ক্রিকেট ফিরছে ঘরে। ইংল্যান্ডে বিশ্বকাপের পাঞ্চলাইন এটাই। ঘরে ফেরা তো মহা আনন্দের। তবে সেই গৃহপ্রবেশ দেখতে যদি পৃথিবীর এ প্রান্তে কেউ আসেনও, সঙ্গে ছাতা আনতে ভুলবেন না। ইংলিশ সামার তার সবটুকু রহস্যময়তা ছড়িয়ে গতকাল দিনভর বৃষ্টির কান্না কেঁদেছে এবং আবহাওয়ার পূর্বাভাস বলছে, আরো কাঁদবে। সঙ্গে আনা ছাতায় তাই শরীর শুকনো রাখা যাবে, আবার বিশ্বকাপকে ঘিরে উপমহাদেশীয় উত্তেজনার ঘাটতি দেখে মুখাবয়বে বিষণ্নতার ছায়াও আড়াল করা যাবে!
ইংল্যান্ডের ফুটবল সেই শুরু থেকেই লাতিন আমেরিকার, নয়তো ইউরোপের অন্য কোনো দেশের। ক্রিকেটের একটা বৈশ্বিক ট্রফি তাদের আছে, তবে সেটি টি-টোয়েন্টির, ওয়ানডের নয়। টি-টোয়েন্টির রমরমা বাজারেও ওয়ানডের সেরাকেই সত্যিকারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন মনে করা হয়। আজ বিশ্বকাপের দ্বাদশ আসর শুরুর দিনে অবশ্য বর্তমান চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া নামছে না। নামছে স্বাগতিক ইংল্যান্ড, প্রতিপক্ষ দক্ষিণ আফ্রিকা।
কয়েকবারের অভিজ্ঞতায় জানাই ছিল যে বিশ্বকাপ নিয়ে কোনো হুটোপুটি দেখা যাবে না ইংল্যান্ডে। কিন্তু এবার তো তারা হট ফেভারিট। তাতে আগ্রহ অন্য যেকোনো বারের চেয়ে বেশি চোখে পড়বে। কিন্তু কিসের কী? এউইন মরগ্যানদের কোনো কাট আউট নেই পথেঘাটে। মাঝেমধ্যে ইংল্যান্ড ওয়ার্ল্ড কাপ ২০১৯ লেখা ব্যানার চোখে পড়ে শুধু। তবে ইংল্যান্ডে ক্রিকেটের মর্যাদা বিবেচনায় এটুকুও কম নয়। ভিনদেশের হাঁড়ির খবর পাওয়া যায় সে দেশটির ট্যাক্সি ড্রাইভারদের কাছে। সেই তাদের শত প্ররোচনাতেও বিশ্বকাপ রোমাঞ্চে সংক্রমিত করা গেল না।
ইংল্যান্ডের মাঠের বিশ্বকাপও তাই পুরোপুরি ‘উপমহাদেশীয়’। আরো নির্দিষ্ট করে বললে ভারতীয়। এখানে ইন্ডিয়ান ফুডের বিশাল বাজার। শুনেছি সে বাজারে জায়গা করে নিতে আমাদের অনেক প্রবাসী ভাইও ‘ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট’ ব্যবসায়ী। সেদিন কার্ডিফে বাংলাদেশ-ভারত প্রস্তুতি ম্যাচ দেখার অভিজ্ঞতা সেটি আরো বেশি করে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে। সোফিয়া গার্ডেন পেরিয়ে স্টেডিয়ামের ফটকে যেতে হয়।
তো, সেটুকু পথজুড়ে পতাকা, টুপি আর পাগড়ির হকারদের সারি। ভারতের তেরঙ্গার সঙ্গে কয়েকটা বাংলাদেশি পতাকাও চোখে পড়েছে। তবে আবহ পুরোপুরি ‘ইন্ডিয়ান’। বাইরে যেমন, ভেতরের গ্যালারিতেও তেমন। এসবও আসলে প্রত্যাশিত। সেই কবে থেকেই তো ক্রিকেট ভারতীয় খেলা! ক্রিকেট পর্যটকদের জন্য ইংল্যান্ড বিশ্বকাপ নতুন উপলব্ধিও দেবে। একদা উপমহাদেশ শাসন করেছে ব্রিটিশরাজ। অথচ আজ সেই ব্রিটিশদের ঘরের ক্রিকেটরাজ করছে ভারত। সেই রাজার খেলার কর্তৃত্ব এখন প্রজার হাতে!
