Home / উপজেলা সংবাদ / ফরিদগঞ্জ / ফরিদগঞ্জে চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে
অর্থ আত্মসাতের
লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ

ফরিদগঞ্জে চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে

চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার ১৪ নং ফরিদগঞ্জ দক্ষিণ ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মোঃ আলমগীর হোসেন রিপনের বিরুদ্ধে একই পরিষদের ৫জন ইউপি সদস্য টি আর, কাবিখা, এলজিএসপি প্রকল্পে ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছেন।

অভিযোগকারীরা হলেন, ইউপি সদস্য মোঃ মাইনুল ইসলাম রাসেল, মোঃ জাহাঙ্গীর, মোঃ আনোয়ার হোসেন, মোঃ মোস্তফা পাটওয়ারী, রফিকুল ইসলাম বাচ্চু। তারা গত ৩ এপ্রিল এই অভিযোগ করেন। যদিও পিআইও অফিসে ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যদের নিয়ে সমঝোতা করেছেন বলে দাবী করেছেন পিআইও।

অভিযোগে প্রকাশ, টিআর, কাবিখা, কাবিটা, এলজিএসপি প্রকল্প ও ১% টাকার ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা আত্মসাত করেছেন অত্র ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। ৯নং ওয়ার্ডে হর্ণি দূর্গাপুর গ্রামের তিনটি ইউনিয়নের সীমানা সংযোগকারী খালের উপর জনগণের অর্থায়নে প্রায় ২ বছর পূর্বে কালভার্ট নির্মিত হলেও শুধু মাত্র কালভার্টের রেলিং করেই ৩ লক্ষ ৫৫ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়।

একই ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য টিপুর বাড়ির সামনের মুনছুর আলী বেপারী বাড়ির সামনের বায়তুন নুর জামে মসজিদের শৌচাগার নির্মাণ, ৬নং ওয়ার্ডের দক্ষিণ চরবড়ালি বরকন্দাজ বাড়ির মসজিদের সামনে শৌচাগার নির্মাণের কথা বলে এলজিএসপি প্রকল্প থেকে কয়েক লক্ষ টাকা উত্তোলন করা হয়। কিন্তু বাস্তবে এইসব প্রকল্পের কোন অস্তিত্ব নেই।

প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ প্রকল্প ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রনালয়ের ঘর বাবদ ৩,২৪,০০০ টাকার ঘর জনসাধারণ থেকে ৮০ হাজার টাকা দিয়ে ঘর বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। এছাড়া করোনা কালিন সময়ে সরকারের দেওয়া মাস্কসহ অন্য উপকরণ বাবদ ৫০ হাজার টাকা, হোল্ডিং ট্যাক্স, জম্ম নিবন্ধন, ট্রেড লাইন্সেস, প্রতিবন্ধী/বয়স্ক/মাতৃত্বকালীন/ভিজিডি কার্ড বাবদ অতিরিক্ত অর্থ আদায় ও সরকারি টিউবওয়েল বাবদ ২০ হাজার টাকা করে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এই সকল বিষয় ইউপি সদস্যগণ প্রতিবাদ করলে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়ার হুমকি দেয়া হয় বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।

সরেজমিন ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে লোকজনের সাথে কথা বলে অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। ৯নং ওয়ার্ডের হর্নিদুর্গাপুর গ্রামের ৩টি ইউনিয়নকে বিভক্তকারী খালের উপরে স্থানীয় লোকজনের অর্থায়নে প্রায় দুই বছর পুর্বে কালভার্ট নির্মাণ করা হলেও কয়েকমাস পুর্বে ওই কালভার্টের উপর রেলিং নির্মাণ করা হয়েছে।

লোকজন জানান, পাশ্ববর্তী গুপ্তের বিলে জমি জমা ও ফসলি জমি থাকার কারণে প্রায় দুই বছর পুর্বে স্থানীয় লোকজনের অর্থায়নে এই কালভার্টটি নির্মিত হয়। ওয়ার্ড যুবলীগ সভাপতি মিস্টার জানান, আমারসহ হর্নিদুর্গাপুরের অনেকের গুপ্তের বিলে জমি রয়েছে। স্থানীয় বাবলু সহ অনেকে ২ বছর পুর্বে এই কালভার্টটি নির্মাণ করে। তবে কয়েকমাস পুর্বে শুধু রেলিং নির্মাণ করা হয়েছে।

