বিশেষ সংবাদ

ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়া অন্তঃস্বত্ত্বা সেই ইউএনওর বিষয়ে সংসদে ক্ষোভ

অন্তঃস্বত্ত্বা এক ইউএনওকে ওসডি করার ঘটনায় জাতীয় সংসদে সোমবার ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এমপিরা। তারা বিষয়টি নিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তদন্তও দাবি করেছেন। এ ধরনের সিদ্ধান্ত বর্তমান নারী ক্ষমতায়নের যুগে একটি ভুল সিদ্ধান্ত বলেও মন্তব্য করেন তারা।

নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার নির্বাহী অফিসার হোসনে আরা বেগম বীণাকে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় ওএসডি (অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি) করা হয়। বিষয়টি নিয়ে তার এক আগেবঘন ফেসবুক স্ট্যাটাসের পর আলোচনা শুরু হয়। সোমাবার জাতীয় সংসদে অনির্ধারিত আলোচনায় অংশ নিয়ে সরকারি দলের সংসদ সদস্য এবং সাবেক মহিলা ও শিশু প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ পয়েন্ট অব অর্ডারে ফ্লোর নিয়ে ওএসডির করার প্রেক্ষাপট হিসেবে হোসনে আর বেগমের ফেসবুক স্ট্যাটাসের প্রসঙ্গটি তুলে ধরেন

তিনি বলেন, একজন ইউএনও অত্যন্ত বেদনাবিধুর স্ট্যাটাস দিয়েছেন। তিনি ৯ বছর পর মা হতে যাচ্ছিলেন। নির্বাচনের সময় তিনি সহকারী রিটার্নিং অফিসার হিসেবে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

এপ্রিল মাসে তার সন্তান জন্মগ্রহণের কথা ছিল। তিনি যখন ডাক্তারের কাছে গেলেন তখন জানতে পারলেন ওএসডি হয়েছেন। এই খবরটি শুনে মানসিকচাপে আকস্মিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তিনি সন্তান প্রসব করেন। সময়ের আগে সন্তানটি প্রসব করার কারণে শিশুটি আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে। ৯ বছর পর মা হওয়া এই নারীর মানসিক অবস্থা কী তা আমরা নিশ্চয়ই উপলব্ধি করতে পারছি।

মেহের আফরোজের প্রশ্ন, দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করা সত্ত্বেও সন্তান সম্ভবা অবস্থায় কেন তাকে ওএসডি করা হলো? তিনি বলেন, একজন অন্তঃসত্ত্বা নারীর সঙ্গে কেমন আচরণ করা উচিত সমাজ এখনও সেই বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারে না। এই সময় এমন আচরণ করা উচিত নয় যা সন্তান বা মায়ের ক্ষতির কারণ হতে পারে। মেহের আফেরোজ এই ঘটনার জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিভাগীয় তদন্ত করার দাবি জানান।

পরে একই বিষয়ে কথা বলেন নারায়নগঞ্জের সংসদ সদস্য শামীম ওসমান। তিনি ফ্লোর নিয়ে বলেন, তিনি আমার নির্বাচনী এলাকা সদর উপজেলার নির্বাহী অফিসার। তিনি সৎ কর্মঠ ও অত্যন্ত ভালো সরকারি কর্মকর্তা। কার নির্দেশে ওই কর্মকর্তাকে ওএসডি করা হয়েছে, প্রশ্ন রেখে শামীম ওসমান বলেন, এই ঘটনার প্রেক্ষাপটে খারাপ কিছু হলে আমি নিজেও নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না।

এ বিষয়ে জনপ্রশাসনমন্ত্রী পদক্ষেপ নেবেন বলে সংসদে সভাপতির দায়িত্বে থাকা ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বী মিয়া আশা প্রকাশ করেন।

প্রসঙ্গত, ‘আমার নিষ্পাপ সন্তানটার কী অপরাধ’ শিরোনামে নারায়ণগঞ্জ সদর ইউএনও হোসনে আরা বেগম বীনা। এতে তিনি লিখেছেন, ‘আমি ব্যক্তিগত বিষয়গুলো সাধারণত ফেসবুকে খুব একটা শেয়ার করি না। তবে আজ মনে হলো এখন চুপ করে থাকাটাও অন্যায়। তাই আজ আর না, আজ আমি বলবো… আমি হোসনে আরা বেগম, উপজেলা নির্বাহী অফিসার নারায়ণগঞ্জ সদর, মাত্র ৯ মাস পূর্বে আমি এ পদে যোগদান করি।