তার মানে এই নয় যে ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপ খুব ম্যাড়মেড়ে হবে। ক্রিকেট চর্চার ব্যাটন বদল হলেও লর্ডস-এজবাস্টনের গ্যালারি ঠিকই ভরে ওঠে। উপমহাদেশের সঙ্গে পার্থক্য হলো, ম্যাচ-ডের আগে-পরে ক্রিকেট ছাড়াও আরো অনেক কিছু নিয়ে ভাবনার আছে এখানকার লোকজনের। গ্যালারিতেও আজকাল উপমহাদেশীয় দর্শকেরই প্রাধান্য। সেই তারা ম্যাচ দিবসের আগে ক্রিকেট থেকে দূরে থাকেন। কার্ডিফে এক অবস্থাপন্ন বাংলাদেশিই বলছিলেন, ‘ইচ্ছা থাকলেও সব ম্যাচ দেখা হয় না। ছুটি পাই না যে।’ যারা খেটে খাওয়া প্রবাসী, তাদের প্রতিটি ঘণ্টার অর্থমূল্য আছে। হয়তো সে কারণেই ক্রিকেট নিয়ে উপমহাদেশীয় হুল্লোড় নেই এখানে।
তবে আইসিসি প্রাণপণ লড়ে যাচ্ছে ভারতকে অবলম্বন করে বিশ্বকাপের ইংল্যান্ডকে জাগাতে। উন্নত দেশের নগর পরিকল্পনাতেই নেই ব্যানার-ফেস্টুন দিয়ে শহর ঢেকে ফেলার। তবে অনলাইন যুগের সব উপকরণই প্রচারণার কাজে এবার ব্যবহার করছে আইসিসি। ম্যাচের, দলের, ক্রিকেটারদের খবরাখবরের ভিডিও কিংবা টেক্সট মুহূর্তেই ছড়িয়ে দিচ্ছে সর্বত্র। তাতে বিশ্বকাপের প্রসার কতটা হলো, তা বোঝা যাবে আরো কিছুদিন পরে। এ যেন সব দলের বিশ্বকাপ জয়ের প্রস্তুতির মতো ব্যাপারই। আপনি তৈরি হয়ে এসেছেন। কিন্তু বিশ্বকাপ জিতবেনই—এ গ্যারান্টি বিশ্বকাপের মাঠে নেই। সে দলটি ফর্মের তুঙ্গে থাকা ইংল্যান্ড হলেও।
১০ দলের এবারের আসরে যদিও ইংল্যান্ডই অবিসংবাদিত ফেভারিট নয়, অস্ট্রেলিয়াও দারুণ ফর্মে আছে। ভারতকে কেউই হিসাবের বাইরে রাখছেন না। পাকিস্তানের তো ঠিক-ঠিকানা নেই, যা ভাববেন করবে ঠিক উল্টোটা। সময় খারাপ যাচ্ছে বলেই ‘আনপ্রেডিক্টেবল’ ১৯৯২ বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়নদের ঘিরে আশাবাদী অনেকে। নিউজিল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, ক্রিস গেইল-আন্দ্রে রাসেলদের ওয়েস্ট ইন্ডিজ ঘুরে বাংলাদেশের নামও উচ্চারিত হচ্ছে বিশেষজ্ঞদের মুখে।
ছোট দলগুলোর সম্ভাবনার পথে সবচেয়ে বড় বাধা মনে করা হচ্ছে টুর্নামেন্টের ফরম্যাট। নক আউটে যাওয়ার আগে প্রতিটা দল মুখোমুখি হবে পরস্পরের। তাতে আগের মতো গ্রুপে একটা বড় দলকে ‘মেরে’ই নক আউট পর্বে ওঠার সুযোগ নেই। পুড়ে খাক হয়ে যেতে হবে শিরোপার কাছে। তবে শুধু ছোট কেন, বড় দলের জন্যও এবারের বিশ্বকাপ বৈতরণি পার হতে কঠিন পরীক্ষাই দিতে হবে। কাপ জিততে হলে ১১ ম্যাচ খেলতে হবে। এতটা সময় মনঃসংযোগ ধরে রেখে ধারাবাহিক ক্রিকেট খেলা যে কারোর জন্যই কঠিন।
মনঃসংযোগ ধরে রাখার ব্যাপারটা অবশ্য ভাবনারই। ক্রিকেটারদের সঙ্গে সঙ্গে দর্শকদেরও। গতবার শিরোপা জয়ের পথে ৮ ম্যাচ খেলতে হয়েছিল অস্ট্রেলিয়াকে। এবার সেটা বেড়েছে। কিন্তু সঙ্গে দর্শকদের আকর্ষণও বাড়বে তো? গতকাল উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে নাচ-গানের সঙ্গে গোপন রাখা বিশেষ ‘সারপ্রাইজ’ও রেখেছে আইসিসি।
এখন ২০১৯ বিশ্বকাপের থলেতে দর্শকদের জন্য বিশেষ আকর্ষণ থাকলেই হয়!