Home / খেলাধুলা / আলোচিত মিরাজের হাতে খড়ি যাঁর কাছ থেকে
আলোচিত মিরাজের হাতে খড়ি যাঁর হাত ধরে

আলোচিত মিরাজের হাতে খড়ি যাঁর কাছ থেকে

শুধু বাংলাদেশ নয় ক্রিকেটের গোটা দুনিয়া এখন চেনে মেহেদী হাসান মিরাজকে। সদ্য সমাপ্ত বাংলাদেশ-ইংল্যান্ড টেস্ট সিরিজে ঘূর্ণির জাদু দিয়ে ইংলিশদের ভেলকি দেখানো এই ক্রিকেটারের ‘মিরাজ’ হয়ে ওঠার শুরুটা যাঁর হাত ধরে তিনি মো. আল মাহমুদ। মিরাজের প্রথম কোচ।

খুলনার খালিশপুর এলাকার কাশিপুর ক্রিকেট একাডেমির সাধারণ সম্পাদক ও প্রশিক্ষক তিনি। আল মাহমুদের হাতেই আনুষ্ঠানিকভাবে ক্রিকেটের হাতেখড়ি মিরাজের।

এমন অনেক খুদে ক্রিকেটারের হাতেখড়ি আল মাহমুদের হাতে। ছবি: সাদ্দাম হোসেনপাঁচ ভাইবোনের সবার বড় আল মাহমুদ। দায়িত্বও বেশি। কিন্তু খেলা যাঁর স্বপ্ন, খেলা যাঁর ধ্যানজ্ঞান, তিনি কি আর ঘর-গেরস্থালির মধ্যে নিজেকে ধরে রাখেন!

নিজে জীবনে ডাকাবুকো ক্রিকেটার হতে পারেননি। তাতেই বা কী? তাঁর ক্রিকেট শেখানোর একাডেমিতে আছে অনূর্ধ্ব-১৪ ও অনূর্ধ্ব-১৭ জাতীয় দলে খেলা দুজন ক্রিকেটার। আর মেহেদী হাসান মিরাজের কথা তো শুরুতেই বলা হলো।

মো. আল মাহমুদের বাড়ি ঝালকাঠি সদর উপজেলার পরমহল গ্রামে। বাবা মো. সামছুল আলম একজন মুক্তিযোদ্ধা। পেশায় ছিলেন মোংলা বন্দরের নিরাপত্তা হাবিলদার। বর্তমানে অবসরে আছেন। চাকরির জন্য তিনি চলে আসেন খুলনায়। খুলনাতেই জন্ম আল মাহমুদের। এখন খালিশপুর উত্তর কাশিপুরের এক ভাড়াবাড়িতে পরিবারের সঙ্গে থাকেন তিনি।

ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেট খেলার প্রতি আল মাহমুদের ছিল প্রবল আগ্রহ। এলাকাভিত্তিক খেলা দিয়ে শুরু। খুলনা ও ঢাকা সিনিয়র ডিভিশনে খেলা কাশিপুর এলাকার ক্রিকেটার মো. ডিউককে দেখে আল মাহমুদের খেলা শুরু। ডিউক তাঁকে হাতে ধরেও খেলা শেখাতেন। এরপর ১৯৯৮ সালের দিকে আল মাহমুদ যোগ দেন কাশিপুর লিভারপুল ক্লাবে। মূলত ছিলেন ডানহাতি ব্যাটসম্যান। খেলেছেন দ্বিতীয় বিভাগ পর্যন্ত। হাঁটুর ইনজুরির কারণে খেলাকে বিদায় জানান ২০০৩ সালে।

নিজের খেলার অধ্যায় শেষ হলেও ক্রিকেট নিয়ে স্বপ্ন দেখা ছাড়েননি আল মাহমুদ। নিজ হাতে ক্রিকেটার তৈরির স্বপ্ন দেখেন। ২০০৪ সালে মাত্র ২০ বছর বয়সে এলাকার শেখ খালিদ আহমেদকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন কাশিপুর ক্রিকেট একাডেমি।

একাডেমি প্রতিষ্ঠার পর শুনেছেন নানাজনের কটুকথা। প্রশ্ন উঠেছে তাঁর ক্যারিয়ার নিয়েও। কিন্তু দমে যাননি তিনি। আল মাহমুদ বলেন, ‘একাডেমি প্রতিষ্ঠার পর খুব বেশি সাড়া পাইনি। আড়ালে অনেকে টিপ্পনীও কাটত। কিন্তু তাতে দমে যাইনি। চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করেছি। এখন এই একাডেমি প্রিমিয়ার ডিভিশন পর্যন্ত খেলে।

