চাঁদপুরের ওয়াকফ বিভাগ ও মসজিদগুলো নিয়ে চাঁদপুর টাইমসের ধারাবাহিক ৪ পর্বের আজকে দেখুন ২য় পর্ব-
চাঁদপুর জেলার ৯৩ ভাগ মসজিদ ও মন্দিরসহ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ওয়াকফ নিবন্ধ নেই। জেলার সাড়ে ৪ সহস্রাধিক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থেকে মাত্র ৩শ’ ৩১ টি স্থাপনা ওয়াকফ এস্টেটে নিবন্ধিত। এর মধ্যে ৬৪টি মসজিদ তাদের আয় থেকে ২১ লাখ ৩৪ হাজার টাকা ট্যাক্স প্রদান করেছে।
জেলার ৯৩ ভাগ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের তো নিবন্ধই নেইই বাকি যে কয়েকটি রয়েছে তারাও তাদের আয়ের অংশ থেকে কর পরিশোধ না করায় লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ২৯ ভাগ অর্থ আদায় হয়েছে। বাকি ৭১ ভাগ ব্যাহত হয়েছে।
চাঁদপুরে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৬৪টি নিবন্ধনকৃত মসজিদ ২১ লাখ ৩৪ হাজার টাকা ওয়াকফ ট্যাক্স বা চাঁদা প্রদান করেছে। ওয়াকফ বাংলাদেশ কার্যালয়, চাঁদপুরের পরিদর্শক মো.আলাউদ্দিন বৃহস্পতিবার (৪ জুলাই) চাঁদপুর টাইমসকে এ তথ্য জানিয়েছেন।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে চাঁদপুর ওয়াকফ বিভাগের চাঁদপুরে ৩০ লাখ ৬৬ হাজার টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। কিন্তু এ থেকে মাত্র ২৯ ভাগ অর্থ আদায় হয়েছে। এর আগে ২০১৭- ১৮ অর্থবছরে ৫৫ টি নিবন্ধনকৃত মসজিদ বা প্রতিষ্ঠান ট্যাক্স দিয়েছে ২০ লাখ ১০ হাজার ।
চাঁদপুর জেলা ওয়াকফ বিভাগের দেয়া তথ্য মতে, জেলার সবগুলো মিলে মাত্র ৩ শ’৩১টি মসজিদ, মাদ্রাসা এতিমখানা, কবরস্থান, হেফজখানা, মন্দির ও গির্জা ইত্যাদি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ওয়াকফ নিবন্ধন রয়েছে। এতে জমির পরিমাণ ১ হাজার ৯ শ’ ২৮ দশমিক ৪১ একর। বাকি ৪,২৪৭টি জুমা‘মসজিদসহ অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ‘জমির ওয়াকফ’ নিবন্ধন নেই বা করা হয়নি।
সাধারণত ওয়াকফকৃত জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত মসজিদ বা অন্য যেকোনো প্রতিষ্ঠান বা মসজিদের দান বাক্সসহ সকল প্রকার আয়ের বার্ষিক হারে ৫% টাকা ওয়াকফ বাংলাদেশে জমা দেয়ার বিধান রয়েছে।
কিন্তু এ বিধি ‘কাজীর গরু কেতাবে আছে গোয়ালে নেই’ প্রবাদ বাক্যের মতোই মিলে যাচ্ছে। চাঁদপুরে কেবল মাত্র ৪ হাজার ৮শ ৪২ টি মসজিদ, মন্দির, মাজার (আয় হয় এমনগুলো)সহ অন্যান্য ধর্মীয় স্থাপনা বা প্রতিষ্ঠান থাকলেও ওয়াকফের নিবন্ধনকৃত স্থাপনার সংখ্যা মাত্র ৩ শ ৩১ টি। এর মধ্যে নিবন্ধিতগুলো মধ্যে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের ৩০ জুন পর্যন্ত মাত্র ৬৪ টি মসজিদ যথাযথভাবে তাদের আয় থেকে কর পরিশোধ করেছে।
এর মধ্যে হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক বড় মসজিদ চলতি অর্থবছরে সবচাইতে বেশি ৫% হারে ওয়াকফ ট্যাক্স প্রদান করেছে। যার পরিমাণ হচ্ছে ১৪ লাখ ৫৮ হাজার টাকা।
দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে হাজীগঞ্জের অপর একটি মাজার সংযুক্ত মসজিদ। এটি হলো মাদ্দাখাঁ মসজিদ। এ প্রতিষ্ঠানটি কর দিয়ে ২ লাখ ৯৪ হাজার টাকা।
ওয়াকফ বিভাগের দেয়া তথ্যমতে, চাঁদপুর সদরে ৫১টি, মতলব দক্ষিণে ৬৭ টি মতলব উত্তরে ১৪টি, হাজীগঞ্জে ৪১ টি, ফরিদগঞ্জে ৭০ টি, কচুয়ায় ৩৩ টি,শাহরাস্তিতে ২৬টি এবং হাইমচরে মাত্র ১০টি মসজিদের ওয়াকফ নিবন্ধন রয়েছে। এ বছর এসবের মধ্য থেকে মাত্র ৬৬ টি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের কমিটি ট্যাক্স প্রদান করেছে।
আদায়ের এমন নিম্নগতি সম্পর্কে মসজিদ কমিটি কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা ও অনীহা আর ওয়াকফ বিভাগের জনবল সংকটকে দায়ী কলেছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে চাঁদপুর শহরে আয়ের খাত রয়েছে এমন বেশ কয়েটি প্রসিদ্ধ মসজিদের ট্যাক্স পরিশোধ করা তো দূরের কথা মসজিদগুলোর জায়গারই ‘ওয়াকফ নিবন্ধন ’ করা হয়নি। এরমধ্যে শহরের পুরানো শতবর্ষী চৌধুরী জামের মসজিদের জমিতে ২৫ টি চলমান দোকান থাকলেও ১৯৪০ সালে ধার্যকৃত ওয়াকফ ট্যাক্স আজোও মাত্র ৩০ টাকা। তাও পরিশোধ করার তথ্য জানা যায়নি। এছাড়া চাঁদপুর শহরে প্রাণকেন্দ্র কালীবাড়ি অবস্থিত বাইতুল আমিন জামে মসজিদের মতো অসংখ্যা মসজিদের ওয়াকফ নিবন্ধন নেই।
চাঁদপুর ইসলামিক ফাউন্ডেশনের তথ্য মতে, জেলার ৮ উপজেলা ও ৮৯ টি ইউনিয়নের হাট-বাজারে, গ্রামে-গঞ্জে,পাড়া-মহল্লায় ৪ হাজার ৮ শ’ ৪২টি মসজিদ রয়েছে। এর মধ্যে ৩৫৫টি পাঞ্জেগানা মসজিদ। বাকি ৪ হাজার ৫ শ’ ৯৭টি জুমা মসজিদ।
এর মধ্যে চাঁদপুর সদরে ৬ শ’ ৬৭টি, মতলব দক্ষিণে ৪ শ’ ৫৫টি মতলব উত্তরে ৫শ’৭৬টি, হাজীগঞ্জে ৬ শ’২৬ টি,ফরিদগঞ্জে ৯ শ’৬০টি, কচুয়ায় ৮শ’৭১টি, শাহরাস্তিতে ৪ শ’৩৩ টি এবং হাইমচরে ২শ ৫৪ টি মসজিদ রয়েছে। এসব অধিকাংশগুলোই জুম’আ মসজিদ।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, অধিকাংশ জমি দাতা বা বর্তমান মসজিদ পরিচালনা কমিটি জমির রেজিস্ট্রি প্রক্রিয়া শেষ না করার কারণে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অধীন ওয়াকফ বাংলাদেশ প্রধান কার্যালয়ের নিবন্ধনের অনুমতিপত্র গ্রহণ করতে পারে নি।
মসজিদের আয় রয়েছে এমন বেশ কটি মসজিদের খতিবগণ মসজিদের সকল প্রকার আয়ের ৫% টাকা ওয়াকফ বাংলাদেশে বার্ষিক হারে তার মসজিদের টাকা জমা দেয়ার বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন অথবা দিচ্ছেন কি না এমন টি নিশ্চিত করে বলতে পারে নি।
দেশের প্রচলিত রেওয়াজ মতে, জমি হস্তান্তর বা হেবা অথবা দান কিংবা বিক্রি যায়ই করুক না কেন সরকারিভাবে রেজিস্ট্রি করে ওয়াকফ করতে হয়।
একজন খতিব প্রতিবেদককে প্রশ্ন করেছেন,‘ মসজিদের সকল প্রকার আয়ের ৫ % টাকা ওয়াকফ বাংলাদেশকে বার্ষিক হারে জমা দিব তবে ওয়াকফ সংস্থা মসজিদকে কী দেবে।?’
