শিক্ষকতা একটা মহান পেশা। শিক্ষক হচ্ছেন মানুষ গড়ার কারিগর। তাদের হাত ধরেই মূলত: আমরা জ্ঞানের মহাসাগর পাড়ি দেই। শিক্ষার আলো মানুষের মনকে আলোকিত করে এবং মানুষের গুণাবলিকে বিকশিত করে। শিক্ষকরা তাদের জ্ঞান, মেধা, দূরদর্শিতা, ধৈর্যশীলতা ও সততার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তিলে তিলে গড়ে তোলেন। তারাই পারেন একটি জাতিকে গড়ে তুলে সমাজকে পাল্টে দিতে। মানসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন তথা জীবনের সব ক্ষেত্রে তাদের অবদান অনস্বীকার্য। শিক্ষকরা শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই শিক্ষা দেন তা কিন্তু নয়। তারা জীবনের সর্বক্ষেত্রে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেন।
স্বাধীনতার ৪৭ বছর পেরিয়ে গেলেও এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীর ভাগ্যোন্নয়ন ঘটেনি। দুঃখ-দুর্দশা, সীমাহীন বৈষম্য প্রতিনিয়ত শিক্ষক-কর্মচারীদেরকে ক্ষত বিক্ষত করে তুলেছে। জনগণ তথা জাতির আশা আকাংখা ও প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটিয়ে তৈরি করা হয়েছে- জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০।
শিক্ষানীতি বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের সুবিধাবঞ্চিত করে রাখা হয়েছে। অনেকেরই অজানা যে, ৮ বছর পূর্তিতে বেসরকারি কলেজের একজন শিক্ষক সহকারী অধ্যাপক হতে না পারলে তাকে একটি টাইম-স্কেল দিয়ে সপ্তম গ্রেডে বেতন দেয়া হতো। বেসরকারি কলেজে আত্মঘাতী রেশিও প্রথার কারণে সেটি ভোগ করতে হতো দেশের ৮০ % বেসরকারি কলেজ শিক্ষকদের। দুঃখের বিষয় হলো, বেশিরভাগ বেসরকারি শিক্ষকদের প্রভাষক হিসেবেই অবসরে যেতে হয় এখনো; তখন সারা জীবনের একটি টাইম-স্কেলই ছিল তাদের শেষ ভরসা।
শিক্ষক-কর্মচারীদের নেই বার্ষিক প্রবৃদ্ধি, পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা, বৈশাখি ভাতা, পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা ভাতা, পূর্ণাঙ্গ বাড়ি ভাড়া। অথচ বেসরকারি শিক্ষকগণ দেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে শতকরা ৯৭ % শিক্ষার্থীদের পাঠদান করে থাকেন। শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার ও জাতীয় উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি।
শিক্ষার গুণগত উন্নয়ন ব্যতিরেকে জাতীয় উন্নয়ন সম্ভব নয়। দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের প্রধান মাপকাঠি হচ্ছে শিক্ষা। শিক্ষার অধিকার পরিপূর্ণভাবে অর্জিত হলে জনসাধারণের অন্যান্য অধিকার আদায়ের পথ সুগম হবে। অথচ স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরও আমাদের সংবিধানে শিক্ষা মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত পায়নি। কারণ শিক্ষা খাতে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বরাদ্দ হলো জিডিপির ৬ % এবং বাজেটের কমপক্ষে ২০ %। কিন্তু বাংলাদেশে এ বরাদ্দ জিডিপির ২.২ % এবং বাজেটের ১৫ % আশপাশেই ওঠানামা করছে।
বিভিন্ন দেশের জিডিপিতে শিক্ষা খাতের অনুপাত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ১শ’৬১টি দেশের মধ্যে শিক্ষা খাতে বরাদ্দের দিক থেকে বাংলাদেশ ১শ’৫৫তম। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান যুদ্ধতাড়িত আফগানিস্তান ও ইরাক থেকেও অনেক কম। আইনগত অধিকার না থাকায় বেসরকারি শিক্ষকরা তাদের ন্যায্য প্রাপ্য বার্ষিক ৫% ইনক্রিমেন্ট, পূর্ণাঙ্গ বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ভাতা, সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মতো পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা, বৈশাখী ভাতা, শিক্ষা ভাতা, পাহাড়িয়া অঞ্চলে চাকরিরত শিক্ষকদের জন্য পাহাড়ি ভাতাসহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে। এটি একেবারেই অনভিপ্রেত।
