সারাদেশ

১৫ আগষ্ট জাতীয় শোক দিবসে কাঙালী ভোজের ইতিকথা

আজ থেকে ৩২ বছর আগের কথা। দেশে তখন হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদের শাসন চলছে। ঐ সময় রাজনৈতিক ডামাডোলে দেশ প্রায়ই উত্তাল থাকতো। ঐ সময় জাতির পিতার প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশের এক অনন্য বহিঃপ্রকাশ হয়ে উঠে ‘বানিয়ারচর গ্রামে ’শোক দিবসে আয়োজিত এক কাঙালী ভোজ। জাতির জনকের জন্মস্থান হিসেবে গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় ।

এ গোপালগঞ্জের অন্তর্গত মুকসুদপুর উপজেলার আওতাধীন জলিরপাড় ইউনিয়নের বানিয়ারচর গ্রামের কয়েক সাধারণ মানুষ তিন দশক ধরে ১৫ আগষ্ট জাতির পিতার শাহাদত বার্ষিকি উপলক্ষে স্থানীয় উদ্যোগে শোক দিবসের অংশ হিসেবে কাঙালী ভোজের আয়োজন করে আসছে। তিন দশক আগে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা আজকের মত এতোটা স্বচ্ছল ছিল না।

গ্রামের বেশিরভাগ মানুষই তখন অস্বচ্ছল ছিল। অধিকাংশ মানুষ দিন-মজুরের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতো। সে অবস্থায় জাতীয় শোক দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয়। এ মানুষগুলোর অধিকাংশই একাডেমিক শিক্ষায় শিক্ষিত নন। কেউ কেউ হয়তো অনেক কষ্ট করে নিজের স্বাক্ষরটা করতে পারেন মাত্র।

উদ্যোগ গ্রহণের পাশাপাশি কোনো কিছু আয়োজনের মূলে থাকে আর্থিক সমর্থন। কিন্তু তিন দশক আগে এ সমর্থন পাওয়াটা ছিল অত্যন্ত কঠিন কাজ। তখন কোন পক্ষ থেকেই কোন রকম আর্থিক সহায়তা পাওয়া যেত না। কিন্তু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে জাতীয় শোক দিবস পালন করা হবে এবং গ্রামাঞ্চলে শোক দিবসের একটি বড় অংশ জুড়ে থাকে কাঙালী ভোজের আয়োজন অর্থ্যাৎ আর্থিক সহায়তা এখানে খুব বেশি প্রয়োজন।

বানিয়ারচর গ্রামের ঠিক মাঝামাঝি প্রধান সড়কের পাশে রয়েছে ছোট্ট একটি বাজার (বর্তমানে যার নাম নতুন বাজার)। এ বাজার প্রতি বছর ইজারা দেয়া হয়। প্রথম দিকে এ বাজারটি এতটা সুপরিসর ছিল না। তখন ইউনিয়ন পরিষদ থেকেই এটি ইজারা দেয়া হোত। বানিয়ারচর গ্রামের বাসিন্দা তুফান বিশ্বাস শুরু থেকে একটানা ১৫ বছর এ বাজারের ইজারা নিয়েছিলেন। এটা যেন ছিল ঐ সময় তার জন্য একচেটিয়া।

গ্রামের প্রাচীন ব্যাক্তিত্ব অনিল মণ্ডলের কাছ থেকে জানা যায় যে,তিন দশক আগে যখন বানিয়ারচর গ্রামের এ বাজারে জাতীয় শোক দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয় তখন তুফান বিশ্বাস তার ইজারাকৃত ঐ বাজারে আদায়কৃত পুরো এক মাসের সমূদয় অর্থ প্রায় ৩ হাজার টাকা তার (অনিল মণ্ডল) হাতে তুলে দেন। ঐ সময় অনিল মণ্ডল ছিলেন বানিয়ারচর হতে নির্বাচিত ইউপি সদস্য। শুরু হল ‘জাতীয় শোক দিবস’ পালনের প্রথম তহবিল গঠন। এভাবে তহবিল ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে এবং বর্তমানে এ তহবিল লক্ষাধিক টাকায় উন্নীত হয়েছে।

ঐতিহ্যগতভাবে প্রতিবছর বানিয়ারচর বাজারে ১৫ আগষ্ট জাতীয় শোক দিবস যথাযথ মর্যাদায় পালিত হয়। এ শোক দিবসে এলাকার হাজার হাজার মানুষ যোগদান করেন এবং কাঙালী-ভোজে অংশ নেন। তিন দশক ধরে যে সকল নিবেদিত প্রাণ জাতীয় শোক দিবস পালনের এ ঐতিহ্য নানা বাধাঁ-বিপত্তি অতিক্রম করে সম্মানজনকভাবে ধরে রেখেছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন: প্রয়াত প্রগতি হালদার,তুফান বিশ্বাস, অনিল মণ্ডল,প্রয়াত সুরেন বাইন,নীরু মণ্ডল,প্রয়াত বরেন্দ্র নাথ হীরা,অম্বরিশ বাড়ৈ,দিপক বাড়ৈ ও অধীর সাহাসহ বর্তমান প্রজন্মের প্রতিনিধি রকিম বৈরাগী,সমীর মণ্ডল,প্রণব হালদার,প্রদীপ হালদার,প্রেমানন্দ হালদার ও সঞ্জয় কির্তনীয়াসহ আরো অনেকে।

প্রতিবছর আগষ্ট মাস শুরু হলেই এ মানুষগুলোর ব্যস্ততা যেন অনেক বেড়ে যায়। ২০১৯ সালের জাতীয় শোক দিবস পালনের জন্য প্রথম বারের মত আনুষ্ঠানিকভাবে ১৭ সদস্য বিশিষ্ট একটি পরিচালনা কমিটি গঠন করা হয়। এ পরিচালনা কমিটিতে কৃতজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশস্বরূপ তুফান বিশ্বাসকে সভাপতি নির্বাচন করা হয় যার বয়স বর্তমানে প্রায় ৯০ বছর। কমিটিতে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আছেন অনিল মণ্ডল এবং কোষাধ্যক্ষ হিসেবে আছেন প্রদীপ হালদার।

এছাড়াও সহ-সভাপতি হিসেবে আছেন নীরু মণ্ডল,মনমথ বৈরাগী ও রকিম বেরাগী। এবারের জাতীয় শোক দিবস দল-মত নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে পালন করা হয়েছে যা খুবই সুখকর।।

রচনায় : নিকোলাস বিশ্বাস,ডিস্ট্রিক ফ্যাসিলেটর, গ্রাম আদালত বিভাগ,চাঁদপুর ।
সম্পাদনায় : আবদুল গনি
৩০ আগস্ট ২০১৯

Share