সারাদেশ

আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার হয়ে রিকশাচালককে মারধোরকারী নারী যা বললেন

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার রাস্তায় মারমুখী ভঙ্গিতে একজন নারী এক রিকশাচালককে মারছে- এমন একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর নিজের দল আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার হয়েছেন একজন নারী।

ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক মোঃ মকবুল হোসেন তালুকদার বিবিসি বাংলাকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন।

রিকশাচালককে মারধোরের ভাইরাল হওয়া ভিডিওটিতে যে নারীকে দেখা গেছে, তিনি মিরপুরের ঐ ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের মহিলা-সম্পাদিকা সুইটি আক্তার শিনু। ভিডিও দেখার পর মিজ. সুইটিকে তারা দলীয় কমিটি থেকে বহিষ্কার করা হয় বলে মি. মকবুল জানিয়েছেন।

“যে ভিডিওটা ভাইরাল হইছে সেইটা আমরা দেখছি। এরপর তাৎক্ষনিকভাবে বসে সবাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি তাকে দল কমিটি থেকে বহিষ্কার করার,” বলেন মি. মকবুল।

মিজ. সুইটি এক-দেড় বছর আগে এই কমিটিতে যুক্ত হন। তিনি স্থানীয় একজন এমপির শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভিভাবক কমিটির সদস্য বলে জানান মকবুল হোসেন তালুকদার।

কী বলছেন সুইটি আক্তার?

যে ভাইরাল ভিডিওটি নিয়ে নানারকম আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে, সেটির বিষয়ে সুইটি আক্তার সাথে কথা বলেছেন।

তিনি বলেছেন, মিরপুরের রূপনগর আবাসিক এলাকায় ঘটনাটি ঘটেছে।

ওই ঘটনা নিয়ে তিনি এখন “লজ্জিত” বলেও জানান, “আমি একদম স্যরি, যেহেতু আমার ভুল হয়ে গেছে। আমার এটা করা উচিত হয়নি। আমি স্যরি বলতেছি।”

এ ঘটনার পর তাকে দল থেকে বহিষ্কারের বিষয়ে তিনি বলেন, “আমার ভুল হইছে। আমার দল ঠিক করেছে।”

তার দাবি, “দলের বাইরের কিছু লোক ভিডিও করে তাকে অপব্যবহার করছে।”

এই ভিডিও ভাইরাল হওয়া সম্পর্কে সুইটি আক্তার বলেন, “এই ইলেকশনকে কেন্দ্র করে এইগুলা করতেছে। বেশি আমাদের বিপক্ষের লোকগুলা লেখালেখি করতেছে।”

এই ঘটনার পরে ফেসবুকে বেশ কিছু ফেক আইডি তৈরি করা হয় বলে অভিযোগ উঠেছে । কোনটিতে তাকে “বিএনপি নেত্রী” আবার কোনটিতে তাকে “আওয়ামী লীগ নেত্রী” হিসেবে বর্ণনা করা হয়।

কেন মারধোর করলেন তিনি?

সামাজিক মাধ্যমে বিশেষ করে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে যেটুকু দেখা গেছে তার আগে কিছু ঘটনা ঘটেছে তা লোকজনের নজরে আসেনি বলেও তিনি দাবি করেন।

“বাসায় আমার বাচ্চা আছে এবং চুলায় রান্না চাপানো আছে- এটা বলার পরও রিকশাচালক তার কথা না শুনে ধীরে ধীরে চালাচ্ছিলেন এবং ভাঙ্গা জায়গা দিয়ে রিকশা চালাচ্ছিলেন,” বলেন মিজ. সুইটি।

এরপর তিনি “রিকশা থেকে পড়ে যান” বলেও উল্লেখ করেন।

তবে তিনি তো চাইলে অন্য রিকশায় উঠে যেতে পারতেন-সে প্রশ্ন করা হলে মিজ সুইটি স্বীকার করেন, “এমনটা করা হয়নি।”

“এই ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর এ নিয়ে পারিবারিক এবং সামাজিকভাবে তিনি লজ্জার মুখে পড়েছেন,” তিনি জানান।

“আপনাকে বলে বোঝাতে পারবো না গতকাল (মঙ্গলবার) থেকে আমি কিসের মধ্যে আছি।”

ভিডিওতে কী আছে?

রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা একটি রিকশার সিটে আরোহী একজন নারী। যিনি সমানে চিৎকার করছেন আর মারছেন সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রিকশা চালককে। লোকজন জড়ো হয়ে গেছে আশে-পাশে। এমন একটি ভিডিও হঠাৎ ভাইরাল হয়েছে ফেসবুকে।

অনেকের শেয়ার করা ভিডিওটিতে দেখা যায়, সালোয়ার কামিজ পরা রিকশারোহী ওই মহিলা রিকশাওয়ালাকে ‘তুই’ সম্বোধন করে কথা বলছেন।

ভিডিওটি যেখানে শুরু হয় সেখানে দেখা যায় রিকশাটি রাস্তার ধারে থেমে আছে এবং মারমুখী ভঙ্গিতে থাকা ওই নারীটি রিকশাওয়ালাকে উদ্দেশ্য করে বলছেন, “তোরে আমি নিয়া ছাড়মু তুই যাবি…।” এসময় রিকশাওয়ালা কিছু বলে উঠলে ওই নারীটি বলেন, “তোর ভাড়ার গুষ্টি কিলাই, তোকে ডাবল(দ্বিগুণ) ভাড়া দিবো, তুই যাবি।”

এই ঘটনা দেখে দাঁড়িয়ে পড়া উৎসুক জনতার মধ্য থেকে কেউ একজন এই ভিডিওটি করেন। পরবর্তীতে সেটাই ভাইরাল হয়ে যায় সামাজিক মাধ্যমে।

এসময় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা রিকশাওয়ালাকে ক্যামেরার নজরে আসেনি। তবে ওই নারী চালককে বলতে থাকেন, “যা চালা। চালা…চালা…।”

এরপর দ্রুত তিনি আবার উঠে বসেন রিকশায়। কিন্তু রিকশাওয়ালা তখন রাস্তায় জড়ো হয়ে যাওয়া লোকজনের দিকে তাকিয়ে বলতে থাকেন, “উনি বলতেছে তাড়াহুড়া কইরা চালাইতে…।” তার কথার মাঝে ওই নারীটি বলে ওঠেন, “তোরে কী বলছি? আমি বলছি ভাই জোরে চালাও, তুই কী করলি ভাঙ্গাচুরাতে রিকশা…” এ পর্যন্ত বলেই তিনি রিকশাওয়ালাকে আবার মারতে শুরু করেন।

এবার পা দিয়ে লাথি মারতে দেখা যায় তাকে। সেইসাথে গালিও দিতে থাকেন। তিনি বলেন, “তোরে সাবধান করছি, আমি তোরে কইছি তাড়াহুড়া কর…।”

মহিলাটি রিকশায় বসেই রিকশাটির চালককে এবার হাতে থাকা মোবাইল সেটটি দিয়ে মারেন।

এসময় আশে-পাশে দাঁড়ানো লোকজনের মধ্য থেকে কেউ কেউ প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ রূপে থাকা ওই নারীকে উদ্দেশ্য করে বলেন ,”আপনি ওনাকে মারতেছেন কেন?”

এর জবাবে রিকশারোহী নারীটি তাদের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে ওঠেন। হাত নেড়ে বলেন, “যান এখান থেকে।”

এসময় দাঁড়িয়ে থাকা লোকজনের কয়েকজনকে প্রতিবাদ করলে ওই নারীটি তাদের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করতে থাকেন। লোকজনের মধ্য থেকে কাউকে কাউকে বলতে শোনা যায়, “আপনি তো ভালো কাজ করতেছেন না।”

আরেকজন বলেন, “আপনি তো ভদ্রমহিলা না।”

অন্য একজন লোককে বলতে দেখা যায়, “আপনি মহিলা মানুষ। …রিকশাওয়ালাকে মেরে আপনি ভালো কাজ করেন নাই, গায়ে হাত তুলছেন…আমি এখানে দাঁড়াইয়া দেখছি…।”

একজনকে বলতে শোনা যায়, “বেয়াদব মহিলা”। তবে তার মুখ দেখা যায়নি।

আরেকজন বলে ওঠেন, “আপনাকে কে পারমিশন(অনুমতি) দিয়েছে?”

