হাইমচর

হাইমচরের ঈশানবালার চরে শিক্ষকদের বার্ষিক আনন্দ ভ্রমণ

চাঁদপুর জেলার‘মাধ্যমিক সহকারী শিক্ষক সমিতি’র উদ্যোগে আয়োজিত শীর্ষ নেতৃবৃন্দসহ একঝাঁক তরুণ শিক্ষক শুক্রবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) সকাল ৯ টায় চাঁদপুর প্রেসক্লাব সংলগ্ন ডাকাতিয়া নদীরতীর থেকে একটি দ্রুতগামী ইঞ্জিনবাহী ট্রলারযোগে হাইমচরের ঈশানবালারচরের ‘চরগাজীপুর মনিপুর’র উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু।

হাইমচরের ঈশানবালার চরগাজীপুর মনিপুর’চরটি হাইমচর উপজেলা কমপ্লেক্স থেকে প্রায় মেঘনানদীর ১২ কি.মি পশ্চিমতীরে, চাঁদপুর নৌ-মোহনার মোলহেড থেকে প্রায় ২০ কি.মি দক্ষিণে ও হরিণা-ফেরি ঘাট থেকে প্রায় ৮ কি.মি দক্ষিণ পশ্চিম-দক্ষিণ কোণে অবস্থিত। এ এলাকাটি একটি নদী ভাঙ্গনগ্রস্থ এলাকা হলেও বর্তমান অধিবাসীরা ধীরে ধীরে আবার বসতবাড়ি গড়ে তুলছে।

স্থানটি নির্ধারণ করার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য মহৎ ও চমৎকার বলে মনেকরি। কেননা ‘আলোর নিচেই যে অন্ধকার’ বিদ্যমান তা’স্বচক্ষে অবলোকন করার জন্যেই আমার প্রিয় সংগঠনের বন্ধুবর শিক্ষকদের নিয়ে আসা হলো। এ স্থানটিই আমার (প্রতিবেদক) মাতৃ ও পিতৃকূলের পূর্ব পুরষদের ভিটা বাড়ি ছিল আজ থেকে প্রায় ৮০-৮৫ বছর আগে। এক সময়-এদের ‘গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু আর পুকুর ভরা মাছ ছিল।’এখন নেই তাদের কিছুই ;তারাও নেই পৃথিবীতে। নদীভাঙ্গনে তাদের সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। লন্ডভন্ড হয়ে গেছে তাদের জীবন ব্যবস্থা। তাই এখন সবই ধূসর স্মৃতি।

যতদূর জানা গেছে,এ চরটি ১৯৫০-১৯৫১ সালে প্রথম নদী ভাঙ্গনে আক্রান্ত হয়। এর পর বেশ ক’বার এ চরটি শিকস্থী-পয়স্থী হয়। এখানকার অধিবাসীরা শতভাগই মুসলমান ও হাজী শরিয়ত উল্যাহ’র অনুসারী। এখানে প্রায় ২ শ’ বাড়িঘর, দু’টি আশ্রয়ণ প্রকল্প, দ’ুটি মসজিদ,একটি মাছঘাট ও একটি কবরস্থান রয়েছে। অধিবাসী নারী-পুরুষ সবাই অত্যন্ত পরিশ্রমী ও জীবন সংগ্রামী। বেঁচে থাকতে ও স্বাছন্দ্যময় জীবনের প্রত্যাশায় স্বামীদের পাশে স্ত্রী ও স্ত্রীদের পাশে স্বামীরা দিনরাত খাটুনি খাটে যাচ্ছে। প্রতিটি দিনই তাদের সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে হয়। বৈড়ি আবহাওয়ায় তাদের দৈনন্দিন জীবনের ছন্দ পাল্টে যায়।

কৃষি পণ্য উৎপাদন , গবাদি পশু ও হাঁস মুরগি প্রতিপালন,শাক-সবজি উৎপাদন ও মৎস্য শিকার করা তাদের জীবনধারণের প্রধান উপায়। ধান, মসুরি , সোয়াবিন, সরিষা, মাসকলাই প্রভৃতি এখানে উৎপন্ন্ হয়। স্থানীয় অধিবাসীরা প্রথমে জঙ্গল , আগাছা ও হোগলা পাতা পরিস্কার করে চাষাবাদকৃত জমি তৈরি করে। এক সময় লাঙ্গল-বলদ দিয়ে জমি চাষাবাদ করত। আর এখন মহয়সী নারী সুফিয়া কামালের কবিতায় সেই ‘কলের লাঙ্গল।’

