ফিচার

আমরা প্রজা নাকি নাগরিক?

প্রজা এর ইংরেজি প্রতিশব্দ tenant, এর আরেকটি অর্থ ভাড়াটিয়া পক্ষান্তরে নাগরিক এর ইংরেজি প্রতিশব্দ citizen, অন্যান্য অর্থ অধবাসী, নগরবাসী ইত্যাদি। মাঝে মাঝে নিজেকে প্রশ্ন করি আমরা কি রাষ্ট্রের প্রজা নাকি নাগরিক? কারণ আমাদের মনোভাবে এ দু’টি শব্দের যথেষ্ট বিচরণ রয়ছে।

উত্তর জানাতে এ শব্দ দু’টি সংশ্লিষ্ট কিছু ইতিহাস আলোচনা করা যেতে পারে।

১৭৫৭ সালে ঐতিহাসিক পলাশীর যুদ্ধে ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হওয়ায় দীর্ঘ ২শ’ বছর লোমহর্ষক আর নানা বঞ্ছনা আর গঞ্ছনার মধ্যে আমাদের পূর্বপুরুষরা ইংরেজ দ্বারা শাসিত হয়েছিলেন। তখন জবরদখলকারী ইংরেজ পৃষ্ঠপোষকতায় জমিদারদের কবলে ছিলেন বিভিন্ন ধর্মের নানা শ্রেণি পেশার মানুষ। তাদের চোখে সাধারণ মানুষরা ছিলেন প্রজা। সমাজ ব্যবস্থায় রাজা আর প্রজার মধ্যে ছিলো বিস্তর ফারাক।

ধর্ম কিংবা রাষ্ট্রীয় সংবিধানের বিপরীতে ছিলো জমিদারী প্রথা। আর এ প্রথা মেনেই বসবাস করাই ছিলো প্রজার কাজ। প্রথা আর প্রজার বাইরে জমিদারগণ তাদের স্বার্থ ছাড়া কোনো কিছু চিন্তা করতেন না। যে জমিদার যতো বেশি নিরীহ প্রজাদের ক্বজায় নিতে পারতেন তিনিই ততো বড় জমিদার হিসেবে বিবেচিত হতেন।

সময়ে পরিক্রমায় প্রজার মধ্য থেকেই বেড়ে উঠা প্রতিনিধিত্বশীল ঐতিহাসিক ব্যক্তিরা তাদের আচরণভঙ্গি ও চালচলনে বেশ কৌশলী হয়ে জাতিকে সচেতন করতে নানামুখী পদক্ষেপ নেন। এর বিপরীতে তাঁদেরকেও ইংরেজদের জেল জুলুম ও হুলিয়া ভোগ করতে হয়। তারপরেও প্রজারা রাজনৈতিক সচেতনতার সুযোগ নিয়ে এক হয়ে ঐতিহাসিক কর্ণধারদের সাথে নিয়ে ইংরেজবিরোধী আন্দোলন শুরু করেন একসময়ে তাতে সফলও হন।

দেশের আনাচে কানাচে থাকায় রাজা কিংবা জমিদার বংশের বর্তমান প্রজন্ম ও স্থাপত্যশৈলীর কিছু অংশ এখনও থাকলেও আজকে তাদের মধ্যে নেই সেই জমিদারী হাঁকডাক। এখন আর কাউকে তাদেরকে খাজনা দিতে হয় না। দেশের সাধারণ শ্রেণি পেশার মানুষদের মতো তারাও নাগরিক।

কিন্তু চিরচেনা ও অন্তরে রক্তক্ষরণ হওয়া ইংরেজ শাসনামলের জমিদারী প্রজাবোধ থেকে নাগরিকত্ববোধ এখনো আমাদের জাগ্রত হয়নি। তাই এ যুগে এসেও বলি সবকিছু রাষ্ট্রের কর্ণধারগণই করবে, আমার করণীয় নেই।

কিন্তু আসলেই কি তাই, বাস্তবতা কি তা বলে? আমি বলবো না! বাস্তবতার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আমরা প্রজা থেকে এখন দেশের নাগরিক। নাগরিক হিসেবে আমার রয়েছে গণতন্ত্র ও আর মত প্রকাশের বিধিসম্মত স্বাধীনতা। এ মর্যাদার জন্যে নাগরিক হিসেবে রয়েছে আমার বেশ কিছু দায়িত্ব।

রাষ্ট্রবিজ্ঞান আর আমার দেশের সংবিধান বলছে নাগরিকের প্রধান কর্তব্য হচ্ছে রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত্য প্রকাশ করা। অর্থাৎ রাষ্ট্রের নির্দেশ মেনে চলা। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, অখ-তা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অক্ষুন্ন রাখার জন্য সর্বদা সজাগ এবং চরম ত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকা। রাষ্ট্রের প্রচলিত আইন এবং সংবিধান মেনে চলা এবং আইনের প্রতি সম্মান দেখানো নাগরিকদের অন্যতম দায়িত্ব। এছাড়া সততা ও সুবিবেচনার সাথে ভোট দেওয়া নাগরিকের পবিত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য। এর ফলে যোগ্য ও উপযুক্ত প্রার্থী জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হবে।