একই ওয়ার্ডের মুনছুর আলী বেপারী বাড়ির সামনের বায়তুন নুর জামে মসজিদের শৌচাগার নির্মাণ, ৬নং ওয়ার্ডের দক্ষিণ চরবড়ালি বরকন্দাজ বাড়ির সামনে শৌচাগার নির্মাণের কথা বলে এলজিএসপি প্রকল্প থেকে কয়েক লক্ষ টাকা উত্তোলন করা হয়। মুনছুর আলী বেপারী বাড়ি মসজিদের সামনে গিয়ে লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সেখানে মসজিদ কমিটি নিজেদের অর্থায়নের মসজিদের শৌচাগার ও অজুখানা তৈরি করেছেন। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে কোন বরাদ্দ পাননি। চরবড়ালি বরকন্দাজ বাড়ির প্রবীণ ব্যক্তি সার্জেন্ট(অব:) রুহুল আমিন বরকন্দাজ জানান, তার বাড়ির সামনের শৌচাগারটি গত ১৫/২০ বছর পুর্বে নির্মিত। অদ্যবদি কোন সরকারি বরাদ্দ পাননি। এসময় তিনি এই স্থানে শৌচাগার নির্মাণে টাকা উঠিয়ে নেয়ার কথা শুনে হতবাক হয়ে যান।

কালিবাজার রাস্তা মেরামত বাবদ ২লক্ষাধিক টাকা উত্তোলন করা হয়েছে বলে অভিযোগ থাকলেও কালির বাজার ব্যবসায়ী কমিটির সভাপতি জাকির খান জানান, বাজারে পুর্ব মাথায় মসজিদের সামনে গড়ে ২০ হাজার টাকার কাজ হয়েছে। আমার কাছ থেকে প্রকল্প কমিটির সদস্য হিসেবে স্বাক্ষর নেয়া হয়েছে। এরপর আর কিছু জানি না। ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি তুহিন রায়হান জানান, আমার নামে বরাদ্দকৃত ঘর ৮০ হাজার টাকার বিনিময়ে ৭নং ওয়ার্ডের বাবুলের নিকট বিক্রি করা হয়েছে।

সবচেয়ে বড় অভিযোগ পাওয়া গেছে, কর্মসৃজন প্রকল্পে। ৪০ দিনের এই কর্মসূচীতে ৬ বছর পূর্বে মৃত ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক মো: মমতাজ এর নামে কৃষি ব্যাংকে হিসাব খুলে ( হিসাব নং- ৮৮০৩) অর্থ উত্তোলন করা হয়েছে। এই রকম আরো অন্তত ১২জন মৃত ব্যক্তির নামে হিসাব রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। মৃত ব্যক্তির নামে ব্যাংকে হিসাব খুলে অর্থ আত্মসাতের এসব নমুনায় পুরো ইউনিয়নে তোলপাড়ের সৃষ্টি হয়েছে।

জানা গেছে, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, কালির বাজার শাখায় ৪০ দিনের কর্মসৃজন কর্মসূচীতে মোঃ মমতাজ পিতা নুর মোহাম্মদ হিসাব নং ৮৮০৩, মোঃ কামাল পিতা আঃ আজিজ হিসাব নং ৮৮০৪, হাছিনা বেগম পিতা কামাল হিসাব নং ৮৮৯৯, মাসুদ আলম পিতা মোহাম্মদ উল্ল্যা হিসাব নং ৮৯৮২, তছলিম হোসেন পিতা নুর মোহাম্মদ হিসাব নং ৯৬৪৯, ইউনিয়ন শ্রমিকলীগের সভাপতি ২বছর যাবৎ প্যারালাইসিস রোগে আক্রান্ত, নাছির আহমেদ পিতা মফিজুল হক হিসাব নং ৯৬৫৪ তিনি সৌদি প্রবাসী, আবু খা পিতা মৃত সেকান্দর খা হিসাব নং নাম দিয়ে হিসাব খুলে টাকা উত্তোলন করা হয়েছে।

