সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ আর কমাস পরেই নব্বই বছরে পা রাখবেন। আগামি ১ ফেব্রুয়ারি তাঁর বয়স নব্বই বছর পূর্ণ হবে। স্বাভাবিকভাবেই বয়সের ভারে ন্যুব্জ তিনি। আগের মতো আর প্রাত: ভ্রমণেও বের হতে পারেন না। আগে বের হলে দু‘জন দেহরক্ষী তাঁর নিরাপত্তায় থাকত।
বর্তমানে তিনি নিয়মিত সংবাদপত্র পড়েন। সেখান থেকেই প্রতিদিন জানছেন সমাজ,রাষ্ট্রের গতিবিধি। তবে সে জানার বহিঃপ্রকাশ নেই। বাইরের লোকজন তো’দূরের কথা, নিকটাত্মীয়দের সঙ্গেও এসব নিয়ে কথা বলেন না। গণমাধ্যম থেকেও থাকছেন দূরে।
কেমন, কিভাবে কাটছে এ সাবেক রাষ্ট্রপতির দিনকাল ? এসব প্রশ্নের উত্তর সরাসরি তাঁর কাছ থেকে পাওয়ার সুযোগ নেই। তাঁর নিকটাত্মীয়রাও গণমাধ্যমের কাছে মুখ খুলতে চান না। গুলশান-২-এ ‘গ্র্যান্ড প্রেসিডেন্ট কনকর্ডে’ একটি ফ্ল্যাটে নীরবে-নিভৃতে সময় কাটছে তাঁর। ভবনের নিরাপত্তাকর্মীদের ওপর কড়া নির্দেশ রয়েছে সাংবাদিকদের ‘না’ বলে দেয়ার জন্য। শনিবার সন্ধ্যায় ওই ভবনে পৌঁছে এমন নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হতে হয়। ভবনের রিসিপশন ডেস্ক থেকে সুপারভাইজার সুকুমার রায় বললেন,‘উনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন না ।
পাল্টা প্রশ্ন করে ওনার পরিবারের কারো সঙ্গে কি কথা বলা যায়? জবাবে সুকুমার বললেন,‘সে বিষয়েও আমি কোনো সহযোগিতা করতে পারব না। নিষেধ আছে।’
সাবেক এ রাষ্ট্রপতির একজন নিকটাত্মীয় জানান, ‘২০১৩ সাল থেকে ‘ গ্র্যান্ড প্রেসিডেন্ট কনকর্ডে ’ ছোট ছেলে সোহেল আহমেদের সঙ্গে বসবাস করছেন তিনি। সহধর্মিণী আনোয়ারা আহমেদ গত বছর ১৮ জানুয়ারি ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮০ বছর।
ছেলে-মেয়েদের মধ্যে বড় মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড.সিতারা পারভিন ২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোতে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। ওই দুর্ঘটনায় তাঁর দ্বিতীয় মেয়ে শাহানা স্মিথের স্বামী গুরুতর আহত হয়ে পরের বছর মারা যান। শাহানা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রেই রয়েছেন। ছোট মেয়ে সামিয়া পারভীন একজন স্থপতি। তিনি বাস করেন যুক্তরাজ্যে। বড় ছেলে শিবলী আহমেদ একজন পরিবেশ প্রকৌশলী। তিনি যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী।’
তিনি আরো জানান, শিবলী আহমেদ মাস দু’ এক আগে দেশে এসেছিলেন। সে সময় তিনি জানান, আগামি অক্টোবরের দিকে স্থায়ীভাবে দেশে চলে আসবেন। সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের শারীরিক অবস্থাও ক্রমে অবনতির দিকে। বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছেন তিনি। বেশি অসুস্থ বোধ করলে কখনো হাসপাতালে নেয়া হয় । আবার কখনো বাসায়ই আসেন চিকিৎসকরা। সাধারণত:সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের চিকিৎসকরা আসেন বাসায়।
গ্র্যান্ড প্রেসিডেন্ট কনকর্ডের এক নিরাপত্তাকর্মী জানান, দু’সপ্তাহ আগে একবার তাঁকে অ্যাম্বুল্যান্সে করে হাসপাতালে নেয়া হয়েছিল। ২০১৭ সালের ৩০ ডিসেম্বর থেকে ২০১৮ সালের ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত সাহাবুদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।
