গান্ধী চেয়েছেন স্বরাজ কিন্তু নজরুল চান ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা। তিনি গান্ধীজির পথকে পরিহার করে ‘ধূমকেতু’ পত্রিকার মাধ্যমে ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চান। ‘ধূমকেতুর পথ’ প্রবন্ধে নজরুল লিখলেন—‘স্বরাজ-টরাজ বুঝি না, কেননা ও কথাটার মানে একেক মহারথী একেক রকম করে উপস্থাপন করে থাকেন। ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশও বিদেশির অধীন থাকবে না। ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ দায়িত্ব,সম্পূর্ণ স্বাধীনতা-রক্ষা,শাসনভার, সমস্ত থাকবে ভারতীয়দের হাতে। তাতে কোনো বিদেশির মোড়লি করবার অধিকারটুকু পর্যন্ত থাকবে না।’ অসুন্দ,অমঙ্গল কিংবা অকল্যাণের গ্রাস থেকে নজরুল তাঁর স্বদেশ এবং মানুষকে মুক্ত করতে চেয়েছেন সুস্পষ্টভাবে।
কাজী নজরুল ইসলাম জন্মগ্রহণ করেন ঊনবিংশ শতকের শেষ দিকে,বিস্তৃত রাজনৈতিক পটভূমিতে। ফলে কিশোর বয়সেই তাঁর সামাজিক রাজনৈতিক শক্তির বিকাশ ঘটে। বিশেষ করে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিভিন্ন আন্দোলন তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। মানুষের অধিকারের প্রশ্নে, দুঃখ-কষ্টে তিনি নির্বিকার থাকতে পারেননি। বৈষম্যের বিরুদ্ধে তাঁর কণ্ঠ এবং কলম সবসময় ছিল সুস্পষ্ট। তিনি কেবল প্রে, বিরহ কিংবা জীবনের জয়গান গাননি, ঔপনিবেশিক শক্তির শৃঙ্খল থেকে মুক্তির জন্য উচ্চারণ করেছেন বিদ্রোহের অমর বাণী। রাজনীতির মানুষরা যখন কথা বলতেন মিছিলে, স্লোগানে,তখন নজরুলের প্রতিবাদের ভাষা ছিল ক্ষুরধার লেখনি। তাঁর প্রতিবাদের প্লেকার্ড ছিল কবিতা-গান। এজন্য অন্যান্যের তুলনায় নজরুলের উপর শাসকদের দৃষ্টি প্রবল ভাবে পড়েছে।
নজরুল প্রত্যক্ষ রাজনীতি শুরু করেন ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে। তিনি এই সময়ে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সদস্য হন। নজরুলের অন্যতম রাজনৈতিক সহকর্মী হেমন্তকুমার সরকার কংগ্রেসের সভ্য হওয়া সত্ত্বেও কৃষক আন্দোলনে অধিকতর উত্সাহী ছিলেন। জেলে ও চাষিদের অনেক সভা-সমিতিতে তারা যোগ দিতেন। ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দের শেষে দিকে কাজী নজরুল ইসলাম, হেমন্তকুমার সরকার, কুত্বুদ্দীন আহমদ ও শামসুদ্দীন হুসায়নের উদ্যোগে কলকাতায় একটি নতুন পার্টি গঠিত হয়।
পার্টির নাম‘ভারতীয় জাতীয় মহাসমিতির অন্তর্ভুক্ত ‘শ্রমিক প্রজা স্বরাজ দল’। এ দলের প্রথম ইশতেহার কাজী নজরুল ইসলামের দস্তখতে প্রকাশিত হয়েছিল। পার্টি গঠন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তার মুখপাত্ররূপে ‘সাপ্তাহিক লাঙল’ পত্রিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত হয়। ২৬ ডিসেম্বর ১৯২৫ সালে লাঙল-এর প্রথম খণ্ড বিশেষ সংখ্যা প্রকশিত হয়। নজরুলের পরিচালনায় ‘লাঙল’পত্রিকা নিয়ে ১০ আগস্ট লেলিনগ্রাদের প্রাচ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক আলী দাউদ আলী দত্ত নামে পরিচিত বাংলার প্রখ্যাত বিপ্লবী প্রমথ দত্ত একটি পত্রে লেখেন,‘ভারতের অত্মোত্পন্ন সম্পদে বঞ্চিত সম্প্রদায়ের জাগরণশীল শ্রেণি চৈতন্যের লাঙল-ই প্রথম মুখপত্র।’
১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে কৃষ্ণনগরের বাড়ি থাকা অবস্থায় পূর্ববঙ্গ থেকে নজরুল ইসলাম কেন্দ্রীয় আইনসভার নির্বাচনে প্রার্থী হন। ৩১ অক্টোবর মনোনীত প্রার্থী হিসেবে ঢাকা সফর করেন এবং প্রায় পুরো নভেম্বর মাস তিনি ময়মনসিংহ, বাকেরগঞ্জ ও ফরিদপুর জেলার নির্বাচনি জনসংযোগ করেন। কিন্তু ঐ সময়ে নজরুলের পক্ষে পূর্ব বাংলার কোনো মুসলমান আসন থেকে নির্বাচনে জয়লাভ করা কঠিন ছিল। কারণ গোঁড়া মুসলমান সম্প্রদায় ইতিপূর্বেই তাকে কাফের ফতোয়া দিয়েছিল। নজরুল নিজেও এ ব্যাপারে সচেতন ছিলেন।
এছাড়াও নির্বাচনি মাঠে কাজ করতে গিয়ে নজরুল অনেক বেশি বিপাকে পড়েন অর্থ সংকট নিয়ে। নির্বাচন করতে কেমন টাকা লাগে,সে ব্যাপারে তাঁর কোনো ধারণা ছিল না। পুরো নির্বাচনে তার বাজেট ছিল ৩শ টাকা। এ টাকা পার্টির পক্ষ থেকে তাঁকে বিধানচন্দ্র রায় দিয়েছিলেন। ফলে বাজেট–স্বল্পতায় নির্বাচনি প্রতারণা করতে সবখানে তিনি যেতে পারেননি। তবে নজরুলের ধারণা ছিল মানুষ যেভাবে তাঁকে এবং তাঁর কবিতা ভালোবাসে, সে হিসেবে তিনি নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হবেন।
১৯২৬ সালের ২৯ নভেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হলে দেখা যায় যে, নজরুল পরাজিত হয়েছেন এবং তার জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। নির্বাচনে জয়লাভ করেন বরিশালের জমিদার মুহম্মদ ইসমাইল চৌধুরী ও টাঙ্গাইলের জমিদার আবদুল হালিম গজনবী। আজ শত বছর পর সে নির্বাচনে বিজয়ী দু’ জমিদারের নাম অনেকে জানেন না, প্রয়োজনও হয় না। কিন্তু কাজী নজরুল ইসলামের নাম ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। তিনি বাংলাদেশের জাতীয় কবি। তিনি পৃথিবীর নিপীড়িত মানুষের কবি, সাম্য ও ভালোবাসার কবি।পৃথিবী যতদিন থাকবে নজরুল ততদিন পৃথিবীর নিপীড়িত মানুষের হৃদয়ের মনিকোঠায় জাগ্রত থাকবেন।
লেখক পরিচিতি: মুস্তাফিজুর রহমান পাটোয়ারী, লেখক ও সংগঠক। প্রাক্তন উপ- মহাব্যবস্থাপক (হিসাব),বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড।
২২ মে ২০২৫
এজি