বর্তমানে প্রশিক্ষণার্থী রয়েছে দুই শতাধিক।’ আল মাহমুদ ২০০২ সালে এসএসসি পাস করেছেন নয়াবাটি হাজী শরীয়ত উল্লাহ বিদ্যাপীঠ থেকে। আর ২০০৬ সালে
এইচএসসি পাস করেছেন খালিশপুরের মহসিন কলেজ থেকে।

২০০৬ সালের দিকে কাশিপুর ক্রিকেট একাডেমিতে মিরাজের সঙ্গে পরিচয় আল মাহমুদের। তিনি বলতে থাকেন, ‘মিরাজের বয়স তখন মাত্র আট বছর। ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহ দেখে রাসেল নামের একাডেমির এক ছাত্র মিরাজকে আমার কাছে নিয়ে আসে। ওই দিনই মিরাজকে নামিয়ে দিই অনুশীলনে। লিকলিকে গড়নের ছেলেটি প্রথম দিনই ভিন্ন কিছু করে দেখায়। তার বোলিং, ফিল্ডিং অ্যাকশন ছিল সবার থেকে আলাদা। ওই বয়সেই “কাঠের” বল ধরার কৌশল দেখে মুগ্ধ হই আমি।’ আর্থিক সামর্থ্য না থাকার পরও মিরাজকে অনুশীলনের সুযোগ দিয়েছিলেন কাশিপুর ক্রিকেট একাডেমির প্রশিক্ষক মো. আল মাহমুদ।

অভাবের সংসারে বাবার বাধার কারণে মিরাজের খেলা প্রায় বন্ধ হতে বসেছিল। তাই মিরাজের বাবাকে খেলায় বাধা না দিতে বিভিন্নভাবে বোঝাতেন মো. আল মাহমুদ। অনেক ছেলেকেই এভাবে সুযোগ করে দিয়েছেন এই একাডেমিতে প্রশিক্ষণ নেওয়ার। পাশাপাশি নানা রকম সাপোর্ট দেন তাদের। কাশিপুর ক্রিকেট একাডেমির নিজস্ব কোনো মাঠ নেই। একাডেমির প্র্যাকটিস হয় খুলনা বিএল কলেজ মাঠে। আর ম্যাচ হয় ফুলতলা উপজেলা ডাবুর মাঠে। ৭ নভেম্বর বিকেলে বিএল কলেজের সীমানায় থাকা কলেজিয়েট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে বসেই এসব কথা হয় আল মাহমুদের সঙ্গে।

আগের দুদিন হওয়া বৃষ্টিতে মূল মাঠে কাদা থাকায় পাশের বালু ফেলা মাঠে ছেলেদের প্র্যাকটিস করাচ্ছিলেন তিনি। দেখা যায়, সেখানে ৮ থেকে ২৫ বছরের অনেক ছেলে প্র্যাকটিস করছেন। কোনো দল ব্যাটিং, কোনো দল ফিল্ডিং আবার কোনো দল করছে ক্যাচ প্র্যাকটিস। পাশেই বসে নির্দেশনা দিচ্ছেন আল মাহমুদ। এরই ফাঁকে কথা বলার জন্য কিছুটা সময় দেন। ছাত্ররা সবাই বস বলেই সম্বোধন করে তাঁকে।

কাশিপুর ক্রিকেট একাডেমির সভাপতি শেখ খালিদ আহমেদ বলেন, ‘আল মাহমুদের মধ্যে কোনো লোভ-লালসা নেই। সব সময় এলাকার ছেলেদের খেলা নিয়ে সব ধরনের সহযোগিতা করার জন্য এগিয়ে আসে সে। প্রশিক্ষক হিসেবে একাডেমি থেকে কখনো কোনো বেতন দাবি করেনি আল মাহমুদ।’

আল মাহমুদের কথা সব সময় মানেন মিরাজ। মুঠোফোনে বললেন, ‘প্রথম দিনই আমার খেলার কিছু ধরন বসের (আল মাহমুদ) ভালো লেগেছিল। বয়সের ব্যবধান অনেক হলেও তখন থেকেই দুজনের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আর এখন এমন হয়েছে যে তাঁর কাছ থেকেই আমরা পারিবারিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিই।’

মেহেদী হাসান মিরাজ যেমন তাঁর প্রথম কোচের কথা মনে রাখেন সব সময়, তেমনি আল মাহমুদও তাঁর এই প্রতিভাবান ছাত্রকে নিয়ে গর্ব করেন। (প্রথম আলো)

Leave a Reply