এ বিষয়ে ওয়াকফ এস্টেট চাঁদপুরের পরিদর্শক মো.আলাউদ্দিন চাঁদপুর টাইমসকে জানান, ওয়াকফ বাংলাদেশ এর বিধি অনুযায়ী যে কোনো মসজিদ বা এতিমখানা অথবা অন্য যে কোনো প্রতিষ্ঠানকে যে কোনো দাতা বা সমাজসেবক তার জমি ওয়াকফ বাংলাদেশকে দেশের প্রচলিত জমি রেজিস্ট্রি প্রক্রিয়া শেষ করে দলিলের সার্টিফাইড কপি ওয়াকফ বাংলাদেশ কার্যালয়ে জমা দেয়ার পর একটি নির্দিষ্ট ফরম পুরণ করতে হয়। পরবর্তিতে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অধীন ওয়াকফ বাংলাদেশ ঢাকাস্থ প্রধান কার্যালয় নিবন্ধনের অনুমতি প্রদান করে থাকে।
মি. আলাউদ্দিন বলেন, ‘যে সব মসজিদ কমিটি বা অন্য কোনো ওয়াকফ এ্যাস্টেটের পরিচালনা পর্ষদ ওয়াকফ সম্পর্কে কিছু জানেন না । জানলে পদক্ষেপ নিতেন। আর যাঁরা চাঁদা পরিশোধ করছেন না তাদের বিরুদ্ধে পিডিআর (Publice Demand Recovery Act 1913) এর নির্দেশিত বিধিতে ওয়াকফ বাংলাদেশ এর মামলা করার এখতিয়ার রয়েছে।’
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,‘যে সব কমিটি তাদের মসজিদের ওয়াকফ নিবন্ধন করেননি। তাঁদের উচিত স্ব-উদ্যোগেই নিবন্ধন করে নেয়া। মসজিদ, মাদ্রাসা ও এতিমখানাগুলো হলো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। প্রয়োজনীয় লোকবলের অভাবে ওয়াকফ সংস্থা মসজিদ কমিটির লোকজনকে খুঁজে বের করতে পারছে না। ওয়াকফ অধ্যাদেশ ৬১ (ক) ধারায় স্ব স্ব উদ্যোগেই তালিকাভূক্তির জন্যে আবেদন করতে হবে।
ওয়াকফ নিবন্ধনের সুবিধা সম্পর্কে তিনি বলেন,‘ মসজিদ বা অন্য যে কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ওয়াকফকৃত জমি বেদখল হলে মসজিদ কমিটি ১৯৬২ সালের ওয়াকফ অধ্যাদেশের ৬৪ (১) ধারা মতে আবেদন করলে জেলা প্রশাসনের সহায়তায় বেদখলকারীকে উচ্ছেদ করার ব্যবস্থা করে কমিটিকে বুঝিয়ে দেবে। এ ছাড়াও অদূরভবিষ্যতে জমিদাতার কোনো ওয়ারিশ ওয়াকফকৃত জমি দাবি করার সুযোগ থাকবে না।’
