টানা ৫ দিন ট্রলার ধরে ভেসে বেঁচে ফিরলেন দু’জন : লাশ হয়ে এলো ৮ জন

সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের তাণ্ডবে জেলেদের দু’টি ট্রলার ডুবে ২৯ জন নিখোঁজ হয়। নিখোঁজ হওয়ার পাঁচ দিন পর বৃহস্পতিবার (১১ জুলাই) একই ট্রলারের মাঝি মনির (৩৫) ও ট্রলার মালিকের ছেলে জুয়েলকে (৩৪) জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে উপকূল থেকে।

তবে একই নৌকার আট আরোহীর মরদেহ কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের পৃথক পৃথক স্থান থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। শুক্রবার চরফ্যাশনে জীবিত ফিরে আসা দু’জনের পরিবারে যখন আনন্দ উৎসব চলছিল, বাকিদের ঘরে ছিল শোকের মাতম। গ্রামের মানুষ এক নজর দেখার জন্য ছুটে আসেন।

জেলেপল্লীতে ভাসছিল মা-বাবা, স্ত্রী ও সন্তান ও স্বজনদের কান্না আর আহাজারি। জীবিত দু’জনের মধ্যে মনির মাঝি সুস্থ আছেন, তবে জুয়েল এখনো অনেক দুর্বল বোধ করছেন।

নিখোঁজ জেলেদের মধ্যে যে আটজনের মরদেহ ভেসে এসেছে তারা হলেন চর মাদ্রাজ ইউনিয়নের নাজিমউদ্দিন গ্রামের তরিকুল ইসলামের ছেলে কামাল হোসেন ও জিন্নাগড় ইউনিয়নের নুর মোহাম্মদের ছেলে অলিউদ্দিন (৪০), বজলু হাওলাদারের ছেলে অজিউল্যাহ (৩০) ও আ. হকের ছেলে মাকসুদ (৩০) ও রিয়াদ (২৫), শশীভূষণ থানার মো. বাবুল, তসির ওরপে সেলিম ও মোছলেউদ্দিন।

এখনো কক্সবাজার থানায় রয়েছে মোছলেউদ্দিন ও তসির ওরপে সেলিমের মরদেহ। বাকিদের মরদেহ স্বজনরা বুঝে নিয়েছেন। এখনো যারা নিখোঁজ রয়েছেন, তাদের স্বজনরা আশায়-শঙ্কায় প্রহর গুনছেন।

বেঁচে আসা মনির মাঝি ভেসে থাকার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ৪ জুলাই চরফ্যাশন উপজেলার সামরাজ মৎস্যঘাট থেকে মাছ ধরার উদ্দেশ্যে ১৭ জন মাঝি-মাল্লা সাগরে যান। ভালো ইলিশও জালে উঠছিল।

মনির মাঝি বলেন, ৬ জুলাই ভোরে হঠাৎ ঝড়ো হাওয়া ও উত্তাল ঢেউয়ের কবলে পড়ে আমাদের ট্রলারসহ একাধিক ট্রলার উল্টে যায়। এরপর কে কোথায় হারিয়ে গেছে জানি না। এ কথা বলে তিনি কেঁদে ওঠেন।

একটু পর আবার বলেন, আমি আর জুয়েল ট্রলার ধরে রাখি। সাগরের ঢেউয়ের ধাক্কায় একবার ট্রলার থেকে ছিটকে পড়ি তারপরও আবার ধরে থাকার চেষ্টা করি। এভাবে তিন দিন ট্রলার ধরে বাঁচার চেষ্টা করি। বুকে খুব একটা সাহস রেখে দু’জন বাঁচার চেষ্টা করি। কিন্তু বাঁচার জন্য সহযোগী হিসাবে ওই মুহূর্তে কাউকে পাইনি। তিনদিন পরও নদীর কোনো কূল-কিনারা দেখিনি। হঠাৎ আবার উত্তাল ঢেউয়ের ধাক্কায় ট্রলার থেকে ছিটকে অনেক দূরে চলে যাই। সাগরের তীরে বাতি বা গাছের ছায়া দেখে বাঁচার আত্মবিশ্বাস জন্মে।

