Home / ফিচার / আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা এবং আমার পলায়নপরতা
আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা এবং আমার পলায়নপরতা

আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা এবং আমার পলায়নপরতা

Raju Ahmed on
রাজু আহমেদ  ||   আপডেট: ০৮:২৮ পিএম, ০৩ অক্টোবর ২০১৫, শনিবার

আমিও এক সময় নিয়মিত লিখতাম। রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে টুকটাক আলোকপাত করতাম। সে লেখাগুলো পত্রিকায়ও স্থান পেত। আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ের মিলিয়ে সপ্তাহের প্রায় ৬ দিন কোন না কোন পত্রিকায় আমার লেখা প্রকাশ পেত। এটা আমার পেশা ছিল না বরং শুধু শখে লিখতাম। তবে উদ্দেশ্য খারাপ ছিল বলে মনে হয় না।

আমার লেখায় যদি সমাজের একজন মানুষ সচেতন হত কিংবা কর্তৃপক্ষের একটি ভুল ভাঙতে সহায়তা করে তবে সেটাই হত আমার চরম প্রাপ্তি। এটা শুধু আমার মত ভাঙাচোরা কলম ধরতে জানা মানুষের নয় বরং সব লেখকের তৃপ্তির যায়গা। তবে আমার সে সংক্ষিপ্ত লেখক জীবনের বোধহয় ইতি ঘটতে চলেছে।

সর্বশেষ কবে পত্রিকার উপসম্পাদকীয় কলামে আমার লেখা দেখেছি তা পত্রিকার তারিখ না দেখে বলতে পারবো না। তবুও অভ্যাস বশত আজও পত্রিকায় আমার লেখা খুঁজি কিন্তু পত্রিকায় লেখা না দিলে লেখা আসবে কোথা থেকে ? লেখা দিব কোথা থেকে; কোন বিষয়ই তো লিখতে সাহস পাচ্ছি না।

যদি আইসিটি আইনের ৫৭ ধারার খড়গে পড়ে যাই। যাদের যৎসামান্য লেখালেখি করার অভ্যাস আছে তারা লিখতে না পারলে অনেক খারাপ লাগে। আমার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। তবে প্রত্যেক লেখকের লেখার একটি তৃপ্তির যায়গা আছে । কেউ সমালোচনা, কেউ পদ্য, কেউ গদ্য, কেউ রম্য, কেউ উপন্যাস, কেউ ইতিহাস প্রভৃতি বিষয়ে লিখতে স্বাচ্ছন্দবোধ করে।

এদেশে শুধু নয় বরং পুরো বিশ্বে মাত্র হাতে গোনা কয়েকজন লেখকের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় যারা সর্বক্ষেত্রে লিখতে পরাঙ্গম ছিলেন কিংবা লিখেন। বিভিন্ন বিষয়ে লিখতে পারলেও লেখকদের একটি-দুটি বিষয়ে লেখার দক্ষতা ভালো থাকে এবং এসব বিষয়ে লিখে তারা তৃপ্তি পায় । যদি লেখার সে যায়গাটিতে কেউ তাকে বাঁধা দেয় তখন লেখকের মর্মজ্বালা লেখক হয়ত অন্যকে বোঝাতে পারে না কিন্তু সন্তান জন্ম দেয়ার পূর্বে প্রত্যেক মায়ের যেমন ব্যথা অনুভূত হয় তেমনি লেখকও তার অনবদ্য সৃষ্টি প্রসব করার পূর্বে চিন্তার জগতে তেমন জ্বালা অনুভব করেন । লেখক তার সৃষ্টিকে বাস্তবতায় রূপ দেয়ার আগ পর্যন্ত এমন দহন চলতেই থাকে । কোন কর্তৃপক্ষ কিংবা আইন যখন লেখকের সৃষ্টিতে বাঁধা হয় তখন লেখকের সৃষ্টি ধ্বংস হওয়ার সাথে লেখকও নিরাশ হয়ে এক সময় জীবনমৃত অবস্থায় পতিত হয় । কেননা অন্যান্যদের চেয়ে লেখকদের মনন অনেক বেশি সংবেদনশীল ।

