয়েকবার পরিক্ষাদির সম্মুখীনও হতে হয়। সুতরাং এবিষয়ে কোন চালকের অজ্ঞতা প্রকাশ করারও সুযোগ নেই।

এশিয়া মহাদেশের হাতেগুনা দুয়েকটা দেশ ছাড়া পৃথিবীর সবখানে এ আইনের কঠোর প্রয়োগ আছে। যেখানে-সেখানে গাড়ি পার্ক করলে কঠিন শাস্তির এবং মোটা অঙ্কের জরিমানারও বিধান আছে। অতএব গাড়ির সঙ্গে যাদের সম্পর্ক তারা এ আইন মানতেই হবে; সে যত বড় ধনী বা সম্মানি ব্যক্তিই হয়না কেন, আইনের বাইরে যেতে পারবে না। আর আমাদের দেশে পুলিশের সামনে একজন গাড়িওয়ালা অবৈধভাবে তার গাড়ি পার্ক করে চলে যাচ্ছে পুলিশ তাকে কিছু বলবে দূরের কথা, দেখা যাচ্ছে সালাম ঠুকছে। যেন এরাস্তার মালিক অই গাড়িওয়ালা! এরাজ্য তাঁর পিতৃদেবের, উত্তরাধিকারসূত্রে সে-ই প্রাপ্য একদিন।

অনেক গাড়িমালিককে দেখা যায় কোনক্রমে একটা দামি গাড়ির মালিক হলেই হইছে, তাঁর চোখ তখন আকাশের দিকে। এ মাটির মানুষকে তখন তাঁরা মনে করে কীটপোকা। তাদের সংস্পর্শে যেন শত আবর্জনার ছোঁয়া। এক জরিপে দেখা গেছে, উচ্চবিত্তরা মধ্যবিত্তদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা দূরের কথা, রাখতেও চায় না। তা হলে চিন্তার কথা নিম্নদের অবস্থা কোথায়। বিত্তশালীরা প্রায়ই অহংকারী হয়। তাঁরা ছোটজনদের সঙ্গে কথা বললে বিরক্ত বোধ করে। আত্মীয় ছোট হলে তাদের সঙ্গে আত্মীয়তা বজায় রাখতে চায় না। এরকম আত্মীয়ের আগমনে অস্বস্তি বোধ করে। কথা বলতেও মন চায় না। যদিওবা বাধ্য হয়ে বলতে হয়, তা হলে খুব সীমিত। এমন বিত্তবান আত্মীয় থেকে দূরে থাকা ভাল। কেউ বড় দেখালে সেখানে ছোট হওয়া অপরাধ।

শহরের এ সড়কগুলোতে যানবাহনের যেমন ব্যস্ত চলাচল, তেমন পথিকেরও চলাচল কোন অংশে কম দেখা যায় না। আমি এসব দেখছি আর ভাবছি, আজব দেশ। একজন দোকানি তাঁর কোষাগারে বসে বারবার আমাকে পর্যবেক্ষণ করছে। মনে হচ্ছে ভদ্রলোক কিছু একটা বলতে চাচ্ছে–আমন্ত্রণ পেয়ে কাছে গেলাম। কুশলবিনিময়পর চেয়ার টেনে বসতে দিলেন। বেচারা তাঁর জীবনে ঘটে যাওয়া এমনই এক দুঃখের কিচ্ছা শুনালেন। গল্প নাতিদীর্ঘ হলেও অত্যন্ত করুণ বটে। সেকথা আর উত্থাপন করলাম না। কারণ প্রত্যহ একই খাদ্যে যেমন রুচি থাকে না তদ্রূপ এক জিনিস বারবার উত্থাপনে ও প্রদর্শনেও বিরক্তি আসে। ভদ্রলোকও বললেন, বর্তমানে গাড়ির মালিক যারা রাস্তার মালিকও তারা। নাহয় ত যার যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে চলছে কেন, যার যেখানে ইচ্ছে সেখানে গাড়ি দাঁড় করে চলে যাচ্ছে কীভাবে! কথাটা অসমীচীন হতে পারে তবে অবাস্তব নয়।

