Home / সারাদেশ / ভূমি জরিপের ইতিহাস ও ভবিষ্যৎ
JARIF

ভূমি জরিপের ইতিহাস ও ভবিষ্যৎ

বাংলাদেশে প্রতিদিন যে শত শত মানুষ আদালতের দ্বারে হাজির হন, তাদের একটি বড় অংশ আসে জমি নিয়ে বিরোধের কারণে। জমির সীমানা কোথায়, কার নামে খতিয়ান, কোন দলিল বৈধ এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই বছরের পর বছর কেটে যায়। অথচ এ সবের মূলে রয়েছে একটি সহজ কিন্তু দীর্ঘদিনের উপেক্ষিত প্রক্রিয়া—ভূমি জরিপ। যে জরিপ সঠিক হলে জমির মালিকানা নির্দিষ্ট হয়,বিরোধ কমে,আইনি নিশ্চয়তা মেলে এবং ব্যক্তি মালিকানা রক্ষা পায়। কিন্তু বাস্তবতা হলো,আমাদের দেশে ভূমি জরিপের দীর্ঘ ইতিহাস সত্ত্বেও সঠিক ও নির্ভরযোগ্য ভূমি রেকর্ড এখনো সবার নাগালে নয়।

প্রাচীন মিশর থেকে শুরু করে উপমহাদেশের মোগল শাসনকাল এবং ব্রিটিশ আমলের জেমস রেনেল, রাজা টোডরমল থেকে শুরু করে আজকের বিডিএস বা ডিজিটাল জরিপ—ভূমি জরিপ পদ্ধতির এ পরিবর্তনশীল যাত্রা শুধুই প্রযুক্তির রূপান্তর নয়, বরং এটি জমির মালিকানা, ভূমি ব্যবস্থাপনা এবং জনগণের ন্যায়বিচারের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এ প্রবন্ধে আমরা ফিরে দেখব আমাদের ভূমি জরিপ ব্যবস্থার ঐতিহাসিক বিকাশ,পর্যালোচনা করব বর্তমান পদ্ধতির কার্যকারিতা এবং অনুসন্ধান করব,জমির ন্যায়বিচার কীভাবে সম্ভব। এবং সেই ন্যায়বিচারে পৌঁছাতে হলে জরিপ পদ্ধতির কী কী মৌলিক পরিবর্তন প্রয়োজন।

বাংলাদেশের মতো কৃষিপ্রধান ও ভূমিনির্ভর সমাজব্যবস্থায় ভূমি ব্যবস্থাপনা ও মালিকানাসংক্রান্ত প্রশ্ন একটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ইস্যু। এ প্রেক্ষাপটে ‘ভূমি জরিপ’ একটি অনিবার্য বিষয়, যা শুধু জমির পরিমাপ বা সীমানা নির্ধারণের প্রযুক্তিগত পদ্ধতি নয়—বরং এটি ইতিহাস, প্রশাসন, আইন এবং ন্যায়বিচারের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ভূমি জরিপ একদিকে যেমন ভূমির মালিকানা নির্ধারণের প্রক্রিয়ায় সহায়ক, অন্যদিকে এটি ভূমিসংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি,কর নির্ধারণ এবং উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অন্যতম পূর্বশর্ত।

ভূমি জরিপ কেবল প্রযুক্তিগত একটি প্রক্রিয়া নয়—এটি হচ্ছে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব,ন্যায়বিচারের অংশ এবং জনগণের অধিকার সুরক্ষার একটি অপরিহার্য উপাদান। বর্তমানে ভূমিসংক্রান্ত অধিকাংশ মামলার মূল কারণ হলো: জমির সীমানা ও মালিকানাসংক্রান্ত বিরোধ,যার পেছনে জরিপের ভুল,অনুপস্থিতি বা জালিয়াতি কাজ করছে। সঠিক জরিপ ছাড়া ভূমি কর নির্ধারণ,দলিল রেজিস্ট্রেশন,জমি হস্তান্তর ও প্রজাস্বত্ব নিশ্চিত করা যায় না।

‘ভূমি জরিপ’ বলতে আমরা মূলত একটি নির্দিষ্ট এলাকার ভূমির পরিমাণ, সীমানা, মালিকানা এবং ব্যবহার নির্ধারণের প্রক্রিয়াকে বুঝি। জরিপ শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো সার্ভে, যা বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবহৃত হলেও ভূমি জরিপ একটি নির্দিষ্ট টার্ম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটি মৌজাভিত্তিক মানচিত্র (নকশা) এবং ভূমির মালিকানাসূচক নথি (খতিয়ান) প্রণয়নকে অন্তর্ভুক্ত করে।