বেসরকারি শিক্ষকদের অধিকার নিশ্চত করতে সরকারি উদ্যোগ এবং পর্যাপ্ত সমর্থন না থাকায় তারা সর্বদাই বঞ্চিত হয়। দেশে সর্বক্ষেত্রে অভাবনীয় পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা ব্যবস্থায় বৈষম্য এখনো দূর হয়নি, যা বর্তমান সময়ের সবচেয়ে অপরিহার্য দাবি।
১৯৯৫ সাল থেকে প্রতি বছর ৫ অক্টোবর তারিখ বিশ্বব্যাপি পালিত হয়ে আসছে বিশ্ব শিক্ষক দিবস। বিশ্ব শিক্ষক দিবস শিক্ষা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ পালন করা হয়। আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ৯৭% বেসরকারি ধারায় পরিচালিত।
আর এখানে নিযুক্ত আছেন প্রায় ৫ লাখের অধিক শিক্ষক ও কর্মচারী। তবে সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে বেতনভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধায় বিস্তর বৈষম্য রেখে শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন যেমন সম্ভব নয়, তেমনি শিক্ষকদের বঞ্চিত রেখে শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নও অসম্ভব।
দেশের সিংহভাগ শিক্ষার্থীর শিক্ষাদান করেও বেসরকারি শিক্ষকরা সরকারি শিক্ষকের মতো আর্থিক সুযোগ-সুবিধা পান না। তারা সরকার থেকে শতভাগ মূল বেতন এবং দু’ ঈদে ২৫% উৎসব ভাতা পান। এছাড়াও তারা ৫ শ’ টাকা বাড়ি ভাড়া এবং ১শ ৫০ টাকা চিকিৎসা ভাতা পান। ৫শ’ টাকা বাড়ি ভাড়া এবং ১শ’ ৫০ টাকা চিকিৎসা ভাতা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক এবং হাস্যকর। ৫শ’ টাকা বাড়ি ভাড়া এবং ১শ ৫০ টাকায় চিকিৎসার যুগ অনেক আগেই গত হয়ে গেছে। বর্তমানে শহরে বা গ্রামে কোথাও ৫ শ’ টাকায় বাড়ি ভাড়া পাওয়া যায় না। ৭/৮ শ’ টাকা যেখানে ডাক্তারের ভিজিট, সেখানে ১ শ’ ৫০ টাকায় চিকিৎসার কথা কল্পনাও করা যায় না।
সরকার বেসরকারি শিক্ষকদের যে সামান্য অবসর ভাতা দেন, তাও তারা অবসর গ্রহণের চার-পাঁচ বছর পরও পান না। তাই অনেক শিক্ষক অবসর ভাতা পাওয়ার আগেই মৃত্যুবরণ করেন। ব্যাপারটি সত্যিই দুঃখজনক।
বেসরকারি শিক্ষকদের দাবি-দাওয়ার কথা উঠলেই সরকার আর্থিক সীমাবদ্ধতার কথা বলে দাবি-দাওয়াগুলোকে পাশ কাটিয়ে যান। কিন্তু সরকারের এ যুক্তিটি মানা যায় না। কারণ বর্তমানে আমাদের দেশ আর্থিক দিক দিয়ে অনেক উন্নতি করেছে। আমাদের দেশ বর্তমানে নিম্ন মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। সুতরাং এখন বেসরকারি শিক্ষকদের দাবি মানতে সরকারের আর্থিক সমস্যার কোনো কারণ নেই-কেবল সরকারের সদিচ্ছার অভাব। এখন সরকার ইচ্ছা করলেই বেসরকারি শিক্ষকদের চাকরি জাতীয়করণ করতে পারেন।
শিক্ষার উন্নয়ন করতে হলে সরকারি এবং বেসরকারি শিক্ষকদের মধ্যে বিরাজমান বৈষম্য দূর করে সব শিক্ষককে সমান আর্থিক সুবিধা দিতে হবে। দেশের সিংহভাগ ছাত্র-ছাত্রীর শিক্ষাদানকারী বেসরকারি শিক্ষকদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে শিক্ষার উন্নয়ন আশা করা যায় না।
চাকরি জাতীয়করণ করা বেসরকারি শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের দাবি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বেসরকারি শিক্ষকদের এই যৌক্তিক দাবিটি দীর্ঘদিন যাবৎ উপেক্ষিত হয়ে আসছে। বেসরকারি শিক্ষকরা বছরের পর বছর ধরে তাদের চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে আন্দোলন করে আসছেন কিন্তু কোনো সরকারই তাদের এই দীর্ঘদিনের ন্যায্য দাবিটি মানছে না। বেসরকারি শিক্ষকরা যখন তাদের ন্যায্য দাবি-দাওয়া নিয়ে রাজপথে আন্দোলন করেন, তখন সরকার নানা প্রশ্রিুতি দিয়ে তাদেরকে আন্দোলন থেকে ফিরিয়ে আনেন।