আজকাল যেহারে ধনী বাড়ছে সে হারে যদি মানুষের বুদ্ধিবিবেক বাড়ত, তা হলে বোধ হয় পৃথিবীটা আজ স্বর্গে পরিণত হত। বিশ্বমানব নীতি আজ কোথায়? শিক্ষানীতিতে দেখ ত নীতির কোন শিক্ষা আছে কিনা? ছাত্রীকে ধর্ষণ করছে শিক্ষক! আবার দেখা যাচ্ছে শিক্ষক-শিক্ষিকাকে নাজেহাল করছে ছাত্র! সমাজে চলছে অনৈতিক কার্যকলাপ। সমাজপতিরা হয়ে যাচ্ছে অর্থপতির পূজারি, প্রভাব কাটাচ্ছে সহায়সম্বলহীনদের উপর। কিছু মৌলবি ফতোয়া জারি করছে অভিনবকায়দায়! ভণ্ডদের ভণ্ডামিতে মুগ্ধ হচ্ছে ভক্ত! অর্থনীতিতে চলছে লুটপাট! রাজনীতিতে চলছে হানাহানি! আইনের দেবতা চলছে বেআইনের পথে! তা হলে আইন কোথায়? মানুষ নোংরামি করতে একবিন্দু দ্বিধাবোধ করছে না। স্রষ্টা নাকি আঠার হাজার মখলুকাত বা কুলকায়েনাত সৃষ্টি করেছেন মাত্র ছয় দিনে। তবে মানুষ সৃষ্টি করতে নাজানি কত যুগ সাধনা করতে হয়েছে! আজ নিচে দেখছে ত সম্ভবত লজ্জা অনুভব করছে আর বিদ্রূপের হাসি হাসছে। হয়তো দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলছে, সৃষ্টির মধ্যে সবচেয়ে উত্তমসৃষ্টি করছিলাম মানুষ। হায় মানুষ! নিচে দেখি ত আফসোস…

প্রায় দেড়-কি-দুই ঘণ্টাপর চল্লিশোর্ধ্ব এক ভদ্রলোক–ভদ্রলোক বললে হয়তো ভদ্রলোকের অপমান হয়। হাঁ, আলালের বিকৃত দুলাল অবশ্য বলা যায়। খোঁচা খোঁচা দাড়ি, মোটা গোঁফ, পায়ে ক্যাস্‌, পরনে বাদামি জিনস্‌‌ আর সাদার উপর নীলদাড়ি শার্ট চোখে কালো চশমা। সহজেই বুঝা যাচ্ছে দম্ভ প্রকৃতির লোক। হাতের আঙুলে চাবির একটা রিং ঘুরাতে ঘুরাতে সাদারঙের গাড়িটাকে লক্ষ্য করে আসছে। দোকানি ভদ্রলোক বললেন, এই নবাবজাদারই ত বোধহয় সাদা গাড়িটা।

আমি বললাম, কিছু একটা বলি?

দোকানি ভদ্রলোক বাধা দিয়ে বললেন, কোন লাভ হবে না ভাই, পরে আপনাকেই দুচার কথা শুনতে হয়। এরচেয়ে নীরব থাকা ভাল।

আমি দুঃখ প্রকাশ করে বললাম, এভাবে অন্যায় কি চলতেই থাকবে?

