‘স্যার, কোলা ব্যাঙের মতো চার হাতপা দেয়ালের সাথে লাগায়ে ঝুলতেছে শয়তানটা, মনে হয় জান শ্যাষ।’
বডিগার্ডের মুখে কথাটা শুনে একটা ধাক্কা খেলেন চাঁদপুর জেলার কচুয়া সার্কেল এএসপি শেখ রাসেল। সত্যি সত্যি লোকটা মারা গেলে তো ঝামেলার অন্ত থাকবে না। কেন যে আজ অভিযানে বেরিয়েছিল তিনি। এখন নিজের চুল নিজেরই ছিঁড়তে মন চাচ্ছে তাঁর।
কী, কৌতুহল হচ্ছে? কী ঘটেছিল জানতে চান? তাহলে মনোযোগ দিয়ে শুনুন পুরো ব্যাপারটা।
গত বৃহস্পতিবার (৯ মে) রাত সাড়ে নয়টার দিকে খবর এল যে, শাহরাস্তি থানার তালিকাভুক্ত ২নং মাদক ব্যবসায়ী কুখ্যাত সিস্টেম খোকন সঙ্গীদের সাথে নিয়ে নেশা করছে। তাড়াতাড়ি গেলে ধরা যাবে। তাছাড়া সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাবে। কেননা সে অত্যন্ত ধুরন্ধর আর হিংস্র প্রকৃতির।
শোনা যায়, সব সময় সাথে অস্ত্র বহন করে সে। সে যাই হোক, এমন সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইলেন না শেখ রাসেল। পুলিশ সুপারের অনুমতি নিয়ে অভিযানে বের হলেন তিনি। সাথে নিলেন তার অফিসের বিশ্বস্ত তিনজনকে। যাতে কেউ টের না পায় সেজন্য গাড়ি না নিয়ে সিএনজি চালিত অটোরিক্সা নিলেন তিনি। পথে তার সাথে যোগ দিলেন থানার আরও তিনজন ইউনিফর্ম পুলিশ।
বাগান বাড়ির কাছে যেতেই গা ছম ছম করতে লাগলো। অনেকটা পোড়ো ভুতের বাড়ির মতো। সাপ বিচ্ছুর তোয়াক্কা না করে খুব সন্তর্পনে ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে গিয়ে ঘিরে ফেললেন পুরো বিল্ডিং। কিন্তু, ঢোকার সিঁড়ির কাছে গিয়ে আটকে গেলেন। ভেতর থেকে লক করা। কিন্তু, দমে যাওয়ার পাত্র নন রাসেল। তিনি বডিগার্ড হাসানকে দেওয়াল দিয়ে তুলে দিলেন দোতলায়। উঠতে গিয়ে হাত পা ছিলে গেল ছেলেটার। কিন্তু, ওপরে উঠে দেখা গেল কেউ নেই।
এবার বডিগার্ড হাসান খুলে দিল ওপরে ওঠার দরজা। সবাই মিলে তড়িঘড়ি করে দোতলায় উঠে দেখলেন একদম নিশ্চুপ পরিবেশ। কিন্তু সদ্য জ্বলা সিগারেটের মাথা আর রাংতা কাগজ দেখে সহজেই বোঝা যাচ্ছে কেউ এইমাত্র সটকে পড়েছে। রাসেল বললেন, ‘হাল ছেড়োনা, খুঁজতে থাকো। পাবোই।’ সবাই আবার সার্চ শুরু করল। নাহ! কেউ নেই। তবে সব গেলো কোথায়?
হঠাৎ বিল্ডিংয়ের পেছনে কিসের যেন খস খস আওয়াজ পাওয়া গেল। সবাই দৌড়ে গেল সেখানে। গিয়ে যা দেখলো তাতে চোখ কপালে উঠে গেল। একটা দাঁড়িওয়ালা মাঝবয়সী লোক দুই বিল্ডিংয়ের দেয়ালের ফাঁকে আটকে গিয়ে টিকটিকির মতো ঝুলছে। এ দৃশ্য দেখে ঘাবড়ে গেলেন রাসেল। মাথা আর কাজ করছিল না। তাই ফোন দিলেন মাননীয় এসপি জিহাদুল কবির বিপিএম পিপিএম স্যারকে।
তিনি বললেন -‘ ভয় পেও না, আমি তো সাথে আছি। তুমি লোকটাকে উদ্ধারের চেষ্টা করো। প্রয়োজনে ফায়ার সার্ভিসকে খবর দাও।’ ঠিক সে মোতাবেক খবর দেওয়া হলো সবাইকে।
ইতোমধ্যেই শহরাস্তি আর হাজীগঞ্জ থানার ওসি সাহেব খবর পেয়ে ছুটে এসেছেন ঘটনাস্থলে। মুহূর্তেই লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল। মিডিয়া কর্মীরা চলে এলেন। দুই থানার ফায়ার সার্ভিসের লোক এসে উদ্ধারের চেষ্টা করলেন। কিন্তু কাজ হলো না। এদিকে আটকে পড়া লোকটি প্রচণ্ড গরম আর ঝুলে থেকে থেকে নিস্তেজ হয়ে যেতে লাগলো। অবশেষে বুদ্ধি করে ফ্যানের ব্যবস্থা করা হলো। ওপর থেকে স্যালাইন গুলিয়ে মুখে ঢেলে দেওয়া হলো। এভাবে টানা তিন ঘণ্টার শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানের পর দেয়াল ভেঙে বের করা হলো তাকে।
ও মা! তাকে দেখে সবাই খুশি হবে কি, তারচেয়ে ছিছি করতে লাগল। একজন তো বলেই বসল ‘আরে, এই হারামি তো সিস্টেম খোকন। এবার নিজেই সিস্টেম হয়ে গেছে। মরলে ভালো হতো।’
যাই হোক, জানা গেল সাথে আরও তিনজন ছিল। তারা পালিয়ে গেছে। এক বিল্ডিং থেকে লাফিয়ে অন্য বিল্ডিংয়ে যাওয়ার সময় অন্ধকারে দুই বিল্ডিংয়ের চিপায় আটকে গেছে সে। প্রাথমিক চিকিৎসার পর এখন তার বিরুদ্ধে মাদক সেবন ও ব্যবসার দায়ে মামলা রুজু হয়েছে। ঘটনা এখানেই শেষ।
তবে কথা হলো- এতগুলো মানুষের প্রাণান্তকর চেষ্টায় বেঁচে গেল সিস্টেম খোকন। কিন্তু জামিনে এসে সে কি বদলাবে তার পুরোনো ব্যবসার সিস্টেম? দেখা যাক, কী হয়। ততক্ষণ শুধুই অপেক্ষা . . .
(অনুলিখন : আশীষ বিন হাসান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, ফুলবাড়ী সার্কেল, দিনাজপুর)
জিহাদুল কবির, পুলিশ সুপার, চাঁদপুর, ফেসবুক থেকে সংগৃহীত
ভিডিওতে দেখুন উদ্ধার অভিযান…..