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত সরকার তাদের প্রতিশ্রুতিগুলো আর বাস্তবায়ন করেন না। এভাবে বেসরকারি শিক্ষকরা বারবার প্রতারিত হয়ে আসছেন। তাই বেসরকারি শিক্ষকরা এবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকে তাকিয়ে আছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেসরকারি শিক্ষকদের প্রতি একটুখানি সুনজর দিলেই বেসরকারি শিক্ষকদের চাকরি জাতীয়করণসহ তাদের সব দাবি-দাওয়া বাস্তবায়িত হবে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার হচ্ছে শিক্ষাবান্ধন। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে নিতে সরকারের যে প্রচেষ্টা একেবারে নেই তাও কিন্তু বলা যাবে না। আমরা ইতোমধ্যে দেখেছি । প্রতি উপজেলায় একটি করে স্কুল-কলেজ জাতীয়করণ করা হয়েছে।
বিষয়টিকে আমরা খুবই ইতিবাচক বলে মনে করি। তবে প্রশ্ন হলো শুধু প্রত্যেক উপজেলায় একটি করে কেন অথবা মন্ত্রী-এমপিদের বিশেষ প্রতিষ্ঠান কেন? দেশের এমপিওভুক্ত ও উপযুক্ত সব বেসরকারি স্কুল কলেজকে জাতীয়করণ করা হোক। আমাদের মনে হচ্ছে এর শুভ সূচনা প্রধানমন্ত্রী সম্পন্ন করে রেখেছেন। তিনি পথ দেখিয়ে দিয়েছেন, নিশ্চয়ই এ পথে আবারো হাঁটবেন।
এ দেশে স্বাধীনতার পর প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান; সেহেতু জাতির জনকের অসমাপ্ত কাজ বেসরকারি স্কুল-কলেজ জাতীয়করণ এটিও প্রধানন্ত্রীকেই করতে হবে। তবে জাতির জনকের সুযোগ্য কন্যা দেশনেত্রী শেখ হাসিনার ওপর শিক্ষকদের আস্থা বেড়েছে বৈ কমেনি। একটি জাতির আস্থা ও প্রত্যাশার শেষ জায়গা প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঠিক সিদ্ধান্তই পারে এ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে যুগপৎ পাল্টে দিতে এবং তা ঘটছেও বলতে দ্বিধা করি না। তবে শিক্ষাক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তনের প্রচেষ্টা আরো গতিশীল করা দরকার।
দেশের ৯৭ % বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের সরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের চেয়ে কম সুযোগ-সুবিধা দিয়ে দেশের কাক্সিক্ষত শিক্ষার অগ্রযাত্রা সম্ভব নয়। তাই বেসরকারি শিক্ষকদের মূল বেতন স্কেলের সঙ্গে ৫ % বেতন প্রতি বছর বাড়ানো হোক। কারণ যেহেতু এটা একটা স্থায়ী বেতন কাঠামো এবং বেসরকারি কলেজের শিক্ষকরা সারা জীবনে যে একটি টাইম-স্কেল পেতেন সেটি বহাল রাখার জন্য আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে জোর দাবি জানাই।
দ্বিতীয়ত, সম্মানজনক বাড়ি ভাড়া ও চিকিৎসা ভাতার ব্যবস্থা করা হোক। বিভাগীয় পরীক্ষার মাধ্যমে পদোন্নতির ব্যবস্থা করা হলে বেসরকারি চাকরিতেও মেধাবীরা আসবে এবং সরকারি-বেসরকারি বৈষম্য দূর হতে থাকবে, শিক্ষার অগ্রযাত্রাকে কেউ আর থামিয়ে রাখতে পারবে না।
প্রসঙ্গত, সরকারের ভিশন-২০২১ বাস্তবায়ন ও ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে হলে শিক্ষক সমাজের ন্যায্য পাওনা সুনিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশকে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে হলে দেশে জ্ঞান-বিজ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তি ও ভাষাগতভাবে দক্ষ মানব সম্পদ সৃষ্টি করতে হবে। এ গুরুত্বপূর্ণ কাজটি বাস্তবায়িত করবেন মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকেরা। ৫ লাখ বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষকদেরকে জাতীয়করণ করা ব্যতীত সরকারের এ মহৎ উদ্দেশ্য সফল হবে না। বেসরকারি শিক্ষকদের উপরোক্ত যৌক্তিক দাবিগুলো বর্তমান সরকার পূরণ না করলে তারা মানসিকভাবে ভেঙে পড়বে, রাষ্ট্র এবং সমাজে সব পেশার মানুষের নিকট হেয় প্রতিপন্ন হবে, তার ফলস্বরূপ তারা ক্লাসে ঠিকমতো মনোযোগ দিয়ে পাঠদান করতে পারবে না। এ কথাটি মনে রেখেই শিক্ষকদের মূল্যায়ন ভীষণ জরুরি।
কলাম লেখক : রায়হান আহমেদ তপাদার
৯ অক্টোবর,২০১৮ মঙ্গলবার
এজি