দোকানদারজন হেসে বললেন, কোন উপায় নেই। আপনি ন্যায়কথা বলে দেখেন কয়জনের সঙ্গ পান। আর অন্যায় করে দেখেন কত বাহবা আসে! আজকাল আইনের কথা বলেও কোন লাভ নেই। দেখতে হবে আইনের নিয়ন্তা কে? নিশ্চয় ফেরিশতা নয়। মানুষ যেখানে নিয়ন্তা সেখানে সুফল আশা করা যায় না।

টার্নের আগে একজন ট্রাফিক প্রত্যেক গাড়িকে নির্দেশনা দিচ্ছে। কালো গাড়িটার পাশে দুজন সার্জেন্ট দাঁড়িয়ে আছে। আমি নিস্তার পেয়ে মোটরবাইকে বসছি। নবাবজাদা কিঞ্চিৎ ভ্রুক্ষেপ নাকরেই চালকাসনে বসেই চলদিল ভোঁ। তাকে ট্রাফিক বা সার্জেন কেউই কিছু বলল না! আধা রাস্তাজুড়ে অবৈধভাবে গাড়ি দাঁড় করানোর কৈফিয়ত কেউ চাইল না! তাই অপরাধীরা এভাবে অপরাধ করার সাহস পাচ্ছে এবং অন্যকে অপরাধ করার প্রেরণা দিচ্ছে। একে ত আমরা একে দেখার অভ্যস্ত। দুয়েতে অন্যের অনুকরণ বা অনুসরণের পিছে ছুটি। বিচারে বসি ত মান্য একজন কী বলল তাঁর মন্তব্যের উপর ভিত্তি করে সকলে একই মন্তব্য করি! বক্তৃতামঞ্চে এক নেতা বা নেত্রী যেবক্তব্য পেশ করল তাঁর ভিত্তিতে একই কথা ঘুরেফিরে সকলে দৌড়াই! আমরা নিজের জ্ঞান খাটিয়ে ভালমন্দের বিচার করতে পারি না। আমাদের কাণ্ডজ্ঞান এতই নিকৃষ্ট যে, কাউকে ভাল করতে দেখলে তার সমালোচনা করি। নিজের দোষ দেখি না পরের দোষ আঙুল দিয়ে দেখাতে ভাল পারি। আমাদের আছে কেবল গর্ব করার মতো পরনিন্দা। সিনেমানাটক দেখে নায়ক-নায়িকার নামানুসারে সন্তানের নাম রাখি অথবা যুদ্ধবীর কোন রাষ্ট্রপ্রধান বা বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গের নামানুসারে। ভেবে দেখি না যে, পদ্মলোচন রাখলেই যে কানা ঘুচে যাবে এমন ত নয়। তা হলে? কানাতে মন্দ কী। নিজের স্বতন্ত্র পরিচয় দিতে যে অক্ষম তাকে সক্ষম মানুষ বলা যায় না।

আমাদের সুচিন্তিত বিবেক বলতে কিছুই নেই। আমরা কোনকিছুই ভেবেচিন্তে করি না! অথচ একটু চিন্তা করলে সবকিছুই স্পষ্ট বুঝা যায়। মানুষ হলে যেকোন কাজে সচেতনতা চাই, নাহলে মানুষ হিসাবে উন্নতি করা খুব কঠিন। তাই বোধহয় জাতি হিসাবে আমরা এখনো পিছিয়ে। যতক্ষণ একজন নাগরিক সচেতন নয়, আইন যতই কঠোর থেকে কঠোর হয়না কেন, ততক্ষণ কোন সাফল্য নেই। কারণ আইন কার জন্যে এবং কেন? যেখানে রথী-মহারথীরা আইন মেনে চলতে অক্ষম সেখানে সাধারণ একজন মেনে চলবে এমন কথা ভাবা যায় না। উন্নতদেশে ছোটবড় প্রত্যেক নাগরিক যেমন আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল তেমন দেশপ্রিয়ও বলা যায়। তারা এমন কোন কাজ করবে না যা আইনের নথিবহির্ভূত। তবে ভুলক্রমে কেউ যদি এমন অপরাধ করেও বসে তাঁকে রীতিমতো দণ্ডের সম্মুখীন হতে হয়। যেমন? একজন নগরপিতা খোদ অবৈধপার্ক করা গাড়িকে যখন সাজা দেয় তখন গাড়িমালিকের অপমান মনে করা হয় মৃত্যুদণ্ডসমান। আর এখানে গাড়িকে সাজা দেওয়ার কথা দূরে থাক, মালিকের দণ্ডও যে হওয়ার নয় সেটা নিশ্চিত। তা হলে আইন কোথায়? বর্তমানে মানুষচলাচলের সামান্য ফুটপাত পর্যন্ত দখলে নিয়েছে সাহেবদের গাড়ি! পথচারীদের যা দুর্ভোগ। কেউ অসতর্ক হলে টোকর খেয়ে পড়ছে নালানর্দমায় এবং ভাঙছে হাতপা আর নাহয় শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গে পাচ্ছে আঘাত। পথচারী ভাঙুক অথবা মরুক সাহেবদের কিছু যায় আসে না, ওঁদের গাড়ি ঠিক থাকলেই হয়। কারণ দামি বলে কথা। তাতে যদি একটু আঁচড় লাগে তা হলে সাহেবদের মহা ক্ষতি হয়। তাই পথিকগণ নিজের অঙ্গহানি করে হলেও সাহেবদের এসব গাড়ি বাঁচাতে হয়, নইলে সাহেবদের দন্ততলে চর্বণ হতে রক্ষা নেই।