ভার্চুয়াল জগত যথা ব্লগ, ফেসবুক, অনলাইন পোর্টালে লেখার হাতেখড়ি হলেও প্রধানত বিচরণ ছিল প্রিন্ট মিডিয়ার জগতে । তবে ব্লগ কিংবা অনলাইন পোর্টালের মায়া ছাড়তে পারিনি কিন্তু বর্তমানে অনিচ্ছায় ধ্বংসোম্মূখ হয়ে গুটিয়ে আছি । প্রিন্ট মিডিয়ায় লেখক-পাঠকের তেমন সম্পর্ক সৃষ্টি হয়না যতটা হয় ব্লগের ক্ষেত্রে । তবে প্রিন্ট কিংবা অনলাইন-সব ক্ষেত্রেই এখন সাবেকের খাতায় উঠতে চলেছি । পৃথিবীর সকল পেশাজীবিদের অবসরের একটা নির্দিষ্ট বয়স থাকলেও ব্যতিক্রম কেবল লেখালেখির জগৎ । এখানে অবসর দিতে পারে কেবল মৃত্যু । অথচ আজ কায়িকভাবে আত্মার অনুপস্থিতি না ঘটলেও লেখক আত্মা নির্জীব হতে বাধ্য হয়েছে। কেবল ভয়, সংকট নিয়ে কতক্ষণ কলম সচল রাখা যায় ? লেখকদের ওপর যুগে যুগে নানামুখী চাপ ছিল । বৃটিশামলে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুলকে বারবার কারবরণ করতে হয়েছে । তবে সে আমলে নিশ্চয়তা ছিল অন্তত লেখক প্রাণে মারা যাবে না । কিন্তু দিন যত সামনে এগিয়েছে লেখক ও তার পরিবারের সে নিশ্চয়তার যায়গাটুকু ক্রমশ সংকুচিত হয়েছে । অতীতে কোন লেখককে আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হলে তাকে কেবল তার লেখনির অপরাধেই অভিযুক্ত করা হত কিন্তু এখন লেখনির অভিযোগের সাথে অন্য বহু অভিযোগ জুড়ে দেয়ার কারণে মূল অভিযোগকে খুব ছোট দেখায় ।

লেখকরা স্বভাবসিদ্ধভাবেই মুক্তমনা হয়। এই মুক্তমনা বলতে গতানুগতিক যে মুক্তমনাদের বুঝায় সেটা উদ্দেশ্য নয় । ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানকে ঈর্ষার স্থান থেকে গালি, মিথ্যা নিন্দা লেখকের কাজ নয় । লেখক তার বুদ্ধিবৃত্তিক সত্ত্বার মাধ্যমে চিন্তার বিস্তর পরিসরে সমস্যার কথা বলবেন, সমাধান ও সম্ভাবনা তুলে ধরবেন । সমাজের অনাচার, অত্যাচার তুলে ধরে মানুষকে তা থেকে সচেতন করবেন । অন্যায়ের তীব্র প্রতিবাদ, শাসকদের ভুল চিহ্নিত করে তাদেরকে সামনে সঠিক পথের রূপরেখা উম্মোচিত করবেন । এইতো লেখকের প্রধান কাজ । তবে সমস্যা হয়েছে সহিষ্ণুতার স্থানটিতে । পরমত সহিষ্ণুতা কিংবা সমালোচনা সহ্য করার ক্ষমতা যেন কারোরই নাই । যে যার মত চলতে চাই, আপন স্বার্থ রক্ষায় সবাই দিগ্বিদিক ছুটছি । তাতে অন্যের স্বার্থ অরক্ষিত হচ্ছে কিনা সেদিকে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নাই । ব্যক্তি অধিকার থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় অধিকার পর্যন্ত সব পক্ষপাতমূলকভাবেই রক্ষা করার চেষ্টা নিরন্তর চলছেই । একজন প্রকৃত লেখক হয়ত এমনভাবে শঙ্কিত নয় যতটা আমি বলেছি । বলে অতিক্ষুদ্র লেখক হিসেবে আমার শঙ্কাও কি অমূলক ? আসন্ন মৃত্যুর ভয় যেমন প্রত্যহ মনে ভীতির সঞ্চার করে তার চেয়ে কোন অংশে কম ভীতির সঞ্চয় করে না নির্যাতন, নিপীড়নের খড়গহস্ত ।