আমার দীর্ঘ ৯ বছরের দাম্পত্য জীবনে বহু চেষ্টা চিকিৎসার পরও আমরা কোনো সন্তান লাভ করতে পারিনি। কিন্তু পাঁচ মাস পূর্বে আমি জানতে পারি আমি দুই মাসের সন্তানসম্ভবা। এ ঘটনা আমার জীবনে সৃষ্টিকর্তার অপার রহমত ছাড়া আর কিছুই নয়, এ বিশ্বাস আমি প্রতিনিয়ত বুকে ধারণ করেছি। এ বিশ্বাস ও স্বপ্ন বুকে নিয়ে অনাগত সন্তানের আগমনের অপেক্ষায় দিন গুনছিলাম।

উল্লেখ্য আমি আমার বাবুকে পেটে নিয়েই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সহকারী রিটার্নিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে আমি নারায়ণগঞ্জ-৪ ও নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের আংশিক নির্বাচন অত্যন্ত সফলভাবে সম্পন্ন করি। একজন নারী কর্মকর্তা হিসেবে অজুহাত, ফাঁকিবাজী এই বিষয়গুলোকে কখনই পুঁজি করিনি। যখন যে পদে কাজ করেছি চেষ্টা করেছি শতভাগ নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে। সন্তানসম্ভবা হয়েও এর কোনো ব্যতিক্রম আমি করিনি।

অথচ আমি সন্তান সম্ভবা হয়েছি শোনার পর থেকেই একজন বিশেষ কর্মকর্তা, যার নাম বলতেও আমার রুচি হচ্ছে না, বিভিন্ন মহলে আমাকে অযোগ্য হিসেবে উপস্থাপন করে আমাকে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা থেকে বদলীর পায়তারা করেই চলেছিল। আমার সন্তান সম্ভবা হওয়াটাকেই সে বিভিন্ন মহলে আমার সবচেয়ে বড় অযোগ্যতা হিসেবে উপস্থাপন করেছে। অথচ এই সন্তান পেটে নিয়েই আমি অত্যন্ত সফলভাবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সহকারী রিটার্নিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। এতে আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক এপ্রিসিয়েশনও পেয়েছি।

আমার সন্তান প্রসবের সম্ভাব্য তারিখ ছিল এপ্রিলের ২০ তারিখ, তেমন মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই আমি ছিলাম। গত ৪ ফেব্রুয়ারি বিকেলে রেগুলার চেকআপ করতে আমি হাসব্যান্ডসহ স্কয়ার হাসপাতালে আসি। চেকআপ শেষে সন্ধ্যায় আমরা হাসপাতালে অপেক্ষা করছি পরবর্তী পরীক্ষার জন্য, এমন সময় আমার একজন ব্যাচমেট ফোন করে জানায় আমার সদাসয় কর্তৃপক্ষ আমাকে ওএসডি করেছে অর্থাৎ আমাকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ করেছে। আমার অপরাধ হলো আমি সন্তান সম্ভবা। আর তার চেয়েও বড় কারণ হলো সেই তথাকথিত ক্ষমতাধর কর্মকর্তার উপরের মহল কর্তৃক তদবির।

খবরটা শোনার পর আমি প্রচণ্ড মানসিক চাপ সহ্য করতে পারিনি। আমি অ্যাজমার রোগী। প্রচণ্ড মানসিকচাপে আমার ফুসফুসে ব্লাড সার্কুলেশন অস্বাভাবিকভাবে কমে যায়, ফলে আমার পেটের সন্তানের অক্সিজেন সাপ্লাই বন্ধ হয়ে যায় এবং হঠাৎ করেই আমার পেটের বাবু নড়াচড়া পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়।

তাৎক্ষণিক হাসপাতালে ভর্তি করা হলে ডক্টর সেদিন রাতেই সিজার করে বাবু বের করে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন। পরে আমার পরিবারের সবার সিদ্ধান্তে পরদিন সকালে আমার মাত্র ৩১ সপ্তাহ বয়সী প্রি-ম্যাচিউর বেবিকে সিজার করে বের করে ফেলা হয়। এখন সে স্কয়ার হাসপাতালের এনআইসিওতে বেঁচে থাকার জন্য প্রাণপণ যুদ্ধ করে যাচ্ছে।

আমার এই নিষ্পাপ সন্তানটার কী অপরাধ ছিল? নাকি মা হতে চাওয়াটাই আমার সবচেয়ে বড় অপরাধ ছিল আমি জানি না!!! তবে জানি একজন সব দেখেন তিনি আমার নিষ্পাপ মাসুম সন্তানের উপর এই জুলুমের বিচার করবেন। এই নিষ্ঠুর অমানবিকতার পৃথিবীতে কোনো কর্তা ব্যক্তিদের কাছে আমি এ অন্যায়ের বিচার চাই না, শুধু আমার সৃষ্টিকর্তাকে বলব তুমি এর বিচার করো!!! আর যারা আমাকে একটুও ভালোবাসেন আমার নিষ্পাপ সন্তানটার জন্য দোয়া করবেন। ও সুস্থ হয়ে গেলে কোনো কষ্টের কথাই আমার মনে থাকবে না।’

বার্তা কক্ষ
১১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

Share