দিনদিন মানুষ যেহারে শহরমুখী হচ্ছে; কেউ জীবনের তাগিদে, কেউ জীবিকার তাগিদে, কেউ ছেলেমেয়েকে উচ্চশিক্ষিতের মাধ্যমে মানুষের মতো মানুষ করার তাগিদে। সেহারে শহর যেমন সম্প্রসারিত হচ্ছে না তেমন মানুষের মনমানসিকতারও পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। দিন যতই অগ্রসর হচ্ছে পৃথিবীর রূপ ততই পাল্টে যাচ্ছে। কিন্তু মানুষের রূপের পরিবর্তন হচ্ছে না! এককালে গ্রামের মানুষকেই সহজসরল ও বোকা মনে করা হত। আজকে সেই সুযোগ নেই। আজকে একজন গ্রাম্যকে বহুদর্শী বলতে হবে। হোকবা অশিক্ষিত অথবা অল্পশিক্ষিত। কারণ আজকাল গ্রামের মানুষরাই বেশির ভাগ দেশবিদেশ ঘুরছে। আর একজন দেশবিদেশ ভ্রমণকারীকে অনেকবেশি অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বলতে হবে।

জন্ম থেকে যেচোখ বাইরের আলো দেখেনি সেচোখ অন্ধই বটে। যেজাতি ভালমন্দ নির্ণয় করতে পারে না সেজাতিকে নিয়ে গর্ব করা চলে না। আমরা নাগরিক হলাম ঠিক তবে কেন জানি সুনাগরিক হতে পারিনি। কারণ নাগরিক এবং সুনাগরিকের মধ্যে অনেক তফাৎ। উস্কানি পেয়ে যে স্বীয় রাষ্ট্রসম্পদের ক্ষতি করতে পারে, সে নাগরিক হতে পারে কিন্তু সুনাগরিক হতে পারে না। মানুষ যতক্ষণ নিজের বিবেকের কাছে বড় হতে পারবে না ততক্ষণ তাকে ভাল মানুষ হিসাবে গণ্য করা যাবে না। যেদেশে একজন রাষ্ট্রপ্রধান থেকে আরদালি পর্যন্ত দুর্নীতিগ্রস্ত সেদেশে একজন সাধারণ নাগরিক আর কতইবা ন্যায়নীতির হিসাব করে চলতে পারে?

লেখক পরিচিতি : আযাহা সুলতান, : ডি সি রোড, চট্টগ্রাম।

|| আপডেট: ০৮:৩৫  পিএম, ০৪ নভেম্বর ২০১৫, বুধবার

এমআরআর