শাক-সবজি উৎপাদনের মধ্যে করলা, লাউ, সীম ও মিষ্টি কুমড়া, টমেটো, মটর, ধনিয়া, কালিজিরা, কাঁচকলা এবং ফলমূলের মধ্যে রয়েছে কলা, আম, নারকেল ও কুল। নিজদের পালিত গাভীর দুধ তাদের অন্যতম খাবার। এখানকার কৃষি পণ্য কৃষকরা চাঁদপুর , হাইমচর ও শরিয়তপুরের ডামুড্যা, কাটপট্টি, ভেদেরগঞ্জ, ডিএমখালি, মালতের বাজার, সখিপুর, ফতেজংগপুর বাজার, মোল্লার বাজার,ঈশানবালা ও বালার বাজার নামের বিভিন্ন হাট বাজারে বিক্রি করেন ও তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র হাটবারের দিনই কিনে আনেন। এদের প্রধান বাহন দ্রুতগামী ইঞ্জিনবাহী ট্রলার বা বোট।

এছাড়াও গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগি তারা পাশ্ববর্তী হাট বাজরে বিক্রি করেন। এখানে কোনো ডাক্তার তো দূরের কথা ঔষধ বিক্রির ফার্মেসিও নেই। স্কুলগামী ছেলে-মেয়েরা এখান থেকে ঈশানবালায় ও হাইমচরে নিকটতম আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে বিশেষ ব্যবস্থায় লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ‘গাজীপুর’ ইউনিয়ের পাশ্ববর্তী একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যায়। মসজিদে ছোট ছোট শিশুদের মক্তবে পড়ার ব্যবস্থা রয়েছে।এখানকার জনপ্রতিনিধিরা কেউ এলাকায় থাকে না। প্রয়োজনে তারা স্ব-শরীরে অথবা মোবাইল ফোনে জরুরি বিষয় সেরে নেন।

অসুস্থ হলে চাঁদপুর সদর হাসপাতালে কিংবা হাইমচর উপজেলা কমপ্লেক্স ইঞ্জিনবাহী ট্রলার দিয়ে মেঘ-বৃষ্টি-ঝড় উপেক্ষা করে মেঘনা পাড়ি নিয়ে যেতে হয়। তবে নির্বাচন এলে তাদের কদর বেড়ে যায়। প্রতিদিন দু’তিনটি ইঞ্জিনবাহী ট্রলারে জীবন বাজি রেখে মেঘনা উত্তাল ঢেউ অতিক্রম করে হাইমচর থেকে ঈশানবালা হয়ে বালারবাজার পর্যন্ত আসা যাওয়া করতে পারে। নির্দিষ্ট সময় ছাড়া এ চরে আসা যাওয়া সম্ভব নয়।

ফসলের মৌসুমে ও বর্ষায় ইলিশ মৌসুমে তাদের মুখে কিছ’টা হাসি ফুটে উঠে। ফাল্গুন, চৈত্র ও বৈশাখ-এ তিন মাস এদের জীবনধারণ খুবই কঠিন। শীতকালে হিমেল হাওয়ায় তারা জড়োসড়ো হয়ে পড়ে। অধিবাসীদের সকল সামাজিক কর্মকান্ড ইসলামিক শরীয়া অনুযায়ী সম্পন্ন হয়। এখানে কোনো হিন্দু পরিবার নেই। চরবাসীদের জীবন ধারণ,শিক্ষা, যাতায়াত,স্বাস্থ্য প্রভূতি বিষয়ে জানার জন্যেই একদিনের আনন্দ ভ্রমণে আসার জন্য শিক্ষক সংগঠনের সভায় প্রস্তাব পাস করা হয় ।

প্রতিবেদক : আবদুল গনি , সহ-সভাপতি,মাধ্যমিক সহকারী শিক্ষক সমিতি,চাঁদপুর ১৫ ফেব্রুয়ারি,২০১৯। ফোন : ০১৭১৮-২২১০৪৪।

Share