ওয়াকফের ধর্মীয় বিধান সম্পর্কে চাঁদপুর সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়লে কলেজ ইসলালিম স্টাডিজ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সহযোগী অধ্যাপক হাফেজ মো. রুহুল আমিন চাঁদপুর টাইমসকে জানিয়েছেন, ওয়াকফ করার অর্থ হলো ভূমি বা সম্পদ আল্লাহর ঘর মসজেদের জন্যে নিঃশর্তভাবে দান করা। যা আর কখনোই দানকারী কিংবা তার পরবর্তী প্রজন্মের কেউ ফিরিয়ে নিতে পারে না। একটি মসজিদের ভূমি যদি ওয়াকফ করা না থাকে তাহলে ভবিষ্যতে ওই মসজিদটির ভূমি বাণিজ্যিক কিংবা নানা কারণে দুনিয়াবী মূল্যবান সম্পদ হিসেবে দাঁড়ালে পরবর্তী প্রজন্মের কেউ এটি ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারে অথবা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে মসজিদ স্থাপনা ব্যবহার হতে পারে এ আশংকায় ওয়াকফ থাকা জরুরি। প্রচলিত আইনেও এ বিষয়টি এভাবেই উল্লেখ রয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মসজিদের ভূমি যদি ওয়াকফ করা না হয় তাহলে নামাজ হবে না।’ প্রচলতি এমন ধারণা ঠিক নয়। একজন মুসল্লি আল্লাহর জমিনের কোথায়ও নামাজ পড়তে গেলে যদি ওই জায়গার মালিক দাবি করে তাকে কেউ বাধা না দেয়, তাহলে তার নামাজ পড়তে অসুবিধা নেই। তবে জুমার মসজিদের ক্ষেত্রে ওয়াকফের বিষয়টি কিছুটা ভিন্ন। সেখানে কারো পারিবারিক জায়গা হলে ওই ভূমিতে মসজিদ নির্মাণ কিংবা মসজিদ থাকার বিষয়ে পরিবারের সবার সম্মতি থাকতে হবে। একক মালিকানা ব্যক্তির নিজের সম্মতিই যথেষ্ট। যৌথ মালিকানা থাকলে সবার সম্মতি ছাড়া নামাজ হবে না। এক্ষেত্রেই ওয়াফক করে নেয়া তথা ভূমির মালিক পরিবারের সকল সদস্যদের সম্মতি নেয়া প্রয়োজন।
ভূমি রেজিস্ট্রেকরণ ও ওয়াকফ এস্টেট সম্পর্কে তিনি বলেন, কোনো মসজিদের জায়গা ওয়াকফ হিসেবে রেজিস্ট্রি করতে গেলে ব্যয় তুলনামূলক অনেক কম। এছাড়া বছর বছর ভূমি বিভাগকে এরজন্যে অন্য সাধারণ ভূমির মতো ট্যাক্স দিতে হয় না। তবে বাংলাদেশ সরকার ওয়াকফ এস্টেটে নিবন্ধন সম্পর্কে মসজিদগুলো মোতাওয়াল্লি কিংবা কমিটির সদস্যদের কিছুটা অনীহা রয়েছে। কারণ এর নিয়ম কানুনগুলো আরো কিছুটা সহজ হওয়া প্রয়োজন। তবে যেসব মসজিদের দান ছাড়া কোনো আয়ের খাত নেই তাদের ওয়াকফ এস্টেটে সংযুক্ত থাকার প্রয়োজনীয়তাও কম।
আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করে দেখুন- চাঁদপুরে ৪ সহস্রাধিক মসজিদের ওয়াকফ নিবন্ধ নেই
অনুসন্ধানী প্রতিবেদক : আবদুল গনি
সম্পাদনায় : দেলোয়ার হোসাইন
জুলাই ৫ ২০১৯