১৮৭৫ সালের দ্য সার্ভে অ্যাক্ট-এর ২ ধারা অনুযায়ী,‘জরিপ’বলতে বোঝায় ভূমির সীমানা নির্ধারণ,নদীতীরবর্তী ভূমির পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কার্যক্রম,যা সরকার কর্তৃক পরিচালিত হয়।

ভূমি জরিপের ইতিহাস হাজার বছরের পুরোনো। প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতায় নীল নদের বার্ষিক বন্যায় জমির সীমানা মুছে যেত। ফলে দড়ি, খুঁটি এবং পরিমাপক পদ্ধতির সাহায্যে নতুন করে জমির পরিমাপ ও সীমানা নির্ধারণ করা হতো। এটি ছিল জরিপের আদিম রূপ। ভূমি কর নির্ধারণ, মালিকানা নিরূপণ এবং কৃষি উৎপাদন পর্যবেক্ষণের জন্য মিসরীয়রা ব্যাপক ভূমি জরিপ পরিচালনা করত। উপমহাদেশে ভূমি জরিপের প্রাতিষ্ঠানিক সূচনা ঘটে পাঠান শাসক শেরশাহের আমলে।

তিনি ‘সরকারি রেকর্ড’ সংরক্ষণের জন্য ভূমি পরিমাপ ও শ্রেণিবিন্যাস ব্যবস্থা চালু করেন। পরে মোগল সম্রাট আকবরের রাজস্ব মন্ত্রী রাজা টোডরমল ভূমির পরিমাপ ও মূল্যায়নভিত্তিক একটি ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা চালু করেন। যদিও তৎকালীন জরিপ কার্যক্রম আধুনিক জরিপের তুলনায় পরিপূর্ণ ছিল না, তথাপি এটি একটি কাঠামোগত উদ্যোগ হিসেবে বিবেচিত হয়।

ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতীয় উপমহাদেশে ভূমি জরিপ পদ্ধতির বৈজ্ঞানিক ও পেশাগত ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৭৭৪ সালে জেমস রেনেল ভারতবর্ষের প্রথম সার্ভেয়ার জেনারেল হিসেবে নিযুক্ত হন এবং ১৭৮০ সালে তিনি প্রথম ভারতবর্ষের সাধারণ মানচিত্র (জেনারেল ম্যাপ) প্রস্তুত করেন। ১৮০২ সালে উইলিয়াম ল্যাম্বটনের নেতৃত্বে ‘ত্রিকোণমিতিক জরিপ’ (গ্রেট ত্রিগোনোমেট্রিক্যাল সার্ভে) শুরু হয়, যার মাধ্যমে উপমহাদেশের বিস্তৃত এলাকার নির্ভুল মানচিত্র তৈরি করা সম্ভব হয়।

এরপর পর্যায়ক্রমে চালু হয় ‘মঘী জরিপ’(১৮৩২-১৮৪৮),‘থাকবাস্তু জরিপ’(জমিদারদের তত্ত্বাবধানে),এবং ‘রাজস্ব জরিপ’(১৮৪৭-১৮৭৮), যার নেতৃত্বে ছিলেন কর্নেল স্মিথ। এ জরিপগুলোতে জমির দখলদার,ভূমির শ্রেণিবিন্যাস ও রাজস্ব পরিমাণ নির্ধারণের চেষ্টা করা হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং মৌলিক জরিপ হিসেবে বিবেচিত হয়‘সিএস জরিপ’ বা ক্যাডাসট্রাল সার্ভে,যা ১৮৮৯ সাল থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত পরিচালিত হয়। এ জরিপের মাধ্যমে বাংলাদেশ অঞ্চলের ভূমির সীমানা,মালিকানা ও শ্রেণি নির্ধারণ করে খতিয়ান ও নকশা তৈরি করা হয়। অধিকাংশ জমির মামলার মূলে আজও এই সিএস রেকর্ডের গুরুত্ব অপরিসীম।

১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির পর জরিপ পদ্ধতিতে নতুন পরিবর্তন আসে। ভূমির ওপর সরকারের সরাসরি মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৫৬ সালে ‘এসএ জরিপ’ (স্টেট অ্যাকুইজিশন সার্ভে) চালু করা হয়। এ জরিপের মাধ্যমে রায়তদের রেকর্ড প্রস্তুত ও জমিদারদের ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করা হয়।