এর বাইরে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্যে রাষ্ট্রকে নির্ধারিত সময়ে ভ্যাট পরিশোধ রাষ্ট্রীয় কাজে সহযোগিতা করা। সরকারি কর্মকর্তা তদুপরি নাগরিকদের সততা ও কাজে একাগ্রতা ও নিষ্ঠার উপর দেশের সফলতা, উন্নতি ও অগ্রগতি নির্ভর করে।

যদিও কাঠখোড় পোড়ানো আর লাখো মানুষের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া নাগরিক অধিকার আজ ইতিহাসের বিকৃতি আর অসুস্থ ধারা রাজনৈতিক চর্চায় কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারপরেও আমি যেহেতু নাগরিক, সে হিসেবে রাষ্ট্রের প্রতি আমারও বেশি কিছু দায়িত্ব কর্তব্য রয়েছে।

এরমধ্যে নাগরিক বেশ কিছু বিষয়ে আত্মবুদ্ধিতে বলিয়ান হলে একটি কল্যাণমূলক আবাসস্থল হিসেবে আমাদের দেশকে গড়ে তুলতে পারি।

ধরুন তীব্র গরমে আপনি ছোট একটি বাচ্চাকে সাথে নিয়ে রাস্তা চলছেন, হঠাৎ চোখে পড়লো ছোট একটি টং দোকান। চকচকে রং সজ্জিত চিপসের প্যাকেট ঝুলছে, বাচ্চাও সেদিকে নজর পড়ছে। কাজে গিয়ে দেখলেন দোকানে ঠা-া পানীয়ও রয়েছে তাকে দশ টাকা দিয়ে একটি চিপস সাথে ছোট বোতলে একটি পানিয় কিনে দিলেন। বাচ্চার হাতে চিপসের প্যাকেট, যথারীতি তার খাওয়া শুরু, বোতলটি আপনার হাতে। বাচ্চা চিপস খাওয়া শেষ, বড়েেদর দেখানো পথ অনুযায়ী খাওয়া শেষে বাচ্চা খালি প্যাবেকটটি রাস্তায় ফেলে দিলো, আপনি তাকে ২য় ধাপে ঠা- পানীয় দিলেন সেটিও একইভাবে রাস্তায় ফেলে দেয়া হলো।

একবার ভাবুনতো প্রতিদিন এভাবে আমার প্লাস্টিক জাতীয় কতো প্যাকেট, বোতল রাস্তায় এখানে সেখানে ফেলে দিচ্ছি। তার কোনো পরিসংখ্যান নেই।
কিন্তু এটি যদি নাগরিক হিসেবে আমি/আপনি উদ্যোগ নেই, তাহলে এ বিষয়ে বড় ধরনের পরিবেশ বিপর্যয় থেকে বাঁচতে পারে দেশ।

এ বিষয়ে একটি সামাজিক সংগঠনের উদ্যোক্তার বরাতে বলছি, দেখুন একমতে হতে পারেন কিনা? উদ্যোগটা এমন হতে পারে, বাচ্চার চিপস খাওয়া শেষ, পরিষ্কার ওই খালি প্যাকেটটি আপনার হাতে নিয়ে নেন। হাতে রাখতে অশ্বস্তি লাগলে খালি প্যাকেটটি সুন্দর করে ভাঁজ করে পকেটে কিংবা ব্যাগে নিয়ে নিতে পারেন। পরে আশেপাশের কোনো ডাস্টবিনে সেটা রেখে দিতে পারেন। একইভাবে বোতলকেও রাস্তায় না ফেলে ডাস্টবিনে ফেললেন। এতে করে এক ঢিলে দু’পাখি শিকার হয়, একটি হলো বাচ্চাকে পরিবেশ রক্ষা শিক্ষা, অপরটি পরিবেশ বিপর্যয় থেকে দেশকে রক্ষা।

আরেকটি নাগরিক দায়িত্ব উল্লেখ করে আজকের লেখার ইতি টানবো, হাসপাতাল, মসজিদ, মন্দির কিংবা শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে থাকা টয়লেটকে বাড়িতে থাকা টয়লেটের মতো ব্যবহার করতে আমরা কোনোভাবেই যেনো আন্তরিক হতে পারছি না। মরুভূমির বিপরীতে নদীমাতৃক এদেশে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো পানির সংকট তুলনামূলক কম। বিশুদ্ধ পানি কিছুটা সংকট থাকলেও টয়লেটে ব্যবহার করার মতো পানির সংকট তেমন নেই। তারপরেও এসব জায়গায় পানি ব্যবহারে আমাদের কৃপণতায় পরবর্তীজন এ টয়লেট ব্যবহার যথেষ্ট অশ্বস্তিতে পড়েন। সাথে পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয় ঘটছে।

এসব দেখে মনে হয়, ইংরেজ শাসনামলের প্রজা মনোভাব থেকে আমরা এখনো পুরোপুরি বের হয়ে নাগরিক মনোভাব হতে পারিনি। তাই এসব ছোটখাটো বিষয়গুলোকে দায়িত্বের মধ্যে নিতে পারছি না।

লেখক- দেলোয়ার হোসাইন
নির্বাহী সম্পাদক,
চাঁদপুর টাইমস

Share