এমন সময় রিকশা থেকে ওই মহিলাকে নেমে মারমুখী ভঙ্গিতে একজন পুরুষের দিকে এগিয়ে যেতে দেখা যায়। ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওটির দৈর্ঘ্য এই পর্যন্তই।

সেখানে একজন নারীকেও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। তবে তিনি কোনও কথা বলতে ভিডিওতে দেখা যায়।

সামাজিক মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া

ভিডিওটি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ার পর অনেকেই এভাবে একজন নারীর মারমুখী আচরণ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।

আবার কেউ কেউ ভিডিওটি শেয়ার করে ব্যঙ্গ-রসাত্মক বক্তব্য লেখেন। একটি অনলাইন পোর্টালের “জনসম্মুখে ‘পুরুষ নির্যাতন’, ভিডিও ভাইরাল” এই শিরোনামের খবরও অনেকে শেয়ার করেন।

আবার একজন নারীকে নিয়ে এভাবে ট্রল করার প্রতিবাদ করে সামাজিক মাধ্যমে লেখেন।

তাদের বক্তব্য- বাংলাদেশের অনেক স্থানেই যেখানে রাস্তাঘাটে রিকশা-চালক বা বাসের হেলপারদের মারতে দেখা যায়। কিন্তু এই ঘটনার ক্ষেত্রে হামলাকারীর ভূমিকায় একজন নারীকে দেখতে পেয়ে কি লোকজনের প্রতিক্রিয়া এত তীব্র? তারা এই ঘটনাকে সমর্থন না করলেও বলছেন, সেসব সময় কেন ভিডিও করা হয়না?

রোকসানা ইসলাম জেরিন তার ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন, “রিকশাওয়ালাকে এর আগে কেউ কোন দিন মারে নাই। এই প্রথম কেউ এভাবে মারলো। এই নারীর কঠিন শাস্তি হওয়া উচিত।”

সেখানে মন্তব্য করেছেন যারা তার মধ্যে ডিজি সুখন নামে একজন লিখেছেন, “অবশ্যই মারছে,আমিও মারছি।বাট এই মা… এর জাতের লোকটার কথা বলার ধরন, ফিজিক্যাল মুভমেন্ট এবং বয়স্ক/সম্মানী ব্যক্তির সাথে বাকবিতণ্ডা একটু মনোযোগ দিয়ে দেখা আবশ্যক। এন্ড ইয়েস, তার গেট-আপ এবং জেশ্চার আমাদের চোখে অবশ্যই অশোভনীয়।”

একই পোস্টে শ্রাবণী জলি লিখেছেন, “মারছে কিন্তু ভিডিও হয়নাই”।

ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপেও এই ভিডিওটি শেয়ার করা হয়। একটি গ্রুপে কবীর খান নামে একজন সেটি শেয়ার করে লিখেছেন, “একজন রিকশাচালক হিসেবে লোকটির দোষ সে ধীরে রিক্সা চালাচ্ছিল!! যাত্রী হিসেবে মহিলার ব্যবহার!!মহিলাটাকে আইনের আওতায় নিয়ে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হোক।”

আবার কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, “একটা ছেলে গায়ে হাত তুললে সেটা যদি সামাজিক যোগাযোগে ভাইরাল না হয় তাহলে একজন নারী করলে সেটা হবে কেন?” (বিবিসি বাংলা)

বার্তা কক্ষ
১২ ডিসেম্বর,২০১৮

Share