বিদেশে যে ১০ জেলার শ্রমজীবী মানুষ বেশি : প্রবাসীর দিক থেকে চাঁদপুর ৬ষ্ঠ

দেশের দেড় কোটির ওপর মানুষ এখন পৃথিবীর নানা দেশ তথা বিদেশে অভিবাসী হিসেবে কাজ করছেন। গড়ে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর ৭ লাখের বেশি লোক বিদেশে যাচ্ছেন কাজের খোঁজে।

বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের অভাব এবং দারিদ্রের কারণেই অনেকে বিপদজনক পথ পাড়ি দিয়ে উন্নত দেশে যাওয়ার পথ বেছে নিয়ে থাকেন আমাদেরে দেশের শ্রমজীবীরা ।

আবার বাংলাদেশি শ্রমিকদের বিদেশে যাওয়ার ক্ষেত্রেও ঝক্কি ঝামেলা কম নয়। জনশক্তি রফতানির ক্ষেত্রে বেপরোয়া অতি মুনাফালোভী মধ্যস্বত্বভোগী বা দালালদের দৌরাত্ম্য কোনো ভাবেই রোধ করা যাচ্ছে না। ফলে সরকারের ঘোষণা সত্ত্বেও অভিবাসন ব্যয় কোনোভাবেই কমছে না। একজন বিদেশগামী শ্রমিককে কয়েকগুণ বেশি টাকা খরচ করে বিদেশ যেতে হচ্ছে।

নিজে পরিশ্রম করে টাকা উপার্জনের জন্য বিদেশে যেতে চাইলেও নানা কারণে এ পথটা তাদের জন্য মসৃণ নয়। তারপরও প্রতিবছরই বড় সংখ্যার বাংলাদেশি শ্রমিক বিদেশে যাচ্ছেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো-বাংলাদেশের সব এলাকা বা জেলা থেকে মানুষ বিদেশে যাওয়ার জন্য আগ্রহী নন। উন্নত দেশগুলোতে যাওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি জেলার মানুষ রয়েছে অনেকটাই এগিয়ে।

কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর মতে, বাংলাদেশের যেসব জেলার মানুষ সবচেয়ে বেশি বিদেশে যান-এরমধ্যে কুমিল্লা,চট্টগ্রাম,বি বাড়িয়া,টাঙ্গাইল ,ঢাকা, চাঁদপুর,নোয়াখালী.মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী ও ফেনী ।

কুমিল্লা বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি মানুষ বিদেশে গেছে কুমিল্লা জেলা থেকে। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো বলছে, ২০০৫ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত কুমিল্লা থেকে মোট ৬ লক্ষ ১৯ হাজার ১৩৮ জন বিদেশে গেছেন। যেটা রপ্তানি হওয়া মোট জনশক্তির প্রায় ১০.৯৪ % ।

চট্টগ্রাম ২০০৫ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত এ দশ বছরে এ জেলা থেকে বিদেশে গেছেন ৫ লাখ ৪১ হাজার ৭০৯ জন। জনসংখ্যা রপ্তানির হিসাবে এটা প্রায় ৯.৫৭ শতাংশ।

ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া জেলা থেকে বিদেশে গেছেন ২ লাখ ৯৫ হাজার ৩৮১জন। শতাংশের হিসাবে যা ৫.২২ শতাংশ। টাঙ্গাইল

টাঙ্গাইল টাঙ্গাইল জেলা থেকে বিদেশে গেছেন ২ লাখ ৯০ হাজার ৭১৭ জন। শতাংশের হিসাবে ৫.১৪ ভাগ।
ঢাকা বাংলাদেশের দেশের রাজধানী ঢাকা। ঘনবসতি পূর্ণ ঢাকা জেলা থেকে এ দশ বছরে বিদেশে গেছেন ২ লাখ ৫৩ হাজার ৭৩৪ জন। শতাংশের হিসাবে যা ৪.৪৮ ভাগ।

চাঁদপুর ২০০৫ সাল থেকে ২০১৫ এ দশ বছরে চাঁদপুর জেলা থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গেছেন ২ লাখ ৩৫ হাজার ৩৩৪ জন। শতাংশের হিসাবে ৪.১৬ ভাগ।

নোয়াখালী নোয়াখালী জেলা থেকে বিদেশে গেছেন ২ লাখ ২৭ হাজার ৩৪ ৩জন বাংলাদেশি । শতাংশের হিসাবে ৪.০২ ভাগ।

