চাঁদপুরসহ সারাদেশে শনিবার (১৬ মার্চ ) থেকে জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহ শুরু । ‘ কোনো জাল ফেলব না, জাটকা ইলিশ ধরব না ’ প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়ে চাঁদপুরসহ দেশের ৩৬ টি জেলা-উপজেলায় জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহ চলছে। যা ২২ মার্চ পর্যন্ত বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যদিয়ে এ সপ্তাহ চলবে।
জাটকা সংরক্ষণের আওতাভূক্ত জেলাগুলো হলো : চাঁদপুর, ঢাকা, মানিকগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, রাজবাড়ি, শরিয়তপুর, মাদারীপুর, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদি, টাঙ্গাইল, গোপালগঞ্জ, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, ঝালকাঠি, লক্ষ্মীপুর ফেণী, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, খুলনা, রাজশাহী, চাঁপাইগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, নাটোর, জামালপুর ,পাবনা, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা ।
ইলিশ আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদগুলোর মধ্যে একটি। আমাদের দেশের ইলিশের সুনাম পৃথিবীর সর্বত্র। বাঙালীর সাংস্কৃতিক,ঐতিহ্য ও গৌরবের সাথে মিশে আছে ইলিশের স্বাদ। নদ-নদীর দেশগুলোর মধ্যে পৃথিবীর অন্যতম দেশ বাংলাদেশ।দেশের এ নদ-নদীতে ইলিশ উৎপাদন দিন দিন বাড়ছেই। এদেশে বহু প্রকারের মাছ রয়েছে।এর মধ্যে ইলিশের অবস্থান সর্বশীর্ষে।
জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার তথ্য মতে,বিশ্বে মিঠা পানির উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান ৪র্থ। দেশে যে পরিমাণ ইলিশ উৎপাদন হচ্ছে তার বর্তমান মূল্য প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা।
মৎস্য বিভাগের এক তথ্যে জানা গেছে, ২০০৮-২০০৯ অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদন ছিল ২ লাখ ৯৪ হাজার মে.টন। আর ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদন দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ মে.টন। এখন নদী উপকূলীয় ইলিশ জোন ৩৬ টি এবং ১২৫ টি উপজেলায় এর ব্যপ্তি। গড়ে ৫শ টাকা করে কেজি ধরলে এর মূল্য দাঁড়ায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। ইলিশের গুরুত্বের প্রতি দৃষ্টি রাখলে বুঝা যায়- ইলিশ আমাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি,দারিদ্রদূরীকরণ ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে ।
ইলিশের অর্থনৈতিক মূল্যের কথা যদি ভাবি তাহলে বলতে হয়-বিদেশ থেকে আনা ডিজেল, পেট্রোল ও অকটেনের মূল্যের সাথে তুলনা করি তাহলে দাঁড়ায়-এক লিটার ডিজেলের মূল্য ৬৮ টাকা,এক লিটার পেট্রোলের মূল্য ৯৬ টাকা এবং এক লিটার অকটেনের মূল্য ৯৮ টাকা ।
যা দিয়ে নামী- দামী গাড়ি বা উড়োজাহাজ চলে। আর আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ ইলিশের ঔ পরিমাণ এক কেজির মূল্য ৮ শ থেকে ১ হাজার বা এক হাজার দু’শ টাকা। ইলিশ এ দেশের এক মূল্যবান সম্পদ তা’ আর বলার অপেক্ষা রাখে না । দেশের মাছের উৎপাদনের ১২ % হলো ইলিশ এবং জেডিপিতে এর অবদান ১%। তাই ইলিশের অর্থনৈতিক গুরুত্ব অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের চেয়ে কোনো মতেই কম নয়।