তথ্য প্রযুক্তি আইনের প্রস্তাবিত ৫৭ ধারা একজন লেখককে পঙ্গু করতে যথেষ্ট । এটা নিছক পঙ্গুত্ব নয় বরং লেখকের লেখক সত্ত্বা মরে গেলে সেটাকে মৃতই বলা চলে । গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে উল্লেখিত বাক ও চিন্তার স্বাধীনতার পরিপন্থিও এ আইনটি । দেশের বিশিষ্টজনদের একাংশ ও সম্পাদক পরিষদ এ আইনের বাতিলের পক্ষে । কেননা সাংবাদিকতা কিংবা লেখালেখির ক্ষেত্রে লেখকের চিন্তার ক্ষেত্রটি সংকোচিত করে দিতে এ আইন অনন্য ভূমিকা পালন করবে । তারপরেও যদি আইনটির সঠিক প্রয়োগের নিশ্চয়তা থাকতো তবুও শঙ্কিত হওয়ার তেমন কারণ থাকতো না কিন্তু দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের তীব্র বৈরী সম্পর্ক, দল কিংবা গোষ্ঠীগত প্রভাব বিস্তারের হাতিয়ার হিসেবে এ আইনের যে অপব্যবহার হবে না তার নিশ্চয়তা কতটুকু ? অজামিনযোগ্য ও ১৪ বছরের কারাদন্ডের এই আইনটি বৈধভাবে প্রয়োগের সম্ভাবনা যতটুকু তার চেয়ে ঢের বেশি সম্ভাবনা ব্যক্তিগত কিংবা অন্যকোন আক্রোশ মেটানোর । গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোয় ক্ষমতাশীন কিংবা বিরোধীদের সমালোচক না থাকলে কর্তৃপক্ষ অন্যকোন কাঠামোয় পরিবর্তিত হতে পারে । গণতন্ত্র সুরক্ষিত রাখতে যারা সমালোচনার মাধ্যমে সহায়ক ভূমিকা পালন করেন সেই তাদের দমনে এ আইন ব্যবহৃত হবে না তার নিশ্চয়তা কোথায় ? সুতরাং তথ্য প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এ আইনটি লেখক অঙ্গনের সকলের জন্যই মূর্তমান আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে । আজ যারা এ আইনের পক্ষে অবস্থান করছে সেই তারাই হয়ত সময়ের বিবর্তনে এ আইনের বিরুদ্ধে অবস্থান করবে । কাজেই যা সর্বসময়ের জন্য বিতর্কিত তা সংস্কার কিংবা বাতিল করাই রাষ্ট্রের উচিত ।

আমি লিখতে চাই এবং সেটা নির্ভয়ে । লেখার ক্ষেত্রে কোন মানদন্ড যদি সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয় তখন সেটা লেখকের জন্য কল্যানের হয় না । তখন সত্য প্রকাশিত না হয়ে তোষামোদি রাজ্য দখল করে নেয় । আজও ভালো-শুভের মুল্য আছে কেননা এর বিপরীতে মন্দ-অশুভ সমানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে । তথ্য প্রযুক্তির ৫৭ দ্বারা যে উদ্দেশ্যে করা হয়েছে সেটা পুরো যে অযৌক্তিক তা নয় তবে কিছু অংশ সংবিধান কর্তৃক মানুষকে যে মৌলিক অধিকার দিয়েছে তার সাথে সাংঘর্ষিক । কাজেই এ আইনের অস্পষ্টতা প্রকৃত অপরাধীর চেয়ে নিরাপরাধ মানুষকে বেশি হয়রানি করবে । শালীন-অশালীনের সীমা এ আইনে চুড়ান্ত করা হয়নি । ব্যক্তির মানহানী ও ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন-অক্ষুন্নের যে কথা বলা হয়েছে তাও অস্পষ্ট । গ্রামের সাধারণ একজন ‍কৃষক ও ক্ষমতাধর একজন ব্যক্তির মানহানীর ক্ষেত্রে কি একই কথা প্রযোজ্য হয় ? ক্ষমতাশালী তার ক্ষমতার দাপট কিংবা প্রভাব দিয়ে নিরাপরাধ কাউকে হয়রানি করলে সেটা রোধের উপায় থাকবে কি ? আইসিটি আইনে প্রশাসনকে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দেয়া হয়েছে কিন্তু এ আইনের প্রায়োগিক ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত কিংবা প্রভাবশালীদের আক্রোশ পূরণ হবে না তার নিশ্চয়তা কি সাধারণ মানুষ পাচ্ছে ? কাজেই আইনটিকে যথাযথ প্রক্রিয়ায় সংস্কার করা হোক । এক্ষেত্রে গণমাধ্যমের সাথে সংশ্লিষ্ট বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মতামতকে অগ্রাধিকার দেয়া আবশ্যক । ৫৭ ধারা যদি অপরিবর্তিত ভাবে বহাল রাখা হয় তবে এ দেশের লেখকরা প্রেমের উপন্যাস, বিরহের কবিতা আর তোষামোদের ভাষায় তাদের কলমকে শানিত করতে বাধ্য হবে । আর যাদের প্রেম-বিরহ, তোষামোদ করার ক্ষমতা নাই তারা লেখালেখির জগৎ হারিয়ে যাবে । একারণে হয়ত ঝরে পড়বে কিছু সম্ভাবনাময়ী আগামীর নক্ষত্র । ৫৭ ধারা বহাল রাখলে দোষটা রাষ্ট্র কিংবা কর্তৃপক্ষকে দেবনা বরং দূর্ভাগ্যের ইঙ্গিতটা আপন দিকেই করব । এই সময়ে জন্মানোটাই হয়ত উচিত হয়নি ।

রাজু আহমেদ । কলামিস্ট ।
raju69alive@gmail.com

 

চাঁদপুর টাইমস : আরএ/ এমআরআর/২০১৫