সাহাবুদ্দীন আহমদ নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার পেমই গ্রামে ১৯৩০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা তালুকদার রেসাত আহমদ ভূঁইয়া ছিলেন একজন খ্যাতনামা সমাজসেবক ও জনহিতৈষী ব্যক্তি। সাহাবুদ্দীন আহমদ তাঁর কর্মজীবনে প্রথমে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন। ম্যাজিস্ট্রেট,মহকুমা প্রশাসক এবং অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক পদেও দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৬০ সালের জুন মাসে তাঁকে বিচার বিভাগে বদলি করা হয়। তিনি ঢাকা ও বরিশালে অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ এবং কুমিল্লা ও চট্টগ্রামে জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি ঢাকা হাইকোর্টের রেজিস্ট্রার নিযুক্ত হন। ১৯৭২ সালের ২০ জানুয়ারি তাঁকে বাংলাদেশ হাইকোর্টের বিচারক পদে উন্নীত করা হয়।
১৯৮০ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি সাহাবুদ্দীন আহমদকে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারক নিয়োগ করা হয়। বিচারপতি হিসেবে তাঁর প্রদত্ত বহুসংখ্যক রায় প্রশংসিত। বাংলাদেশ সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর ওপর তাঁর প্রদত্ত রায় দেশের শাসনতান্ত্রিক বিকাশের ক্ষেত্রে এক অনন্য ঘটনা হিসেবে স্বীকৃত।
১৯৮৩ সালের মধ্য ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভরত ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণের ঘটনা তদন্তের জন্য গঠিত তদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। তৎকালীন সরকার তাঁর ঔ তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। ১৯৭৮ সালের আগস্ট থেকে ১৯৮২ সালের এপ্রিল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ রেড ক্রস সোসাইটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৯০ সালের ১৪ জানুয়ারি তাঁকে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করা হয়। ওই বছরের ৬ ডিসেম্বর এরশাদবিরোধী গণ-আন্দোলনের মুখে তৎকালীন উপ-রাষ্ট্রপতি মওদুদ আহমদ পদত্যাগ করেন এবং বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে উপ-রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করা হয়। ওই দিনই রাষ্ট্রপতি এরশাদ পদত্যাগ করে উপ-রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।
ফলে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি সরকার প্রধানের দায়িত্ব লাভ করেন এবং নিরপেক্ষ অরাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করে ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করেন। ওই সময় সরকার প্রধান হিসেবে তিনি বিশেষ ক্ষমতা আইনসহ বেশ কিছু আইন সংশোধন করে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিতে ভূমিকা রাখেন।
সাহাবুদ্দীন আহমদের চাহিদা অনুসারে দেশের সংবিধানের এগারোতম সংশোধনীটি আনা হয়। এর ফলে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনের পরও তিনি ১৯৯১ সালের ১০ অক্টোবর প্রধান বিচারপতির দায়িত্বে সুপ্রিম কোর্টে ফিরে যান এবং ১৯৯৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি প্রধান বিচারপতির পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
সাহাবুদ্দীন আহমদ আবারও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসেন ১৯৯৬ সালে। দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ওই বছর ক্ষমতায় এসে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি হিসেবে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করে। ১৯৯৬ সালের ৯ অক্টোবর তিনি নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন এবং ২০০১ সালের ১৪ নভেম্বর তিনি রাষ্ট্রপতির পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
বার্তা কক্ষ
২৬ জুলাই ২০১৯
এজি