চাঁদপুরের মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, প্রায় ৭৫% ইলিশ বাংলাদেশে, ১৫ % ভারতে, ৫% মায়ানমারে এবং বাকি ৫% টাইগ্রিসসহ পৃথিবীর অন্যান্য নদীতে পাওয়া যায়। এর মধ্যে বাংলাদেশের ইলিশের স্বাদই আলাদা, অভিন্ন ও সর্বত্র চাহিদা রয়েছে। আমাদের দেশের সব নদ-নদীতে ইলিশের প্রাচুর্য না থাকলেও মেঘনা ও পদ্মা নদীর উপকূলীয় এলাকায় এর বিচরণ ক্ষেত্র রয়েছে অবাধ। ডিম পাড়ার সময় হলেই প্রাকৃতিক নিয়মে তারা মিঠা পানির মেঘনায় প্রবেশ করে।
গবেষণায় আরো একটি ইলিশের আবাসস্থল সরকার ঘোষণা করেছে। এ নিয়ে ইলিশের অভয়াশ্রমের সংখ্যা দাঁড়ালো ৬ টিতে। ফলে দেশের ইলিশ অভয়াশ্রমের ব্যাপ্তি বা দৈর্ঘ্যও বৃদ্ধি পেয়ে এখন ৪ শ’ ১০ কি.মি। এরইমধ্যে বরিশাল জেলার হিজলা ও মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার লতা, নয়াভাঙ্গানী ও ধর্মগঞ্জ নদীর মিলনস্থলে নতুনভাবে আরো ৬০ কি.মি.এলাকাকে ইলিশের ৬ষ্ঠ অভয়াশ্রম হিসেবে মৎস্য বিভাগ কর্তৃক ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
চাঁদপুর নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের ইলিশ গবেষক ড.আনিছুর রহমান চাঁদপুর টাইমসকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন ।
এনহ্যান্স কোস্টাল ফিরারিজ ইন বাংলাদেশ প্রকল্পের ইলিশ মাছ ব্যবস্থাপনা কর্ম পরিকল্পনার এক গাইড লাইন রিপোর্ট সংস্করণ মতে,দেশের অন্য ৫ টি ইলিশের অভয়াশ্রমসমূহের মধ্যে রয়েছে চাঁদপুর জেলার ষাটনল থেকে লক্ষ্মীপুর জেলার চর আলেকজান্ডার পর্যন্ত মেঘনা নদীর ১ শ’ কি.মি, চর ইলিশা থেকে ভোলা জেলার চর পিয়াল পর্যন্ত মেঘনা নদীর শাহবাজপুর চ্যানেলের ৯০ কি.মি।
ভোলা জেলার ভেদুরিয়া থেকে পটুয়াখালী জেলার চর রোস্তম পর্যন্ত তেঁতুলিয়া নদীর ১ শ’ কি. মি । পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার আন্ধারমানিক নদীর ৪০ কি.মি। শরীয়তপুর জেলার নুরিয়া থেকে ভেদরগঞ্জ পর্যন্ত নিম্ম পদ্মার ২০ কি.মি. এলাকা ইলিশের অভয়াশ্রম হিসেবে পূবেই ঘোষিত।
অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট বরিশাল জেলার হিজলা ও মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার লতা, নয়াভাঙ্গানী ও ধর্মগঞ্জ নদীর মিলনস্থলে নতুনভাবে আরো ৬০ কি.মি.এলাকাকে ইলিশের ৬ষ্ঠ অভয়াশ্রম হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
সরকার প্রতিবছর জাতীয় মাছ ইলিশ রক্ষায় মেঘনা ও পদ্মা নদীর উপকূলীয় এলাকার বিচরণ কেন্দ্রগুলিতে অভয়াশ্রম ঘোষণা ও মা মাছসহ জাটকা রক্ষা করতে ২ মাস নদীতে মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকে। এক শ্রেণির অপয়া জেলে সরকারি নির্দেশ অমান্য করে মার্চ-এপ্রিলে অবাধে জাটকা নিধন সও বর্তমান অক্টোবর মাসের এ সময় তারা আইন শৃংখলা বাহিনীর চোখকে নানাভাবে ফাঁকি দিয়ে মা ইলিশ ধরে যাচ্ছে। সংসার চালানোর অজুহাতে তারা এ কাজটি করছে।
মৎস্য বিভাগের দেয়া এক তথ্যে জানা গেছে , নদী উপকূলীয় এলাকাসহ মাত্র ২% লোক জাটকা ও মা ইলিশ ধরা, বেচা, কেনা ও বিভিন্ন স্থানে চালান, বরফ ব্যবসা, পরিবহনের কাজে জড়িত। মাত্র এ দু’ভাগ লোক দেশের ৯৮ % মানুষের জাতীয় সম্পদ ইলিশ ধ্বংসের কাজে নিয়োজিত রয়েছে ।