মুন্সীগঞ্জ ঢাকার পার্শ্ববর্তী মুন্সীগঞ্জ জেলা থেকে বিদেশে গেছেন ১ লাখ ৭৩ হাজার ৪৭৭জন বাংলাদেশী। শতাংশের হিসাবে ৩.০৬ ভাগ।

নরসিংদী মুন্সীগঞ্জের পরেই রয়েছে রাজধানীর পার্শ্ববর্তী আরেক জেলা নরসিংদী। ২০০৫ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে এ জেলা থেকে বিদেশে গেছেন ১লাখ ৫৯ হাজার ৩৮৪ জন। শতাংশের হিসাবে ২.৮২ ভাগ।

ফেনী তলিকার দশ নম্বরে রয়েছে ফেনী জেলা। এ জেলা থেকে ২০০৫ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে বিদেশে গেছেন ১ লাখ ৫৬ হাজার ১৯৯ জন। শতাংশের হিসাবে যা ২.৭৬ ভাগ।

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন নামক এক সংস্থার এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশ থেকে বিদেশগামীদের মধ্যে ৫২ % যায় দালালদের মাধ্যমে।

সরকারি সুবিধায় বিদেশে যায় মাত্র দেড় শতাংশেরও কম মানুষ। আত্মীয় স্বজনের মাধ্যমে যায় ২১ % । আর নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত প্রায় দেড় হাজার বেসরকারি জনশক্তি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যায় ১৮.৮৪ % মানুষ।

চাঁদপুরের জনশক্তি ও কর্মসংস্থান কার্যালয় সূত্র মতে, মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চাঁদপুরের বৈধ ২ লাখ ৬০ হাজার শ্রমজীবী নিজ নিজ কর্মস্থল থেকে তাদের নিকটতম স্বজনদের কাছে ব্যাংক ও অন্যান্য অর্থলগ্নি এজেন্সির মাধ্যমে ওই র‌্যামিটেন্স প্রেরণ করে থাকেন। সরকারের হিসাবের বাহিরে রয়েছে আরো অসংখ্য । যার কোনো পরিসংখ্যান জানা সম্ভব হয়নি।

চাঁদপুরের প্রবাসীদের শ্রমের বিনিময়ে পাঠানো র‌্যামিটেন্স জেলার প্রায় দু’শতাধিক ব্যাংক শাখায়, শতাধিক শপিংমলে ও ৫ শ’র মত হাটবাজারে অর্থের তারল্য সৃষ্টি করছে এ র‌্যামিটেন্স। গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে অবখাঠামোগত উন্নয়নের দৃশ্য চোখে পড়ার মত।

জেলার ব্যবসা-বাণিজ্যে,শিক্ষা,কৃষি,স্ব-স্ব এলাকায় অবকাঠামোর উন্নয়ন,মসজিদ, মাদ্রাসা ও এতিমখানার অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রভৃতি ক্ষেত্রের চিত্র পাল্টে দিয়েছে প্রবাসীদের বৈদেশিক র‌্যামিটেন্স । দিন দিন নতুন নতুন ভবন নির্মিত হচ্ছে। এক শ্রেণির কর্মজীবি মানুষের কর্মসংস্থান বাড়ছে।

চাঁদপুরের সাবেক জেলা প্রশাসক চাঁদপুর প্রেসক্লাবের এক আলোচনা সভায় বলেছিলেন,‘পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ১ কোটি ২০ লাখের মত বাংলাদেশি প্রবাসী রয়েছে। প্রবাসীর বেলায় দেশের অন্যান্য জেলার মধ্যে চাঁদপুরের অবস্থান চতুর্থ ।’

নদীমাতৃক চাঁদপুরের জন্য এটি একটি বিশাল প্রাপ্তি মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা । তবে চাঁদপুরের প্রবাসীদের বেশিরভাগই মধ্যপ্রাচ্য তথা আরব দেশগুলোতে শ্রম ব্যয় করছেন।

এ ছাড়া মালয়েশিয়া, ইতালি, ফ্রান্সসহ,সিংগাপুর, জাপান,দক্ষিণ কোরিয়াসহ অনেক বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চাঁদপুরের প্রবাসী কর্মজীবী রয়েছে। তাঁরাই ওই সব র‌্যামিটেন্স পাঠাচ্ছেন।