পরে শুরু হয়‘পিএস জরিপ’ (পার্সিয়াল সার্ভে) এবং ‘আরএস জরিপ’ (রিভিশনাল সার্ভে)। এগুলোর লক্ষ্য ছিল পূর্ববর্তী জরিপগুলোর ভুল সংশোধন ও হালনাগাদ রেকর্ড তৈরি করা। পাশাপাশি নদী গতি পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট নতুন জমির জন্য ‘দিয়ারা জরিপ’,শহরাঞ্চলের জন্য ‘সিটি জরিপ’ এবং পরে ‘বিএস/বিআরএস জরিপ’(বাংলাদেশ সার্ভে/ রিভিশনাল সার্ভে) পরিচালিত হয়।

বর্তমান ডিজিটাল বাংলাদেশে ভূমি ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়নের অংশ হিসেবে চালু হয়েছে ‘বিডিএস জরিপ’ (বাংলাদেশ ডিজিটাল সার্ভে)। এর মাধ্যমে জিপিএস, জিআইএস, ড্রোন ও স্যাটেলাইট চিত্রের সাহায্যে জমির ডিজিটাল নকশা ও রেকর্ড তৈরি করা হচ্ছে। এতে সীমানা নির্ধারণে নির্ভুলতা ও স্বচ্ছতা বাড়ছে এবং জমিসংক্রান্ত মামলা-জট হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।

ভূমি জরিপ কেবল প্রযুক্তিগত একটি প্রক্রিয়া নয়—এটি হচ্ছে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব, ন্যায়বিচারের অংশ এবং জনগণের অধিকার সুরক্ষার একটি অপরিহার্য উপাদান। বর্তমানে ভূমিসংক্রান্ত অধিকাংশ মামলার মূল কারণ হলো জমির সীমানা ও মালিকানাসংক্রান্ত বিরোধ, যার পেছনে জরিপের ভুল,অনুপস্থিতি বা জালিয়াতি কাজ করছে। সঠিক জরিপ ছাড়া ভূমি কর নির্ধারণ,দলিল রেজিস্ট্রেশন,জমি হস্তান্তর ও প্রজাস্বত্ব নিশ্চিত করা যায় না।

ভূমি জরিপ ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও নির্ভুলতা আনতে হলে প্রযুক্তির সঙ্গে দক্ষ জনবল,যথাযথ তদারকি এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকা জরুরি। ডিজিটাল জরিপ কার্যক্রমকে সফল করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনিক জটিলতা,তথ্যভিত্তিক বিরোধ এবং মাঠপর্যায়ের দুর্নীতি বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় জনসচেতনতা, তথ্যপ্রযুক্তি প্রশিক্ষণ এবং আইনি সংস্কার প্রয়োজন।

ভূমি জরিপ কোনো নিছক প্রযুক্তিগত পরিমাপের বিষয় নয়; এটি একটি জাতির অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, সামাজিক শান্তি এবং রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার অন্যতম মৌলিক উপাদান। সীমানা নির্ধারণের দড়ি যতটা মাটি ছোঁয়,তার চেয়েও বেশি ছুঁয়ে যায় মানুষের অধিকারবোধ,নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচারের আকাঙ্ক্ষা। অতীতের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা,বারবারের ভুল এবং দেরিতে হলেও গৃহীত সংশোধনমূলক পদক্ষেপগুলো আমাদের সামনে একটি বিষয় স্পষ্ট করে দিয়েছে—জমির ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হলে জরিপ ব্যবস্থাকে হতে হবে আধুনিক, স্বচ্ছ ও টেকসই।

তাই ভবিষ্যৎ ভূমি ব্যবস্থাপনার ভিত্তি হিসেবে একটি যুগোপযোগী,তথ্যভিত্তিক ও জনগণের আস্থাভাজন জরিপ কাঠামো গড়ে তোলা কেবল প্রশাসনিক সংস্কার নয়, বরং এটি একটি সামাজিক ন্যায়বিচারের অঙ্গীকার। এ অঙ্গীকার বাস্তবায়নের জন্য চাই নিরবচ্ছিন্ন রাজনৈতিক সদিচ্ছা,দক্ষ জনবল,প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ এবং সর্বোপরি, জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা। কারণ ভূমির প্রশ্নে ন্যায়বিচার কেবল আদালতে নয়,শুরু হয় সঠিক জরিপের রেখায়।

লেখক : ড.জাহাঙ্গীর আলম সরকার,আইনজীবী ও গবেষক।