জেলেদের ৩ মাস সংসার চালাতে আর্থিক সহায়তা ও বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা সত্ত্বেও নির্বোধ জেলেরা তাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন বড় হয়ে মাছে পরিণত হওয়ার সময়ই জাটকা অবাধে ধরে ফেলছে। চাঁদপুরে মা ইলিশ ও জাটকা রক্ষার কৌশল পরিবর্তনে চাঁদপুরের হাইমচরে ও চাঁদপুর মোলহেডে সেনাবাহিনীর ক্যাম্প স্থাপন প্রয়োজন। পরীক্ষামূলকভাবে এটি এখন করা যেতে পারে ।
তাহলে তারা নদীতে মাছ ধরা সাহসই পাবে না। কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে ২০০১-২০০২ অর্থবছর থেকেই জাতীয়ভাবে ইলিশ সম্পদ রক্ষায় জাটকা নিধন প্রতিরোধ কর্মসূচি পালন করতে হচ্ছে। দেশের গৌরবময় সেনাবাহিনী দেশের সম্পদ রক্ষায় কাজ করবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস ।
সরকার প্রকৃত জেলেদের সুযোগ সুবিধা দেয়ার জন্যেই তাদের সঠিক তালিকা তৈরিসহ ছবিযুক্ত পরিচয়পত্রও দিয়েছেন। মৎস্য বিভাগ ইউপির জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতায় ওইসব জেলেদের তালিকা তৈরি,কার্ডের মাধ্যমে চাল বিতরণ, প্রশিক্ষণ, বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে থাকেন।
তাই তারাই জানেন জাটকা নিধনে রাতে বা দিনে, সকালে বা সন্ধ্যায় সরকারি ছুটির দিনে কিংবা টাস্কফোর্স অভিযানে অংশগ্রহণ করে ফিরে আসার পর পর তারা আবার মা ইলিশ ও জাটকা নিধন মিশনে নেমে পড়ে।এতে জাতীয় সম্পদ ইলিশকে আশানুরূপভাবে রক্ষা করা যাচেছ না। তাই ইলিশ রক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার কৌশল পরিবর্তন এখন সময়ের দাবি বলে মনে করছি।
নদী উপকূলীয় ইউপির সকল জনপ্রতিনিধি ও গ্রাম পুলিশ বাহিনীদেরকে জাতীয় মাছ ইলিশ রক্ষায় সম্পৃক্ত করে ২ মাস মেয়াদী শক্তিশালী কমিটি গঠন করতে হবে ।
চাঁদপুরের ৩ টি উপজেলার বিশেষ বিশেষ স্থান সমূহে ওই ২ মাসের জন্যে সেনাবাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করা যেতে পারে। যে সব স্থানসমূহে সেনাবাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করা যেতে পারে সেগুলো হলো : মতলব উত্তরের মহনপুরে যা এখলাছপুর ও কানুদিকে নিয়ন্ত্রণ করবে।
চাঁদপুর সদরের মোলহেড যা কানুদি মিয়ার বাজার, ডাসাদী, রাজরাজেস্বর, চাঁদপুরের মেঘনা-ডাকাতিয়া, হরিণা ফেরিঘাট, ইব্রাহিমপুরের রব মুন্সীর বাজার বা বাংলাবাজারকে নিয়ন্ত্রণ করবে । হাইমচর উপজেলার পুরানো কলেজে যা চরগাজীপুর, হাইমচর ইউনিয়নের মধ্যচর এলাকায়, চরভৈরবী বাজার,কাটাখাল,বর্তমান হাইমচর বাজার এবং কালিখোলা লঞ্চঘাটকে নিযত্রণ করবে। ইত্যাদি। এর ফলে জাল-নৌকা নিয়ে তথাকথিত জাটকা নিধনকারীরা তখন নদীতে নামার দু:সাহস পাবে না। চোরাই পথে নিষিদ্ধ ঘোষিত কারেন্ট জাল ক্রয়ও করবে না ।
এ পদক্ষেপ বাস্তবায়ন হলে সরকারের কয়েক শ’কোটি টাকা সাশ্রয় ও জাটকা রক্ষা কর্মসূচি আরো সফল হবে। মৎস্য বিভাগ এ নিয়ে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের অযথা সময় নষ্ট ও দাপ্তরিক কাজের ব্যঘাত কম হবে । তাই মা ইলিশ ও জাটকা রক্ষার কৌশল গতানুগতিক পদ্ধতির পরিবর্তন করে এর নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন প্রয়োজন হলো সময়ের দাবি।
আবদুল গনি
১৯ মার্চ , ২০১৯