এসব অভিযোগ বিষয়ে ইউপি সদস্য মাইনুল ইসলাম ও মোঃ জাহাঙ্গীর জানান, আমরা জনগনের ভোটে নির্বাচিত হয়েছি। আমরা ভোটারদের যে কথা দিয়েছি তা রাখতে পারছি না, ইউপি চেয়ারম্যান আলমগীর হোসেন রিপনের কারণে। তাকে আমরা বার বার বললেও সে উল্টা আমাদের মামলার হুমকি দেয়। কোন সভা না করে নিজের বাড়িতে বসে সকল কাজ পরিচালনা করে, ঠিকমত পরিষদে পযর্ন্ত আসে না।

বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, কালির বাজার শাখার ম্যানেজার গনেশ চন্দ্র দাস ৬ বছর আগে মারা যাওয়া মোঃ মমতাজ পিতা নুর মোহাম্মদ হিসাব নং ৮৮০৩ হিসাব সঠিক বলে জানিয়ে বলেন, আমরা অভিযোগ পেয়ে টাকা উত্তোলন বন্ধ করে রেখেছি। তবে এসব হিসাব খোলার ব্যাপারে সবকিছু চেয়ারম্যান নিজেই দেখেন। ৪০ দিনের কর্মসূচীর সকল কিছুই চেয়ারম্যানের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত ।

অভিযোগের বিষয়ে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আলমগীর হোসেন রিপন বলেন, আমার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগগুলো সম্পূর্ন মিথ্যা। কর্মসৃজন প্রকল্পে নিজেদের অংশ না পেয়ে ইউপি সদস্যরা এই অভিযোগ করেছে। আমি শতভাগ স্বচ্ছ। অভিযোগের বিষয়ে আমি জানতাম না। পিআইও আমাকে জানালে আমি তার অফিসে যাই। পরে তিনি সকল ইউপি সদস্যদের নিয়ে বৈঠক করেন। সেখানে লিখিত অভিযোগকারীরা কর্মসৃজন প্রকল্পে তাদের নাম না থাকায় এই অভিযোগ করে । পরে পিআইও নির্দেশে আমি সকল ইউপি সদস্যদের নামে প্রকল্প দিয়েছি।

এলজিএসপি প্রকল্পের বিষয়ে তিনি বলেন, কয়েকটি প্রকল্পে এখনো কাজ করেনি। চলতি অর্থ বছরের সাথে ওই টাকা সমন্বয় করে দিয়ে নতুন প্রকল্প দেয়া হবে।

ইউনিয়ন পরিষদের সচিব মোঃ আমির হোসেন সাথে কথা বললে তিনি অভিযোগ সম্পর্কে জানেন না বলে জানান।

এই বিষয় ফরিদগঞ্জ উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মিল্টন দস্তিদার জানান, গত শনিবার ইউএনওর নির্দেশে আমি ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যদের বৈঠক করেছি। সেখানে সমাধান করা চেষ্টা করেছি। কর্মসৃজন প্রকল্পে মৃত ব্যক্তির নামে হিসাব খোলা ও টাকা উত্তোলনের বিষয়ে তিনি বলেন, এসব বিষয়ে ইউপি চেয়ারম্যান ও ব্যাংক কর্মকর্তারা দায়ী। তারা এসব বিষয়ে যাচাই বাছাই না করায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শিউলি হরি ইউপি চেয়ারম্যান আলমগীর হোসেন রিপনের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ পাওয়ার কথা জানিয়ে বলেন, সকলকে ডেকে বিষয়টি সুরাহা করার ব্যবস্থা রয়েছে। যে অভিযোগ তারা দিয়েছে সে সকল বিষয়ে আমরা তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।

প্রতিবেদক:শিমুল হাছান,১২ এপ্রিল ২০২১