এরই মধ্যে জুয়েলকে হারিয়ে ফেলি। কিনারায় পৌঁছাতে পারলেও নিজের শক্তিতে ওঠা সম্ভব হয়নি। স্থানীয় লোকজনসহ প্রশাসন আমাদেরকে দেখে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়।

আহমেদপুর ইউনিয়নের ফরিবাদ গ্রামের নিখোঁজ জেলে রবিউলের (১৮) বাবা শাহে আলম ও মা রেবু বেগম জানান, তাদের চার সন্তানের মধ্যে ছোট ছেলে রবিউল। গত শুক্রবার স্থানীয় শাজাহান মাঝির ট্রলারে করে সাগরে মাছ শিকার করতে বাড়ি থেকে বের হয়। শনিবার সকালে তারা জানতে পারেন শাজাহান মাঝির ট্রলারটি সাগরে ডুবে গেছে। এখনো ছেলের খবর তারা পাননি।

একই গ্রামের নিখোঁজ জেলে আব্দুল হাই (৩৫) এর স্ত্রী কুলসুম বলেন, আমার স্বামী অন্য কোনো কাজ জানে না। মাছ শিকার করে আমাদের সংসার চলে। শাজাহান মাঝির সাথে সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে এখনো সে ফিরে আসে নাই। আমার এক ছেলে, এক মেয়ে স্কুলে পড়ে। স্বামী বেঁচে না ফিরলে আমি তাদের কীভাবে পড়াশুনা করাবো। সংসার কীভাবে চলবে। কে আমাকে দেখবে?

কুলসুম আরো জানান, তিনি এখন ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা। এ সন্তান নিয়ে আমি কী করবো। আমার স্বামীকে আপনারা এনে দেন।

একই গ্রামের মুন্সি বাড়ির নিখোঁজ জেলে জসিমের (২০) বাবা মো. মনির হোসেন বলেন, জসিম আমার একমাত্র ছেলে। দুই মাস আগে তাকে বিয়া করাইয়াছি। সাগরে মাছ শিকার করতে গিয়ে এখন আমার ছেলে নিখোঁজ রয়েছে। জসিমের মা ও স্ত্রী নাজমার দিকে তাকাতে পারি না। আমি গরিব, তাই মাছ শিকার করে জীবন চলে।

তিনি আরো বলেন, যদি ট্রলার ডুবিতে আমার ছেলের মৃত্যু হয়ে থাকে, তার লাশটা আমাকে এনে দেন। আমি ওর লাশ নিজের হাতে ওর দাদার কবরের পাশে দাফন করব।

নিখোঁজ জেলে নাছির (৪৫) এর স্ত্রী নূরজাহান বলেন, স্বামীর রোজগার দিয়ে চার সন্তান নিয়ে কোনো রকমে সংসার চলতো। সমিতির ঋণ আছে। এখন আমার সংসার কে চালাবে। কে আমার সন্তানদের দেখবে? এই বলে কান্নায় তিনিও জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।

চরফ্যাশন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সামসুল আরেফীন বলেন, কক্সবাজার সদর থানা প্রশাসনের সাথে সার্বিক খোঁজ-খবর নিয়ে জীবিত দু’জন ও মৃতদের লাশ চরফ্যাশনের বাড়িতে পৌঁছাতে আমরা নিরলসভাবে কাজে করে গেছি।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রুহুল আমিন বলেন, এখন থেকে নদীতে বা সাগরে যেতে হলে সর্তকতার সাথে লাইফ বয়া সঙ্গে নিতে যেতে হবে।

বাার্তা কক্ষ
১২ জুলাই ২০১৯

Share