চাঁদপুরের সোনালী, অগ্রণী, জনতা ও কৃষি ব্যাংকের আঞ্চলিক কার্যালয়গুলো সূত্রে জানা যায়, সোনালী ব্যাংকের ২০ টি শাখা চলতি বছরের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১০৭ কোটি টাকা। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ২৮ টি শাখা জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯২০ কোটি টাকা।

জনতা ব্যাংকের ১৭ টি শাখা ২৩৮ কোটি ১৬ লাখ টাকা। অগ্রণী ব্যাংকের ২০ টি শাখা ৪৫০ কোটি ৭০ লাখ টাকা বৈদেশিক র‌্যামিটেন্স অর্জন করেছে ।

চাঁদপুরের প্রবাসীরা প্রতি মাসে এ সব র‌্যামিটেন্স বিভিন্ন অর্থলগ্নী আন্তর্জাতিক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদিত এজেন্সির মাধ্যমে এসব র‌্যামিটেন্স প্রেরণ করে থাকে। কোনো কোনো ব্যাংক কেবলমাত্র গোপন একটি পিন নাম্বারের মাধ্যমেও অর্থ লেনদেন করছে । অনেক প্রবাসী গ্রাহক তাদের ব্যক্তিগত হিসাবেও অর্থ প্রেরণ করেন । বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নতুন নতুন শ্রম বাজার উম্মুক্ত হওয়ায় প্রবাসী গমনের সংখ্যা ও বৈদেশিক র‌্যামিটেন্স অর্জন বাড়ছে ।

প্রবাসীরা টাকা প্রেরণের কয়েক মিনিটের মধ্যেই ব্যাংক তার গ্রাহককে কাংখিত অংকের টাকা প্রদান করতে সক্ষম। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদিত বিভিন্ন অর্থলগ্নি এজেন্সির মাধ্যমে বাংলাদেশি প্রবাসীরা তাদের নিজ নিজ কর্মস্থল থেকে ওই অর্থ প্রেরণ করেন বলে অগ্রণী ব্যাংকের একজন কর্মকর্ত বলেন। চাঁদপুরে দৈনিক ১৫০ থেকে ১৬০ জনের বিদেশে যাচ্ছে এমন গমনকারীরা চাঁদপুরের স্টেডিয়াম সংলগ্ন অফিসে ফিঙ্গার প্রিন্প গ্রহণ করছে।

এদিকে -রায়পুর সংযোগ সেতুর পশ্চিম পাশে অবস্থিত চাঁদপুর ইনস্টিটিটিউট অব মেরিন টেকনোলজির প্রশিক্ষণের পরই প্রশিক্ষণার্থীরা মধ্যপ্রাচ্যসহ ২৬ টি দেশে পাড়ি জমাচ্ছে যাচ্ছে।

যে কোনো শ্রমিক হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যসহ ২৬ টি দেশে গমনেচ্ছুক কর্মীদের ওরিয়েন্টেশন কোর্স নামে ফিঙ্গার প্রিন্টি দেয়ার পর ৩ দিনের একটি প্রশিক্ষণ ‘চাঁদপুর ইনস্টিটিটিউট অব মেরিন টেকনোলজি ’থেকে গ্রহণ করে সনদ নিয়ে যেতে হয়। সরকারিভাবে চাঁদপুরের ইনস্টিটিটিউট অব মেরিন টেকনোলজি প্রতিষ্ঠানটি জনশক্তি,কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো কর্তৃক পরিচালিত।

চাঁদপুর ইনস্টিটিউট অব মেরিন টেকনোলজির বর্তমান অধ্যক্ষ প্রকৌশলী মো.আলী আকবর সম্প্রতি চাঁদপুর টাইমসকে তাঁর দেয়া তথ্য মতে, ২০১৭ সালের জুলাই মাসে এর যাত্রা শুরু। এ সালে ৬,৯৬২ জন, ২০১৮ সালে ২১,৭৪৩ জন এবং ২০১৯ সালে জানুুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি এ দু’মাসে ৩ হাজার ১৩ জন ৩ দিনের একটি বর্হিগমন বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে।

বিদেশগামী একজন যুবক যে দেশের ভিসায় যাবেন সে বিষয়ে স্যমক ধারণা লাভে ফিঙ্গার টেস্ট হওয়ার পর তাৎক্ষণিক এ প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য চাঁদপুর ইনস্টিটিউট অব মেরিন টেকনোলজিতে ৩ দিনের প্রশিক্ষণের জন্যে আসতে হয়।

প্রতিবেদক : আবদুল গনি
২৭ মার্চ ২০১৯

Share